বঙ্গবন্ধুবিষয়ক বিরল চিত্র প্রদর্শনী জাপানে
জাপানে একটা বিরল ইতিহাস সৃষ্টি হলো ২৬ ডিসেম্বর (২০২১)। বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবর্ষ এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে ‘সাইতামা-প্রিফেকচারের কাওয়াগুচি শহরের কাহাল আর্ট গ্যালারিতে উদ্বোধন হলো ‘বঙ্গবন্ধু ইন্টারন্যাশনাল আর্ট এক্সিবিশন’ শীর্ষক একটি বিশেষ চিত্র প্রদর্শনী। এর উদ্বোধন করেন জাপানে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত শাহাবুদ্দিন আহমদ।
প্রদর্শনীর আয়োজক কাহাল গ্যালারির প্রতিষ্ঠাতা জাপানপ্রবাসী তরুণ চিত্রশিল্পী কামরুল হাসান। তারুণ্যে টগবগে স্বল্পভাষী শিল্পী কামরুল হাসানের আমন্ত্রণে প্রদর্শনী দেখার সৌভাগ্য হলো। তাঁকে জানাই অশেষ ধন্যবাদ ও সাধুবাদ। প্রদর্শনীতে বিশিষ্ট শিল্পীদের ৭১টি চিত্র স্থান পেয়েছে। প্রতিটি চিত্রকর্মই অসাধারণ। চিত্রগুলোতে শিল্পীরা বঙ্গবন্ধুকে নানা অভিব্যক্তিতে সমুজ্জ্বল করেছেন, যা না দেখলে এই বৈচিত্র্যময়তা দর্শন করা সম্ভব নয়।
বাঙালি কোনো বিশিষ্ট ব্যক্তিত্বকে নিয়ে এ ধরনের প্রদর্শনী জাপানে এ প্রথম। বিশ্বের অন্য কোনো দেশে হয়েছে কি না, আমার জানা নেই! দেড় বছর ধরে অক্লান্ত পরিশ্রমের বিনিময়ে এমন একটি প্রদর্শনীর আয়োজন করা শিল্পী কামরুল হাসানের পক্ষেই সম্ভব হয়েছে। তাঁকে প্রাণঢালা অভিবাদন জানাতেই হয়। প্রদর্শনীতে উপস্থাপিত বঙ্গবন্ধুকে অঙ্কিত তাঁর নিজের আঁকা বৃহৎ আঙ্গিকের অসামান্য সুদর্শন একটি চিত্রকর্ম আগত সবাইকে অভিভূত করেছে। ছবিটি অবশ্যই বাংলাদেশ দূতাবাসে সংরক্ষিত হওয়ার দাবি রাখে। হাস্যোজ্জ্বল বঙ্গবন্ধুর চিত্রটি দেশি-বিদেশি যেকোনো মানুষের দৃষ্টিকে আকৃষ্ট করবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
করোনার বিধিনিষেধ থাকা সত্ত্বেও প্রচুর প্রবাসী বাঙালির সমাবেশ ঘটেছে প্রদর্শনীতে। বয়োজ্যেষ্ঠ বিশিষ্ট প্রবাসীদের মধ্যে আবদুর রহমান, মুন্সি কে আজাদ, রেণু আজাদ উপস্থিত হয়ে বঙ্গবন্ধুর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন এবং উদ্যোক্তা শিল্পীকে উৎসাহিত করেন। উপস্থিত ছিলেন প্রভাবশালী এশিয়ান পিপলস ফ্রেন্ডশিপ সোসাইটির প্রতিষ্ঠাতা আইনজীবী বিদেশিবান্ধব জাপানি নাগরিক য়োশিনারি কাৎসুও এবং রিক্কিয়ো বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজতত্ত্ব অনুষদের ডিন মিজুকামি তেৎসুও। প্রদর্শনী কক্ষ সরগরম করে তুলেছেন বাংলাদেশি সমাজের অনেক পরিচিত মুখ, সাংবাদিক, রাজনৈতিক কর্মী, চিত্রশিল্পী, রবীন্দ্রসংগীতশিল্পী, লেখক ও ব্যবসায়ী।
প্রদর্শনীর কল্যাণে কতিপয় পুরোনো বন্ধুর সঙ্গেও সাক্ষাৎ হয়ে গেল অনেক বছরের ব্যবধানে। ছবি দেখার ছলে নানা স্মৃতিচারণাও হয়ে গেল। আরও ভালো লাগল এই যে স্বল্প পরিসরে হলেও একজন তরুণ বাংলাদেশি চিত্রশিল্পীর প্রচেষ্টায় একটি চিত্র প্রদর্শনীস্থল এই দেশে স্থাপিত হয়েছে দেখে। এটা নিতান্তই সামান্য কিছু নয়। প্রত্যাশারও অধিক পাওয়া। এখন থেকে নিয়মিত চিত্র প্রদর্শনী হবে বলে কর্ণধার শিল্পী কামরুল হাসান জানালেন।
এই নব-উদ্যোগের মধ্য দিয়ে জাপান-বাংলা শিক্ষা-সংস্কৃতির শতবর্ষ পুরোনো ভাববিনিময় আরও এক ধাপ এগিয়েছে বলেই আমার বিশ্বাস। যার সূচনা হয়েছিল ১৯০২ সালে কলকাতায় জাপানি মনীষী ও শিল্পাচার্য ওকাকুরা তেনশিন ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাক্ষাৎ ও বন্ধুত্বের স্থাপনের মধ্য দিয়ে। জাপানে বাঙালি চিত্রশিল্পীর প্রথম চিত্রকর্ম প্রদর্শিত হয়েছিল ১৯১৬ সালে, রবীন্দ্রনাথের প্রথম জাপান ভ্রমণের সময় উয়েনো-সংলগ্ন ইয়ানাকা শহরে জাপানের প্রথম আর্ট ইনস্টিটিউট ‘নিহোন বিজুৎসুইন’ প্রতিষ্ঠানে, যার প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন ওকাকুরা তেনশিন।
উল্লিখিত ধারা ধরে দুই দেশে চিত্রকলার ভাববিনিময় সময়ের সঙ্গে সঙ্গে গভীর এবং জোরালো হয়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগেই ওকাকুরার দুই শিষ্য এবং খ্যাতিমান চিত্রশল্পী একাধিক যেমন, য়োকোয়ামা তাইকান, হিশিদা শুনসোও, কাম্পো আরাই, কোওসেৎসু নোওসু, কাৎসুতা শৌকিন প্রমুখ কলকাতা ও শান্তিনিকেতনে গিয়েছেন, তাঁদের চিত্রকর্ম প্রদর্শিতও হয়েছে। বাংলা অঞ্চল থেকে জাপানে এসেছেন চিত্র মুকুলচন্দ্র দে, নন্দলাল বসু, বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায় প্রমুখ। যুদ্ধের পর ১৯৬১ সালে রবীন্দ্রনাথের জন্মশতবর্ষ উদ্যাপন উপলক্ষে রবীন্দ্রনাথের একক চিত্রকর্মের বিশেষ প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়েছে ইউনেসকোর সহযোগিতায়। ষাটের দশকেই জাপানে প্রদর্শিত হয়েছিল বিখ্যাত চিত্রশিল্পী আচার্য জয়নুল আবেদিনের একক চিত্র প্রদর্শনী।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার জাপানে কম বাংলাদেশি চিত্রশিল্পী শিক্ষালাভ উপলক্ষে আগমন করেননি! আনোয়ারুল হক, কালিদাস কর্মকার, গিয়াসউদ্দিন আহমেদ, এম এইচ কবীর জাপানে প্রসিদ্ধি অর্জন করেছেন। এ পর্যন্ত জাপানে বাংলাদেশি অনেক চিত্রশিল্পীর চিত্রকর্ম প্রদর্শিত হয়েছে। চিত্রশিল্পী কামরুলের প্রচেষ্টায় এ সুযোগ যে আরও সম্প্রসারিত হবে, এ আশাবাদ জাগিয়েছে উক্ত প্রদর্শনী।
উল্লেখ্য, এবারের ‘কাহাল সম্মাননা-২০২১’ প্রদান করা হয়েছে বিশিষ্ট চিত্রশিল্পী অধ্যাপক সমরজিৎ রায় চৌধুরীকে। শিল্পীকে জানাই অভিনন্দন। এ ছাড়া প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় গ্র্যান্ড অ্যাওয়ার্ড পেয়েছেন আরিফুর রহমান, রনি চন্দ্র মণ্ডল ও তাজরিয়ান তাবাসসুম। সাধারণ গ্র্যান্ড অ্যাওয়ার্ড পেয়েছেন আবু কালাম শামসুদ্দিন, মো. সাইফুদ্দিন, হাসুরা আক্তার, সৌরভ চৌধুরী ও ফারহানা ফেরদৌসী। শিক্ষকের প্রতি বা অগ্রজর প্রতি শিষ্য বা অনুজের এ যে সম্মান প্রদর্শন এবং তরুণ শিল্পীদের উদ্দীপ্ত করার আন্তরিক প্রচেষ্টা, এটা প্রবাসে অবশ্যই শিক্ষামূলক ও উৎসাহব্যঞ্জক বলে প্রতীয়মান।
কথা প্রসঙ্গে কাহাল আর্ট গ্যালারির চেয়ারম্যান শিল্পী কামরুল জানালেন, ‘জাপানে ও বাংলাদেশে নিয়মিত চিত্র প্রদর্শনী অনুষ্ঠানের পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। শিল্পকলার্চচার মধ্য দিয়ে জাপান ও বাংলাদেশকে পরস্পরের কাছে পরিচিত ও দুই দেশের সাংস্কৃতিক বন্ধনকে জোরদার করাই আমাদের লক্ষ্য। আমরা সবার সহযোগিতা কামনা করি।’
সমগ্র অনুষ্ঠানটি পরিচালনা ও উপস্থাপনা করেন বিশিষ্ট লেখক, টিভি নাট্যাভিনেতা ও আবৃত্তিকার কামরুল আহসান। প্রদর্শনী চলবে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত।
*লেখক: জাপানপ্রবাসী শিশুসাহিত্যিক, কথাসাহিত্যিক ও গবেষক