বউ–শাশুড়ির দ্বন্দ্ব
বউ–শাশুড়ির দ্বন্দ্ব আমাদের সমাজের একটা বিশাল সমস্যা। কিন্তু এই প্রাগৈতিহাসিক সমস্যার সমাধানে কেউ আগ্রহী নন। এই সমস্যা জিইয়ে রেখে ফায়দা শুধু একজনের—মায়ের ছেলেটির বা বউয়ের জামাইটির। আসলেই কি শুধু তাই? তারও কি টানাপোড়েনে পড়তে হয় না?
সমস্যাটা কেন?
কেউ ভেবেছেন? সামাজিক, অর্থনৈতিক আর পাওয়ার স্ট্রাগলের।
বুঝিয়ে বলি?
এক মা তাঁর সন্তানকে রাত জেগে, খেয়ে না খেয়ে বড় করেন। সন্তানের লিটারেলি প্রথম প্রেম তিনি—যেভাবেই বলুন না কেন, কথা সত্য। আবার মায়েরও বুক নিংড়ানো ভালোবাসা পেয়েই সে বড় হয়।
অর্থনৈতিক ব্যাকবোন বেশির ভাগের খারাপ, স্বামীদের বঞ্চনা তো থাকেই, সঙ্গে ভবিষ্যতের ব্যাংক, নিরাপদ আশ্রয় হিসেবে এই মায়েরা সন্তান বড় করেন। ইমোশনাল অ্যাটাচমেন্ট থাকে। ভয় থাকে অ্যাবানডনমেন্টের—যদি এই ছেলে ভবিষ্যতে খেতে না দেয়, থাকতে না দেয়, ভাইবোনকে আগের মতো যত্ন না করে? মানসিক অস্থিরতা কিন্তু ভীষণ, মানুন আর না মানুন।
এসব নারী অবহেলিত, অবাঞ্ছিত, নির্যাতিত, নিপীড়িত সারা জীবন। খাওয়া–পরা, থাকার অর্থনৈতিক বৈষম্য দেখে এসেছেন সারা জীবন। তা তাঁর বাবার, স্বামী–শ্বশুর বা ভাইবোন বা সন্তানের পরিবারের—যে কারও পরিবারেই হয়তো বৈষম্যের স্বীকার হয়ে এসেছেন। তাঁরা সেই পরিবেশে ফেরত যেতে চান না, সেম কন্ডিশন রি–এক্সপেরিয়েনস করতে চান না।
তারপর আসে পাওয়ার স্ট্রাগল। এত দিন খেয়েপরে যেভাবেই সময় পার করে আসুন, তত দিনে তাঁর একটি অবস্থান তৈরি হয়েছে, সেটা হারানো? ছেলে কথা শুনবে না? রান্নায় আজ কী হবে, সেটা ঠিক করবে নতুন মানুষ? বাসার পরিবেশ বদলাতে চাইবে নতুন একটি মানুষ এসেই, সেটা কে সহ্য করে? কার ফ্যামিলি মানতে চাইবে?
মা–ছেলের ভালোবাসা কমে যায়। নতুন মেয়েটির সঙ্গে ঘণ্টার পর ঘণ্টা খুনসুটি, সময় কাটানো, দরজার আগল দেওয়া—অ্যাকসেস কমে যায় নিজের সন্তানের কাছেই। ভালোবাসা বাঁটোয়ারা হয়ে যায়। ছেলে আর তেমন সময় পায় না মায়ের কাছে বসার, মা ভাবে ছেলে পর হয়ে গেল—স্বাভাবিক!
নতুন মেয়েটিকেও মেনে নিতে সময় লাগে। ভিন্ন পরিবেশ থেকে এসেছে সন্তানের সঙ্গী; সন্তান তার পেছনে, শ্রম, ভালোবাসা, সময়, অর্থ ব্যয় করবে; তার সুখ–অসুখের খোঁজ রাখবে—খুশি হওয়ার বদলে প্রতিদ্বন্দ্বিতা শুরু হয়ে যায়।
তার আচার–আচরণ, খাদ্যাভ্যাস, রুটিন ভিন্ন; অ্যাডজাস্ট করারও ব্যাপার আছে। এমন নয় যে আমরা লিভ টুগেদার করা সমাজ, মেয়েটিকে বউ করার আগে বছরের পর বছর ধরে চিনি। হ্যাঁ প্রেম, ভালোবাসা হচ্ছে এখন অনেক; তবে তারা প্রাত্যহিক জীবনযাপনে গিভ–টেক, সমঝোতায় অভ্যস্ত নয়। না ভাই, লিভ টুগেদারকে উৎসাহিত করছি না, সত্যটা জানাচ্ছি।
কেউ ভোরে ওঠে, কেউ রাত জাগে, কেউ চা, কেউ কফি, কেউ রুটি, কেউ পরোটা, কেউ খিচুড়ি–ভাত, কেউ সাতসকালেই মোরগ পোলাও, বিরিয়ানি বা আমার শ্বশুরবাড়ির মতো কালাইরুটি খেয়ে অভ্যস্ত—কেউ এগুলোর একটিও সহ্য করতে পারে না।
কেউ মাছে ঝোল খায়, কেউ ভুনা—খাওয়াদাওয়া একটি বিশাল জায়গা দখল করে আমাদের জীবনে; সে অভ্যাস বদল করা এত সহজ নয়। দ্বন্দ্ব লাগবেই—যদি শ্বশুরের বাড়ি আর বউয়ের খাদ্যাভ্যাসে পার্থক্য থাকে। অ্যাডজাস্ট করার মানসিকতা সবার থাকে না। সে মায়ের হতে পারে, ছেলের বা বউটিরই।
আর এদের যদি মানসিক সমস্যা থাকে, তাহলে তার ব্যাপ্তি কেমন হতে পারে; ভেবে নিন। আমাদের সমাজে আবার কারও কোনো মানসিক সমস্যা থাকে না; কারও সুচিবায়ুগ্রস্ততা, অ্যাংজাইটি, ডিপ্রেশন, বাইপোলার সমস্যা তো থাকেই না; সঙ্গে হিংসা, বিদ্বেষ, অ্যাঙ্গার কন্ট্রোলের সমস্যা, কথা লাগানো, কূটকাচালি করার স্বভাব, লোভ—না, না, এগুলো আবার কী! এরা আবার থাকে নাকি মা, ছেলে বা বউটির মনে? বা তাদের পরিবারের মধ্যে? মানিয়ে নিলেই হয়।
প্রথম তো স্বীকার করতে হবে—এসব সমস্যা এগজিস্ট করে!!
আর যে বয়সে বিয়ে হয়, এসব সমস্যা তারপরই প্রকাশ পায়। কারণ, ওই যে স্ট্রেস! শিক্ষা, দেখে শেখা—মেয়েদের পুতুল করে মানুষ করা আর ছেলেদের ঠুঁটো জগন্নাথ! কেউ কোনো কাজের না, সোশ্যাল স্কিল, কমিউনিকেশনের স্কিল—ইনফিরিওরিটি বা সুপিরিওরিটি কমপ্লেক্স! লাইফ ইজ টাফ!
মা ইমোশনাল ব্ল্যাকমেল করেন, বউও করে। আবার ছেলেও গাধা, যেহেতু ম্যাচিউরিটি নেই; বউকে, মাকে—কাউকে বোঝানোর স্কিল নেই; নিজেরই স্কিল নেই, কী করবে? মেজাজ! মেজাজ করে।
বউকে বলে, আমার মা এত পুতুল করে, ভালোবাসায় বড় করেছে, মাকে কিছু বলবা না, যা বলে শুনবা। ভালো–মন্দ, অন্যায় যা–ই হোক কোনো কথা বলবা না।
বউ রেগে টং—বানে ভেসে এসেছি? তামাশা করো? আমি পুতুল হয়ে বড় হয়েছি, ভুলে গেছ? বান্দি বানাইতে আনছ? শখ, আহ্লাদ? কেমন জামাই? মন বোঝে না! আসলেই বোঝে না! আপনিও ইমম্যাচিউর!
দুটো ভিন্ন পরিবেশ থেকে এসে অ্যাডজাস্ট করার চেষ্টার আগেই ঝগড়া!
সঙ্গে থাকে ইদানীং পড়াশোনা, ক্যারিয়ার, সংসারের রান্না, কাজ—ভাই রে, সংসারটা আপনার, খালি জামাইয়ের সঙ্গে রোমান্টিক কথা বলাই সংসার নয়! দায়িত্ব সবটুকুই আপনারও। ম্যানেজ করতে খাবি খাচ্ছেন? স্বাভাবিক!
সমস্যা আপনারও। আবার সমাজেরও। এমন মগজ ধোলাই করা যেন বিয়েটা পবিত্র সম্পর্ক, রোমান্টিক সম্পর্ক; তার যে হাজারো দায়িত্ব—এগুলো কেউ বলে না। ভাবে, শিখে নেবে; কাউন্সেলিং বলে কিছু নেই।
যেমন আমরা সবাই ভাবি, বাচ্চারা কী সুন্দর, খেলার পুতুল, সংসার সুখী হয় বাচ্চা হলেই। জামাই মনোযোগ দেয় সংসারে!
—ভুল তথ্য!
বাচ্চা হওয়ার আগে ওই রোমান্সটুকুই হয়তো সুন্দর ছিল। ৪০ সপ্তাহে শরীরের ওপর কী যায়, না গেলে কেউ বোঝে না। বাপ, মা, শ্বশুর, শাশুড়ির কথায় বা নিজেরাই বাচ্চার জন্য পাগল হয়ে যান, বোঝার আগেই কি চাইছেন!
প্রেগন্যান্সি তো ব্লার হয়ে যায়, বাচ্চাটা হওয়ার পরপরই না খাওয়া, না ঘুমানো আর স্বামীর দূরত্ব মাত্র শুরু হয়!
জীবন ফেইরিটেলের লাইফ?
যেমন সিনেমায় দেখায়—প্রেগন্যান্সি পিরিয়ডে গান গাইতে গাইতে, গান শেষ হওয়ার আগেই স্বামী জড়িয়ে আদরে মাখামাখি করবে, আর ছেলে বা মেয়ে কলেজ শুরু করবে? এত সহজ?
কী যে ভয়ানক হোঁচট খায় মেয়েগুলো, সঙ্গে তাদের স্বামীগুলো বাচ্চা হওয়ার পরে।
—ভালোবাসা??
অবশ্যই কমে। ডিসপ্লেড হয়। স্বামীর পরকীয়া হয়। কারণ, সে আপনাকে পায় না। আপনি খিটমিট করেন। কারণ, স্বামী আর আগের মতো যত্ন নেয় না! স্বামী সেই খিটিমিটিতে আরও দূরে যায়। কেউ কেউ কাজের লোকের সঙ্গেই শোয়, কেউবা নতুন কারও সঙ্গে! খারাপ কথা বলছি? মাত্র তো শুরু! আচ্ছা বাদ দিই।
এখানেও কমিউনিকেশনের অভাব!
আমরা হতাশ—সংসারে জান দিয়ে দিলাম, জামাই/বউ পরকীয়ায় গেল? লাভ নেই, কমিউনিকেশনের স্কিল না বাড়ালে। ন্যাগ করেও লাভ নেই। দেখা যায়, এই কমিউনিকেশনের স্কিলের অভাবে সংসার তো ভাঙেই, সঙ্গে বাপ–মায়ের আদরবঞ্চিত হয় এত সাধের সন্তান!
সম্পর্ক ভাঙতেই পারে, সম্পর্ক ভঙ্গুর! সম্পর্ক লোহার হলেও মরিচা পড়ত, অবহেলায় ভাঙত। তাই বলে বাচ্চাদের মনেও বিষ না ঢুকিয়ে কাস্টডি ভাগ করে নেওয়াই যেত, বাচ্চাগুলো বাপ–মাদের অ্যাটলিস্ট আলাদা করে হলেও ভালোবাসতে পারত, ভাবত না তারা অবাঞ্ছিত।
কোথা থেকে কোথায় যাচ্ছি!
—ছোটবেলায় তসলিমা নাসরিনের ‘ছেলেবেলা’ পড়েছি। ভাবতাম, ও তো সব সত্যি কথা বলছে, মানুষ তা–ও কেন এত খ্যাপা?
—উত্তর এখন জানি।
—আমরা পুরুষতান্ত্রিক সমাজে রাঙতার মোড়কে সব আড়াল করতে পছন্দ করি।
মা তার সন্তান ছেড়ে বা খুন করে পরকীয়া করে? বা বাবাটিই? করে? সত্য হচ্ছে, করে।
ছেলে বা স্বামীটি ঘরে বউ রেখে অন্য মেয়ে—কাজের লোক হতে পারে, ভাবি হতে পারে, মামি হতে পারে, দশজন বান্ধবী হতে পারে, অন্যের বউ হতে পারে, দাদির বয়সী হতে পারে বা প্রস্টিটিউটই হতে পারে—তার সঙ্গে শোয়? অস্বাভাবিক ভাবছেন? প্লিজ মনে রাখুন, লাইফ ফেইরিটেল পারফেক্ট নয়। স্ক্রিপ্টেড নয়, মুখস্ত লাইন উগরে সমাজ–সংসার হয় না। আপনি কতটা সোশ্যালি স্কিলড, ম্যাচিউর বা আপনার পার্টনার কতটা ম্যাচিউর, তার ওপর নির্ভর করে আপনার চাওয়া ফেইরিটেল সংসার, স্বামী, শাশুড়ি! কিছু জিনিস ইগনোর করতে জানতে হয়, আবার প্রয়োজনমতো ট্যাক্টফুলি ম্যানেজও করতে জানতে হয়!
এগুলো সমাজে আছে ছিল, থাকবে। তবে রাবীন্দ্রিক সাহিত্যে না বলে স্থূল সত্যি কথায় বললে সবার গায়ে লাগে, যেমন তসলিমা বলেছেন। সমাজের রঙিন চশমার অন্তরালের গল্প! সবাই ছি ছি করে অস্বীকার করে, তারেই মারতে গেছে!
ভাবখানা যেন আমাদের সমাজে এমন হতেই পারে না! এত দিন লুতুপুতু গল্প সবাই লিখেছে, এ–ই ভালো।
সিনেমা, নাটকে প্রেমের ছড়াছড়ি। মানুষ তাই গিলে ফ্যান্টাসিতে ভোগে। রিকশাওয়ালা কোটিপতির একমাত্র শিক্ষিত মেয়ে বিয়ে করে! না না, পূতপবিত্র সমাজ; এখানে চাচারা–মামারা তাদের ভাতিজি–ভাগনিকে মলেস্ট করতেই পারে না। কাজিনেরা না ভাইবোন?
অনেক মেয়েকে দেখেছি, শাশুড়ি তাদের ভালোবাসলেও জ্বলে—কেন খবর নেয়, খাইছ নাকি জিজ্ঞেস করে? গিফট দিলেও মনে হয় কেন দিল? বা আরও দামি দিল না কেন? কেন আজকে মাছই রাঁধতে হবে বা মাংস বলে কান্নাকাটি করে। বা শাশুড়ি তারে রাঁধতে দেয় না, মাছের বা মাংসের বড় টুকরা তারে কেন দিল না বলে মন খারাপ করে। সমস্যা সবার মনেই। ছেলেও অনেক সময় চোখ বন্ধ করে মা বা বউয়ের পক্ষ নেয় বা বিপক্ষে অবস্থান করে। অথচ মা ও বউয়ের অবস্থান ভিন্ন। রেসপনসিবল ছেলেদের বিয়ে করে আলাদা থাকার বিকল্প নেই। কারণ, পরের মেয়েটির তার সংসারের নাটকে ঢোকার কোনোই দরকার নেই।
আমার ছেলেকে যে আমার ঘরে বউ নিয়ে জায়গা দেব না, বুঝতে পারছেন নিশ্চয়ই। ও–ও ছোটবেলা থেকে থাকার জায়গা ঠিক করে বেড়াচ্ছে। কারণ, বড় হলে তারে আমরা জায়গা দেব আর সে তার জন্য অপেক্ষায় থাকবে—সে শিক্ষাই তাকে দিচ্ছি না। ছেলেকে মানুষ করে নিজ পায়ে দাঁড়াতে দিন আর বিয়ের পর তাদের নিজেদের সংসার আলাদা করে দেওয়াই মনে হয় এ সমস্যা উত্তরণের একমাত্র পথ। ছেলেটিকে এমনভাবে গড়ে তুলুন, যাতে সে মা ও বউয়ের ব্যালান্স করে দুজনকেই সম্মানের সঙ্গে দেখে রাখতে পারে। প্রতিটি সম্পর্কই হোক সম্মানের।
*লেখক: চিকিৎসক