বঙ্গবন্ধু ছিলেন সাধারণের একজন

বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ
বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ

শেখ মুজিবুর রহমান। বাংলা ও বাঙালির কাছে নামটি ভুলবার নয়। তিনি জাতির পিতা। বঙ্গবন্ধু শব্দটিও তাঁর নামের সঙ্গে জুড়ে দিয়েছে এ দেশের মানুষ। যত দিন বাংলাদেশ থাকবে তত দিন হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ এ বাঙালির অবদানের কথা স্মরণ করবে এই জাতি। পাশাপাশি তাঁর জন্মের তিথিও চিরজাগরূক থাকবে প্রাণের স্পন্দনে। ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ বাঙালির জন্য আশীর্বাদের একটি দিন। আনন্দের দিনও বটে। এই দেশের এই মাটিতে এদিনই জন্ম নিয়েছিল মুজিব নামের এক প্রকৃতির সন্তান।

আবুধাবির বাংলাদেশ দূতাবাস যথাযোগ্য মর্যাদায় উদ্‌যাপন করে দিনটি। সকালে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ করে দূতাবাসসহ আবুধাবির বিভিন্ন সংগঠন। বাংলাদেশ স্কুল, জনতা ব্যাংক, বিমান, বাংলাদেশ সমিতি, বঙ্গবন্ধু পরিষদ, বঙ্গবন্ধু স্মৃতি সংসদ, আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, প্রজন্ম বঙ্গবন্ধু এ পর্বে অংশ নেয়। ছোটরা কেক কাটে, আনন্দ করে। সেখানে ছিল আলোচনা পর্ব।
মধুমতি নদী, আছে বাইগার বিল। এমনই নদী আর হাওর-বাঁওড়ের মিলনে গড়ে ওঠা বাংলার অবারিত গ্রাম টুঙ্গিপাড়া। একেবারেই অজপাড়াগাঁ। এখানেই শেখ পরিবারে জন্ম নেয় খোকা নামের শিশুটি। কালের আবর্তে যিনি হয়ে উঠেছিলেন বাঙালির মুক্তির দিশারি। নিঃস্বার্থ আত্মত্যাগ এবং জনগণের প্রতি মমত্ববোধ ছিল তাঁর অবলম্বন। এ কারণে পরিণত বয়সে তিনি হয়ে ওঠেন বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা। ছিল শিশুদের প্রতি তাঁর অগাধ ভালোবাসা। সে জন্যই আজ জাতীয় শিশু দিবস। এ সবই উচ্চারিত আলোচনা পর্বে। পর্বটিতে সভাপতিত্ব করেন সংযুক্ত আরব আমিরাতে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মোহাম্মদ ইমরান।
আলোচনা পর্বের আগে বঙ্গবন্ধুর জীবন ও কর্মের ওপর একটি প্রামাণ্যচিত্র প্রদর্শন করা হয়। এর আগে রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বাণী পরে শোনানো হয়। বাণী পড়েন কাউন্সেলর ও চ্যান্সারি প্রধান শহীদুজ্জামান ফারুকী, কাউন্সেলর ড. মোকসেদ আলী ও প্রথম সচিব রিয়াজুল হক। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন কাউন্সেলর ও দূতাবাসের মিনিস্টার ইকবাল হোসেন খান।

বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনে কেক কাটার দৃশ্য
বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনে কেক কাটার দৃশ্য


রাষ্ট্রদূত মোহাম্মদ ইমরান সব সময়ই ছোটদের গুরুত্ব দেন। এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। তিনি বলেন, নতুন প্রজন্মকে বাংলাদেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য সম্পর্কে জানাতে হবে। ১৯৭৫ সালের পরে দেশে বিপরীত স্রোত বইতে থাকে। তারা এ সময় বঙ্গবন্ধুকে জানতে পারেনি। তবে এখন আবার পারছে। সভায় তিনি বঙ্গবন্ধুকন্যার একটা লেখার সূত্র তুলে ধরেন। আমার পিতা শেখ মুজিব, তিনি বলেন, এমন লেখার মধ্য দিয়ে তারা জানবে বাংলাদেশের রূপকারকে।
শেখ যায়েদ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হাবিব উল হক খন্দকার একজন গবেষক। যেন তাঁর গবেষণা লব্ধ ফল তুলে ধরলেন। বাংলাদেশ এগিয়ে গেছে বহুদূর। উন্নয়ন হলে বিশ্ববাসী খোঁজে তার নেতাকে। বাংলাদেশের বেলায় সেটাই ঘটেছে। বলেন, বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকলে দেখতে পারতেন, তাঁর স্বপ্নের দেশ এখন কোথায়! তাঁর পরামর্শ, কাজের মধ্য দিয়েই দেখাতে হবে আমরা পারঙ্গম। মুখে নয় কর্মক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে সমুন্নত রাখার চেষ্টা করতে হবে। আসলেই তাই, বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হলে বঙ্গবন্ধু সম্মানিত হবেন। স্বাধীনতা নিয়ে তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের পর ঘোষণা বলতে আর কিছু বাকি থাকে না। 
বাংলাদেশ সমিতির সভাপতি প্রকৌশলী মোয়াজ্জেম হোসেন বলেন, ইউনেসকোকে বলা হয়নি, তারাই ৭ মার্চের ভাষণকে মূল্যায়ন করেছেন। বঙ্গবন্ধু তাঁর গুণেই বিশ্বের কাছে প্রশংসিত হয়েছেন। তিনি জন্মদিনের মর্যাদাকে অক্ষুণ্ন রেখেই একটি গল্প বলেন। তার আগে জানান, থাইল্যান্ডে বঙ্গবন্ধু চেয়ার করা হয়েছে, সেও তাদের আগ্রহে। তিনি বলেন, নিজ নিজ জায়গা থেকে প্রমাণ করতে হবে, আমরা অনন্য। অন্য দেশের সামনে সুখবর তুলে ধরতে হবে। দেশে এখন এক শ'র বেশি বিশ্ববিদ্যালয়, এগুলোই গৌরবের সমাচার।
সুসংবাদ এল। সে সংবাদ পড়া হলো সমাবেশে।
স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়েছে জাতিসংঘ। এর মধ্য দিয়ে উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে বাংলাদেশের স্বীকৃতি আদায়ের পথে আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হলো। আগামী ২০২৪ সালে বাংলাদেশের আনুষ্ঠানিক উত্তরণ ঘটবে।
জাতিসংঘের ওয়েবসাইটে বাংলাদেশের প্রোফাইলে এখন বলা আছে, উন্নয়নশীল দেশের কাতারে ওঠার যোগ্যতা এই মার্চেই অর্জন করেছে বাংলাদেশ।
সবাই আনন্দিত হলেন। মুহুর্মুহু হাতে তালি পড়ল। সে এক অন্যরকম মুহূর্ত!

মঞ্চে আলোচকেরা
মঞ্চে আলোচকেরা


বঙ্গবন্ধু পরিষদ সংযুক্ত আরব আমিরাত শাখার সভাপতি ইফতেখার হোসেন বাবুল। তিনি বলেন ভিন্নভাবে ভিন্নকথা। রাজনীতিকেরাই সমাজকে কলুষিত করতে পারে সহজে। তবে এমনটি কাম্য নয়। মানবসেবার নিমিত্তে মানুষের অধিকার আদায়ে বঙ্গবন্ধু লড়েছেন। মসনদ দখল করা তার লক্ষ্য ছিল না। দেশ থেকে সদ্য ঘুরে এসে তিনি তাঁর পর্যবেক্ষণ তুলে ধরেন। স্কুলের শিক্ষার্থীরা এখন জানে অনেক কিছু। বাংলাদেশ সম্পর্কে আছে তাদের স্বচ্ছ ধারণা। চলতি সরকার উদার রাজনীতি চালু করেছেন, তারই সুফল এটা। আত্ম মর্যাদাশীল ক্ষুধা ও দারিদ্র্য মুক্ত বাংলাদেশ গড়ার জন্য তিনি সবার প্রতি শেখ হাসিনার সরকারকে শক্তিশালী করার আহ্বান জানান।
জনতা ব্যাংকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা আমিরুল হাসান। তিনি শিশুদের প্রতি বঙ্গবন্ধুর ভালোবাসার প্রসঙ্গটি আনেন। গল্প নয়, একটি বাস্তব ঘটনার অবতারণা করেন। বলেন, এর মধ্য দিয়েই প্রমাণিত হয় বঙ্গবন্ধু হৃদয় দিয়ে ভালোবাসতেন ছোটদের।
বৈঠকি ধরন রাষ্ট্রদূত ইমরানের উপস্থাপনায়। তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধু ছিলেন সাধারণের একজন। এক এক করে তাঁর বলা। বাংলাদেশের বৃহত্তর মানুষ মধ্যবিত্ত কিংবা নিম্ন মধ্যবিত্ত পর্যায়ের। তিনি এসেছেন এমন জায়গা থেকে। চার বোন ও দুই ভাইয়ের মধ্যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ছিলেন পিতা শেখ লুৎফর রহমান ও মাতা সায়রা খাতুনের তৃতীয় সন্তান। প্রথম দুজন বোন। পরিবারের প্রথম ছেলে তিনি। এ জন্য আনন্দ চারদিকে। মুজিব উপভোগ করেন বিষয়টি। একেবারেই সাধারণ চিত্র।
শেখ মুজিবুর রহমান ধন ধান্য পুষ্প ভরা আমাদের এই বসুন্ধরাকে দেখেছেন। আবহমান বাংলার আলো-বাতাসে লালিত ও বর্ধিত হয়েছেন। বন্যার পানিতে তাল গাছ থেকে তৈরি ডোঙা, ভেলা চালানো, এসব গ্রামের ছেলেরাই করে। তিনি এসবের কোনোটাই বাদ দেননি। পেয়ারা গাছে উঠেছেন, ফল পেরেছেন। মূলত এই সাধারণ থেকে অসাধারণ হয়েছেন।
বাংলাদেশ স্কুলের অধ্যক্ষ মীর আনিসুল হাসান আনেন পলান সরকার প্রসঙ্গ। তিনি হেঁটে হেঁটে বই পড়ান মানুষকে। গিনেস বুকস অব রেকর্ডসে স্থান পেয়েছে তাঁর নাম। বলেন, আন্তরিকতা থাকতে হয়। বড় মানুষেরা পরিস্থিতির কারণে কিছু করতে বাধ্য হলেও অকপটে সত্যটা স্বীকার করেন। শামসুর রাহমান যেমন একবার তাঁর বন্ধুদের কাছ থেকে বিদায় নেন ‘দুই ঘণ্টার পাঠক ঠকানো সম্পাদকীয়’ লেখার জন্য। বলেন, সস্তা জনপ্রিয়তার জন্য বঙ্গবন্ধু কিছু করেননি।

বক্তব্য দিচ্ছেন (বাঁ থেকে) মোহাম্মদ ইমরান, ইফতেখার হোসেন, মোয়াজ্জেম হোসেন ও হাবিব উল হক খন্দকার
বক্তব্য দিচ্ছেন (বাঁ থেকে) মোহাম্মদ ইমরান, ইফতেখার হোসেন, মোয়াজ্জেম হোসেন ও হাবিব উল হক খন্দকার


প্রিয়াঙ্কা খন্দকার কবিতা দিয়ে শুরু করেন। বলেন, শিশুদের জন্য বঙ্গবন্ধুর ভালোবাসা ছিল অকৃত্রিম। তিনি বঙ্গবন্ধুর আদর্শে শিশুদের গড়ে তোলার আহ্বান জানান। একজন মা হিসেবে তিনি সব শিশুর প্রতি তাঁর ভালোবাসা প্রকাশ করেন।
আমরা বাইরে আসছি। সামনে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশ সমিতির সভাপতি প্রকৌশলী মোয়াজ্জেম হোসেন। তিনি অপেক্ষারত তাঁর দুই অতিথির জন্য। আমাকেও আহ্বান জানালেন। গেলাম দূতাবাস ঘেঁষা একই চত্বরের সমিতির ভবনে। তিনি নিচতলা থেকে দেখাতে দেখাতে সবাইকে নিয়ে গেলেন ওপরে সভাপতির দপ্তরে। নতুন বিন্যাস। ঝকঝকে তকতকে সাজিয়েছেন সবকিছু। বসলাম। দুই অতিথি ইফতেখার হোসেন বাবুল ও ড. হাবিব উল হক খন্দকার শুনলেন সমিতি ভবন নিয়ে তাঁর পরিকল্পনা। জড়ো হলেন একঝাঁক তারুণ্য। শওকত আকবর, নাসির তালুকদার, জাকির হোসেন সরব হলেন। তারপর আড্ডা হলো। ছবি তোলা বাদ যায় না। এই পর্যন্তই।

নিমাই সরকার: আবুধাবি, সংযুক্ত আরব আমিরাত।

উপস্থিতির একাংশ
উপস্থিতির একাংশ