বইমেলায় ডায়াসপোরা সাহিত্যিক

এ বছরের অমর একুশে বইমেলা নিয়ে কিছু লিখব ভাবতে ভাবতেই মেলার বেশ কয়েকটি দিন পার হয়ে গেল। এবার নির্ধারিত তারিখে অর্থাৎ ১ ফেব্রুয়ারি মেলা শুরু হয়নি। কারণ সেদিন ঢাকা সিটি করপোরেশনের নির্বাচন ছিল। মেলার শুরুতে আমার নিজেরও মেলায় যাওয়ার সুযোগ হয়নি। সুতরাং মেলায় আমার প্রথম দিন ছিল ১১ ফেব্রুয়ারি, মেলার দশম দিনে। আমার নিজের আবর্তন নামের বইটি প্রকাশিত হয়েছে শব্দশৈলী প্রকাশনী থেকে। আমার প্রকাশক বললেন, ‘আপু, লেখক নিজে স্টলে থাকলে পাঠকেরা আনন্দিত হয়। নইলে বইগুলোও এতিমের মতো পড়ে থাকে। মেলায় এসে স্টলে বসার চেষ্টা করবেন।’ কিন্তু মন চাইলেও সব সময় তা আর হয়ে ওঠে না।
বাংলাদেশের এবারের একুশে বইমেলার আনন্দ ও উৎসবের ঢেউ যেন আমাদের নিউইয়র্কের ইস্টরিভার ও হাডসনের পাড়ে এসে ধাক্কা খাচ্ছে। যদিও আমি এখন আটলান্টিকের এপারে। তবে ওপারের সব খবরই আমার নখদর্পণে। নিউইয়র্কের সুবাস, খবরাখবর নিয়ে আমাদের ডায়াসপোরা অনেক লেখক, কবি, চিত্রশিল্পী এসে জড়ো হয়েছেন মেলা প্রাঙ্গণে। তাঁরা সগর্বে তুলে ধরেছেন তাদের ডায়াসপোরা সাহিত্যকে।
প্রতিদিনই ফেসবুকের পাতায় প্রবাসী লেখকদের নতুন বই নিয়ে লেখক–প্রকাশকদের পোস্ট দেখতে পাচ্ছি। তাতে রয়েছে বইয়ের খবরাখবরসহ নানারকম মনোহারী প্রচ্ছদের ছড়াছড়ি। প্রতি বছরের মতো এ বছরও আমেরিকা থেকে বেশ কিছু নতুন ও গুরুত্বপূর্ণ বই প্রকাশিত হয়েছে। মেলায় অনেক লেখকের বই পেয়েছি। এই নামের তালিকা হয়তো আরও দীর্ঘ হতে পারে। মেলায় যাঁদের বই পেয়েছি আকবর হায়দার কিরণের জ্যাকসন হাইটস জার্নাল; আলম সিদ্দিকীর নামকাব্য ৩; শামস আল মমীনের অনেক রাত জেগে থাকার পর; ফকির ইলিয়াসের ধানমন্ডির ধ্বনিপুত্র; ড. ‍নূরুন নবীর দুটি বই বাংলাদেশে পাকিস্তানি যুদ্ধাপরাধ ও প্রেসিডেন্ট নিক্সন–ড.কিসিঞ্জারের দায়, অনিবার্য মুক্তিযুদ্ধ; তমিজ উদ্দীন লোদীর নির্বাচিত গল্প; মনজুর আহমেদের আরও কথা মুক্তিযুদ্ধের; ডা. ফারুক আজমের তাঁদের চলে যাওয়ার গল্প; ফারুক ফয়সল সম্পাদিত কালের অমৃতধারা; কাজী জহিরুল ইসলামের কবিতাসমগ্র-৩ ও জলঘড়ি(শিশুতোষ গ্রন্থ); স্মৃতি ভদ্রের পার্পল জলফড়িং; মনিজা রহমানের আকাশরেখার সীমানায়, ড. রাজুব ভৌমিকের ফ্যান্টাসি থ্রিলার শশীকাহন ও সাইকোলজিক্যাল থ্রিলার টেম্পু পাশা নাইট সিফট; রওশন হকের সীমান্তের ট্রেন; তামান্না ইসলামের সর্বজায়া; আদনান সৈয়দের শিপ জাম্পার: বাঙালির আমেরিকা যাত্রা; আলী সিদ্দিকীর অন্ধশিকার; উইলি মুক্তির কাব্যগ্রন্থ জল পাথরের যুগলবন্দী; তানকিউল হাসানের কেচ্ছা; লিজি রহমানের ওহ্! আমেরিকা এবং রংধনুর দেশে; ফরহাদ হোসেনের তৃতীয় পক্ষ এবং ধূসর বসন্ত; মোস্তফা তানিমের রিংটোন, রংনাম্বার, এপসাইলন, ম্যাকগাইভার মাম, কালমায়ার সংকট ও হিপনোস।
আমার জানামতে এবার বইমেলাকে উপলক্ষ করেই বেশ কয়েকজন প্রবাসী দেশে এসেছেন। নিউইয়র্ক থেকে এসেছি আমি, রোকেয়া দীপা, ইশতিয়াক রূপু, ভায়লা সালিনা, আহমাদ মাযহার, কবি শামস আল মমীন, শামীম আল আমীন, মনজুর কাদের, রাগীব এহসান, লিজি রহমান, ফাহিম রেজা নুর, জাকিয়া ফাহিম, তানকিউল হাসান। নিউজার্সি থেকে ড. নূরুন নবী, টেনেসি থেকে সস্ত্রীক ড. হুমায়ুন কবীর, ডালাস থেকে ফরহাদ হোসেন ও রুবানা ফারাহ আদিবা, টরন্টো থেকে সালমা বাণী, ম্যানচেস্টার থেকে এসেছেন জেসমিন চৌধুরী ও ভারত থেকে অর্ঘ রায় চৌধুরী এসেছেন।
দশম দিনে মেলা প্রাঙ্গণ ছিল ছিমছাম, শান্ত ও নিরিবিলি। তবে মেলা প্রাঙ্গণ ঘুরে খানিকটা মন খারাপের সুর শোনা গেল। মেলায় লেখক ও প্রকাশকদের লক্ষ্য থাকে একটাই, তা হলো সর্বাধিক সংখ্যক বই বিক্রি করা। এটা তাদের রুটিরুজির সঙ্গে সম্পর্কিত। পাঠক বা বইপ্রেমীদের কাছে বইমেলা হলো তাদের আনন্দের উৎস। ইচ্ছেমতো ঘোরাঘুরি, বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে দেখা–সাক্ষাৎ, আড্ডা, আলাপচারিতা, বন্ধুবান্ধব ও লেখকদের সঙ্গে সেলফি তোলা, সাজগোজ, পছন্দমাফিক দু/চারটি বই কেনা ইত্যাদি।
এরপর আবার মেলায় গেলাম মেলার দ্বাদশ দিনে। ওই দিন মেলায় এসেছে ১৮০টি নতুন বই। কিন্তু বিভিন্ন প্রকাশনীর স্টল ঘুরে দেখা গেল, স্টলের কর্মী ও প্রকাশকদের যার যার ফোন হাতে স্ক্রল করতে। মেলায় ইতস্তত ঘুরে বেড়ানো দর্শনার্থী থাকলেও ক্রেতা খুব কম। তবে তুলনামূলকভাবে প্যাভিলিয়নগুলোর চিত্র বেশ ব্যতিক্রম।
কথা হলো ইত্যাদি প্রকাশনীর মালিক জহিরুল আবেদীনের সঙ্গে। তিনি মেলার পরিসর, স্টল সংখ্যা বাড়ানো নিয়ে তার মতামত জানালেন। মেলার আয়তন বাড়ানো, স্টল সংখ্যা বাড়ানোয় দীর্ঘদিন ধরে প্রকাশনার সঙ্গে জড়িতরা খুশি হতে পারছেন না। কারণ এর ফলে মেলার আয়তন বাড়া ছাড়া বইমেলার আর কোন অগ্রগতি হয়নি। স্টল বরাদ্দ সুবিন্যস্ত হয়নি বলেও অনেক প্রকাশক অভিযোগ করলেন। জহিরুল আবেদীন বললেন, ‘পনেরো দিনের বইমেলা এখন সময়ের দাবি!’ দীর্ঘ এক মাসের মেলায় শুধু খরচ বাড়া ছাড়া আর কোন উপকার হচ্ছে না।
হুমায়ূন কবীর অন্বয় প্রকাশের মালিক। কবি ও লেখক হিসেবেও তাঁর পরিচিত আছে। যিনি প্রায় প্রতিবছরই নিউইয়র্ক, ডিসি ও টরন্টো বইমেলায় অংশ নেন। এবার মেলায় এসেছে তার বিদেশ ভ্রমণ ও বিদেশি বইমেলায় অংশগ্রহণের গল্প নিয়ে বই ‘ব্রিজ টু কানাডা’। তার স্টলের সামনে বসেই আড্ডা হলো বেশ কিছুক্ষণ। আড্ডায় যোগ দিয়েছিলেন লেখক ইসহাক খান।
জানা গেল, দীর্ঘদিন ধরে প্রচলিত ক্যালেন্ডারে এই বছর পরিবর্তন এসেছে। তাই ১৩ ফেব্রুয়ারি বসন্ত উৎসব হচ্ছে না। ভালোবাসা দিবসের সঙ্গে মিতালি করে পয়লা ফাল্গুন আসবে একই দিনে। কিন্তু যারা বসন্ত ও ভালোবাসা দিবসের সাজসজ্জার জন্য দুটি দিনের আলাদা প্রস্তুতি রেখেছিল, তার নতুন ক্যালেন্ডারকে ভ্রুকুটি দেখিয়ে ১৩ ফেব্রুয়ারি বৃহস্পতিবারেই বসন্তবরণ করল। সেদিন হলুদ শাড়ির পাশাপাশি হলুদ পাঞ্জাবিরও কমতি ছিল না মেলায়।
১৪ ফেব্রুয়ারি। টিএসসির গেট পার হয়ে বাংলা একাডেমির পাশের ফুটপাথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে শোনা গেল এক ব্যাকুল কোকিলের ‘কুহু’ ‘কুহু’ ডাক। মেলায় আগত বসন্ত আর ভালোবাসা দিবসের বিপুল জনস্রোতকে উপেক্ষা করেই কোন একটি অজানা গাছের ডালে বসে উদাসী দুপুরকে আরও উদাস করে তুলছিল এই প্রলাপী কোকিলের ডাক। বসন্ত এসে গেছে। তার দেহ, মন আর প্রাণে পৌঁছে গেছে সেই খবর। এখনই প্রণয়ের সময়। সে খুঁজে ফিরছে তার ভাবি প্রণয়িনী কোকিলাকে।
এবারের ১৪ ফেব্রুয়ারি দিনটিতে ঘটেছিল তিনের সমাহার। বসন্তবরণ, ভালোবাসা দিবস, সাপ্তাহিক ছুটির দিন। একেই হয়তো বলা যায় ত্রিসঙ্গম। তথ্যকেন্দ্রের হিসাব মতে, সেদিন মেলায় এসেছিল প্রায় ৩৬৯টি নতুন বই। মোড়ক উন্মোচন মঞ্চেও ছিল প্রচুর ভিড়। হাজার হাজার দর্শনার্থীর স্বতঃস্ফূর্ত আনন্দ-উল্লাসে মেলায় ছিল এক ভিন্নরূপ। উৎসবমুখর হলেও মেলা প্রাঙ্গণ হয়ে উঠেছিল ধূলিময়। ধুলোবালির সঙ্গে সম্প্রতি যোগ হয়েছে করোনা ভাইরাস ভীতি। তাই মেলা প্রাঙ্গণে মাস্কপরা দর্শনার্থীর সংখ্যাও ছিল প্রচুর। তবে বইপ্রেমীরা নতুন আমেজে বই কিনে আর আড্ডা দিয়ে পয়লা ফাগুনকে স্বাগত জানিয়েছে সেদিন। বিপুলসংখ্যক দর্শনার্থী লাইনে দাঁড়িয়ে মেলায় প্রবেশ করেছে। বিকেলের মধ্যে মেলায় মানুষের ঢল নামে। মেলার ভেতরে–বাইরে কোথাও তিলধারণের ঠাঁই ছিল না। শত শত মানুষ টিএসসি মোড় থেকে দোয়েল চত্বরের আইল্যান্ডে বসে অপেক্ষা করতে থাকে মেলায় প্রবেশের। সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ও বাংলা একাডেমির ভেতরে স্টলগুলোর সামনে যাওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। সব বয়সের মানুষই স্টলে বই পছন্দ করা ও কেনায় ব্যস্ত ছিল। প্রচণ্ড ভিড়ের কারণে অভিভাবকের সঙ্গে থাকা বেশ কয়েকটি বাচ্চা হারানোর সংবাদ মাইকে ঘোষণা করতে শোনা গেছে।
দেখা হয়েছে রেদোয়ান জুয়েলের সঙ্গে। তার নালন্দা প্যাভিলিয়নে। জুয়েল ভাই হাসিমুখ অভ্যর্থনা জানালেন। কুশলাদি বিনিময় হলো। ভাবলাম বেশ কিছুক্ষণ গল্প করব জুয়েল ভাইয়ের সঙ্গে। কিন্তু ক্রমেই তার প্যাভিলিয়নে বেচাকেনা জমে উঠল। ক্যাশবাক্সের দায়িত্বে থাকা জুয়েল ভাইও ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। অনুভব করলাম, এটা একজন প্রকাশকের জন্য পয়মন্ত মুহূর্ত। তার কাজে বাধা না হয়ে উঠে দাঁড়ালাম। একটা সেলফি তুলে সেখান থেকে বিদায় নিলাম।
দেখা করতে গেলাম কথা সাহিত্যিক আনিসুল হকের সঙ্গে। তাকে দেখা গেল প্রথমার স্টলে তাঁর নতুন প্রকাশিত ‘এখানে থেমো না’ উপন্যাসে সাক্ষর দিয়ে বইটি পাঠকদের হাতে তুলে দিতে। তাঁর সামনে বেশির ভাগই দেখা গেল কিশোর–কিশোরীদের জটলা। সম্ভবত দূর থেকে দেখে একসময় স্টল থেকে বেরিয়ে পাশে দাঁড়ালেন। হাসিমুখে বললেন, ‘শেলী ঢাকায় এসেছে এই খবর আমি ফেসবুকেই পেয়েছি।’ তখন আমার সঙ্গে ছিলেন নিউইয়র্কপ্রবাসী আবৃত্তিকার ও উপস্থাপক শামীম আল মামুন ও রোকেয়া দীপা। আনিসুল হক বললেন, এবারের বইমেলা ‘স্বপ্নের মতো সুন্দর’ বলে তিনি উল্লেখ করেন।
শব্দশৈলীর স্টলে গেলেই যাকে সব সময় স্টলের ভেতরে টুলে বসে হেসে হেসে কথা বলতে দেখা যায় তিনি হলেন ম্যানচেস্টারপ্রবাসী লেখক জেসমিন চৌধুরী। এবার মেলায় এসেছে তাঁর ‘মিসটেক’। সম্ভবত বইটিতে কথ্য ইংরেজির সাধারণ ভুলগুলো নিয়ে আলোচনা করেছেন লেখক।
শব্দশৈলীর প্রকাশক ইফতেখার আমীনকে তেমন খুশি মনে হলো না। শুরু থেকে এ পর্যন্ত বই বিক্রি ও স্টল বিন্যাস কোনটি নিয়েই তিনি তৃপ্ত নন। বইমেলার স্টল বিন্যাস নিয়ে কটাক্ষ করে তিনি তার টাইমলাইনে পোস্ট দিয়েছেন, ‘অসাধারণ স্টল বিন্যাস আর মৌসুমি প্রকাশনার ঠ্যালায় বিরাট মাঠের চিপায় পড়া নিয়মিত প্রকাশকেরা, ভালো আছেন তো?’
২০২০ বইমেলা প্রাঙ্গণটি এবার সাজানো হয়েছে একটু বৃহত্তর পরিসরে। স্টলের সংখ্যাও বরাবরের তুলনায় বেশি। অনেকের মতে, এবারের মেলা প্রাঙ্গণ অতীতের তুলনায় সুন্দরতম। সাড়ে আট লাখ বর্গফুট এলাকাজুড়ে এবারের মেলা। স্টল ও প্যাভিলিয়নের বিন্যাসও হয়েছে স্বচ্ছন্দে ঘোরাঘুরির মতো জায়গা ছেড়ে দিয়ে। মেলার অবকাঠামো এবার খুব সুন্দর হয়েছে সন্দেহ নেই।
অন্যপ্রকাশ তাদের প্যাভিলিয়ন সাজিয়েছে হুমায়ূন আহমেদের ছবি দিয়ে। পাঠক সমাবেশের ভেতরে ক্রেতা-পাঠকেরা দম ফেলার সময় পাচ্ছেন না। প্রথমা প্রকাশনের প্যাভিলিয়নটি বেশ ছিমছাম, সুন্দর। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের গাছতলা জুড়ে মেলার ছাউনি। মাঠের মাঝ বরাবর সব প্যাভিলিয়ন। সন্ধ্যাবেলায় বিশাল জলাধারের জলগুলো দক্ষিণা বাতাসে তিরতির করে কাঁপে। জলের ভেতরে তখন দীর্ঘ স্বাধীনতা স্তম্ভের ছায়া পড়ে। আর তার চারদিকে জ্বলজ্বল করতে থাকে সারি সারি বিজলি বাতি। লেখক আনিসুল হকের মতো আমারও বলতে ইচ্ছে করে, ‘এবারের বইমেলা সত্যিই স্বপ্নের চেয়েও সুন্দর।