বন্ধু একটা চিঠি লিখো আমার জন্য

প্রতীকী ছবি

গল্পগুলো নব্বই দশকের, সেই ল্যান্ডফোনের দিনগুলোর। স্কুলগেটের সম্মুখে ছেলেটির নিরন্তর অপেক্ষা। কখন স্কুল ছুটি হবে, কখন মেয়েটিকে একনজর দেখা হবে। যদিও মেয়েটি ক্লাসরুম থেকে বেরিয়ে মাথার ওপরে থাকা ছাতাটা অল্প সরিয়ে খুব বেশি সময় সামনের দিকে চেয়ে থাকতে পারে না, ছেলেটি হ্যাবলার মতো চেয়েই থাকে। লজ্জায় চোখ নামিয়ে নেয় মেয়েটি। তারপর একদিন বান্ধবীর হাত ধরে চিঠি আসে তার কাছে। উৎকণ্ঠা, বুক দুরুদুরু, প্রতীক্ষা তারপর চিঠি পড়ে রাত জেগে লুকিয়ে লুকিয়ে চিঠির উত্তর লেখা। পরদিন আবার বান্ধবীর মাধ্যমে ছেলেটির কাছে চিঠি পৌঁছানো। কী সোনালি দিন ছিল সে সময়।

নব্বই দশকের অনেকের প্রেমের শুরু এভাবেই। তারপর লুকিয়ে লুকিয়ে দেখা, চিঠির জন্য নিরন্তর অপেক্ষা করা, তারপর একদিন হয়তো পরিবার জেনে যায়। কারও কারও প্রেম অভিভাবকের হুমকিতে ভেঙে যায়। কিংবা কারও কারও বিয়ে হয়ে যায় অন্য কারও সঙ্গে। ছেলেটি  আর মেয়েটির তেমন আলাদা হওয়ার গল্প ছিল।
তাদের মতো অসংখ্য প্রেম ভেঙেছে, আবার অনেক সফলতার মুখও দেখেছে। তবু সেকেলের প্রেমগুলো...অন্য রকম সুন্দর ছিল, অন্য রকম উত্তেজনার, অনেক উদ্বেগ আর ভালোবাসার ছিল। বিকেলে প্রেমিকার বাড়ির সামনে দিয়ে হেঁটে যাওয়া। একটা চিঠির জন্য কী নিদারুণ অপেক্ষায় কাটিয়ে দেওয়া মুহূর্ত।

চিঠি আদান–প্রদান ছাড়া আর কী খুব বেশি কিছু ছিল। ঈদের সময় ঈদকার্ডে ভালোবাসার কথা লাভ সাইন দিয়ে লিখে দেওয়া...এই তো। এর সঙ্গে হয়তো কোনো প্রিয় সাহিত্যিকের বই, অডিও ক্যাসেট—এসব ছিল উপহারের তালিকায়। কিন্তু যা কিছু ছিল, কোনো কৃত্রিমতা ছিল না।

তারপর একদিন মনপাখি খাঁচা ভেঙে উড়ে যায় অন্য কারও কাছে। সেকালের মানুষগুলোর প্রতিবাদের সাহস নেই, কারও সামনে গিয়ে প্রেমিকের দাঁড়ানোর সাহস নেই, প্রেমিকার নিজের ইচ্ছার কথা পরিবারে বলার সাহস নেই। ফলাফল একটা সম্পর্কের নীরব ইতি। তখন প্রেমিকের নীরব কান্নার একমাত্র সাক্ষী থাকত রাতজাগা চাঁদ।

আর এখন মিনিটে মিনিটে মেসেজ, ফোন, হোয়াটসঅ্যাপ—কী নেই এই সভ্য সমাজে। সবকিছু সহজলভ্য, ডেটিং, ফিল্ডিং, কেনাকাটা, রাত জেগে ভিডিও কল, চাইনিজ রেস্টুরেন্ট, এই দিবস, সেই দিবস।

অতঃপর পালিয়ে যাওয়া, পরিবারকে বাধ্য করে মানিয়ে নেওয়া, কিংবা আবার কোনো এক সময় ব্রেকআপ পার্টি। তারপর আবার নতুন সন্ধানে তোড়জোড়। কে এল, কে গেল...খুব একটা খেয়াল কারও থাকে না। অনেক সহজলভ্যের এই বাজারে প্রেমটাই যেন আগের থেকে বেশ সহজলভ্য হয়ে গেছে। সহজলভ্যে জিনিসের কদর খুব কম থাকে।

এরই মধ্যে কিছু ব্যতিক্রম আছে। ভালোবাসায় ভরপুর কিছু একালে–সেকালে সব কালে ছিল। তবে চিঠির যুগটাই বেশি ভালো ছিল। সেই যুগে ভালোবাসায় কৃত্রিমতা কম ছিল। একটা চিঠির জন্য দিন মাস অপেক্ষা করত সে সময় প্রেমিক–প্রেমিকারা। আর এখন একটা মেসেজ সিন না করলে তুলকালাম ঘটে যায়, কখনো প্রেম ভেঙেও যায়।

সেকালের প্রেম ছিল মায়া–মমতায় ঘেরা। প্রেমিক–প্রেমিকাবিহীন সময়গুলো কাটত বিটিভি দেখে কিংবা হুমায়ূন আহমেদ এবং ইমদাদুল হক মিলনের বই পড়ে পড়ে। তারপর লুকিয়ে লুকিয়ে বই থেকে কোটেশন নিয়ে চিঠি লিখা হতো, সে এক দীর্ঘ চিঠি। সেই চিঠি বইয়ের মধ্যে ভাঁজ করে রেখে প্রেরকের কাছে পৌঁছানোর উপায় খোঁজা লাগত।
#বন্ধু একটা চিঠি লিখো আমার জন্য।

লেখা: কাওছার আহমেদ নিলয়, কুয়েতপ্রবাসী