বইমেলার কাছে প্রত্যাশা

মানুষের ভাবনার স্রোতোধারা কত গতিবেগে বিরামহীন বয়ে যেতে পারে, আবার টর্নেডোর আঘাতে বারবার ক্ষতবিক্ষত হয়েও আপন শক্তিতে অবিচল থাকতে পারে, তারই এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত নিউইয়র্কের বইমেলা। কঠোর সমালোচনা, নিন্দা ও তর্কবিতর্কের তুমুল ঝোড়ো হওয়ার ১০ নম্বর সতর্ক সংকেত উপেক্ষা করে তিন দশকের দোরগোড়ায় বইমেলার পৌঁছে যাওয়া এক অবিশ্বাস্য ঘটনা।
একুশ উদ্‌যাপন ও বইমেলার যাত্রা শুরু হাত ধরাধরি করেই। সময় ১৯৯২ সাল, সেই সময়টি উত্তর আমেরিকায় বাঙালি জাতিগোষ্ঠীর উন্মেষ ঘটার সূচনালগ্ন। একুশ উদ্‌যাপনের চিন্তা ছিল অনেকের, করেছেনও তা। কিন্তু বইমেলার আয়োজন ছিল অকল্পনীয়। মুক্তধারার এই আয়োজনের ব্যাপারে অনেকেই ছিলেন সন্দিগ্ধ। অথচ আজকের বাস্তবতায় দাঁড়িয়ে বলতে হয়, ৩ ঘণ্টার সেই বইমেলা আজ তিন দিনের বইমেলায় পরিণত হয়েছে। শুধু তাই নয়, প্রতি বছরই দর্শনার্থীদের স্থান সংকুলান, অনুষ্ঠানাদির পরিধি ও পরিসরের বিস্তৃতি এবং প্রকাশকদের চাহিদা পূরণে মুক্তধারার হিমশিম অবস্থা।
গত তিন দশকে প্রবাসে গড়ে ওঠা বাংলা কমিউনিটির চিন্তা-চেতনা ও মননে বইমেলা স্থান করে নিয়েছে, অন্যদিকে গভীর ছায়া বিস্তার করেছে অতি সংগোপনে। এ কথা অনস্বীকার্য সত্য।
বইমেলার অর্জন সংখ্যাতীত, যার অনেকটাই রয়ে গেছে দৃষ্টির অন্তরালে। রয়েছে নানা ধরনের ব্যতিক্রমী উদ্যোগ। বিশ্বসভার সদর দপ্তরের সামনে একুশ উদ্‌যাপনের চিন্তার ক্ষেত্রেও রয়েছে ভিন্নতা। দুই বাংলার লেখক, সাহিত্যিক, শিল্পী ও প্রকাশকদের বই মেলায় সমভাবে অংশগ্রহণ ও অংশীদারত্বে পরিণত করার ক্ষেত্রেও রয়েছে ভিন্ন চিন্তার এক অনন্য দৃষ্টান্ত। সীমান্তরেখা মুছে, প্রাচীর ভেঙে গুঁড়িয়ে নিউইয়র্ক বইমেলার অন্যান্য দেশের অভিবাসী বাঙালির প্রাণের মেলায় পরিণত হওয়ার বিষয়টিও আরেক বিস্ময়। এ যেন এক নীরব বিপ্লবের ইঙ্গিত বহন করে, যাকে কোনোভাবেই খাটো করে দেখার অবকাশ নেই। ইতিহাসের মূল্য বিচারে এর অবদান নিশ্চিতভাবেই বহুদূর বিস্তৃত। পাঁচ বাঙালির উপস্থিতিতে যেখানে একাধিক দল, সংগঠন, মেলা, সম্মেলন, আড্ডার আসর প্রতিনিয়ত ভেঙে খণ্ড-বিখণ্ড হয়ে যাচ্ছে, অনেক সময় যাকে বাঙালি চরিত্রের বৈশিষ্ট্য বলে নিন্দা করা হয়ে থাকে—এমন সব নিন্দাকেও পরাভূত করে মুক্তধারা অপ্রতিরোধ্য গতিতে এগিয়ে চলছে।
১৯৯২ সাল থেকে বইমেলার পথচলার শুরু হলেও আমার সম্পৃক্ততা ১৯৯৪ সাল থেকে। সাত বছরের ছোট্ট মেয়ের হাত ধরে অ্যাস্টোরিয়ার পিএস-১৭-এ আয়োজিত বই মেলায় গিয়েছিলাম। নতুন অভিবাসী হিসেবে এক বুক কান্না নিয়ে হাজির হওয়া বই মেলায়, চিরচেনা মুখ খুঁজে না পাওয়ার বেদনা। বইমেলা ছিল না হাজারো দর্শকের উপস্থিতিতে সরগরম। চোখে পড়েনি রাশি রাশি বইয়ের স্টল। পছন্দের বই কিনে কোনো পাঠকের হাত ভারী হয়ে উঠতে দেখা যায়নি। চারদিকে ছড়িয়ে–ছিটিয়ে থাকা দর্শনার্থী। কেউ কেউ ভিড় করছেন মুক্তধারার বইয়ের স্টলে। তৃতীয় এই বইমেলার উদ্বোধক ছিলেন বাংলাদেশের খ্যাতিমান লেখক ড. জাফর ইকবাল। তবে সেবারই প্রথম সেখানে বাংলাদেশ থেকে আগামী প্রকাশনীর কর্ণধার গনি ভাই এসেছিলেন। তিনি ছিলেন আমার পূর্ব পরিচিত। তাঁকে পেয়ে যে কী আনন্দ!
আপনজনের দেখা পেয়ে দুচোখ জলে ভরে যায়। সেদিন ছিল না উপচে পড়া দর্শনার্থী–পাঠক, নাইবা থাকল বইয়ের বিপুল সমাহার। তবুওতো বইমেলা। আমার জন্য তা পরম প্রাপ্তি। মেলা প্রাঙ্গণে পৌঁছতেই বুকের গভীরে এক ধরনের শিহরণ জাগে, যা এত বছর পরে আজও মনে হলে শিহরিত হই। সে অনুভূতি কেবলই অনুভবের, উপলব্ধির, প্রকাশের নয়।
নতুন প্রজন্মের হাতে আগামীর মশাল তুলে দিয়ে দুই বছর আগে এক নজিরবিহীন দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে নিউইয়র্ক বইমেলা। নেতৃত্ব ও দায়িত্ব ছেড়ে দেওয়ার মানসিকতা দুর্লভ। নেতৃত্ব ছেড়ে দেওয়া বা নতুন প্রজন্মের হাতে তুলে দেওয়ার কোনো উদাহরণ আমাদের কাছে–পিঠে আছে বলে আমার অন্তত জানা নেই। মুখে অনেক কথা বলা হয়ে থাকে। নতুন প্রজন্মকে সামনে রেখেই চলে বিশাল লক্ষ্য অর্জনের কর্মযজ্ঞ। কিন্তু নেতৃত্বের জায়গাটি আগলে রাখা হয় পরম যত্নে। এ ব্যাপারে সবাই আপসহীন।
দেশের সুশীল সমাজ ও শীর্ষ এনজিওগুলোর কথা মনে পড়ে গেল। প্রতিদিন, প্রতিনিয়ত তাঁরা রাজনৈতিক দলের ভেতর গণতন্ত্র চর্চার অভাব দেখতে পান এবং নিন্দায় মুখর থাকেন। কিন্তু তারা এক–একজন এক–একটি সংস্থার নির্বাহী প্রধানের পদটি দখল করে থাকেন অনন্তকাল, এ যেন আজীবন সদস্যপদ লাভের মতো। রাজনীতিবিদদের সম্পদের ব্যাপারেও তাদের কণ্ঠ উচ্চকিত। কিন্তু তাদের সম্পদের হিসাব প্রদান সংক্রান্ত সরকারি উদ্যোগের বিরোধিতায় তারা ততটাই সোচ্চার। প্রবাসেও এমন দৃষ্টান্তের ঘাটতি রয়েছে বলে মনে করার কোনো কারণ নেই। সে ক্ষেত্রে বইমেলার এই উদ্যোগ নিঃসন্দেহে মহতী এক উদ্যোগ। নতুন প্রজন্ম তাদের সবটুকু ঢেলে দিয়ে নিজেদের যোগ্যতা, দক্ষতা ও সৃজনীশক্তি প্রমাণ করে বইমেলার মুখ উজ্জ্বলতর করেছে। এখানেও বইমেলা ব্যতিক্রমী চিন্তার বহিঃপ্রকাশ। ভবিষ্যতে নতুন কিছু প্রত্যাশা বইমেলার কাছে। প্রত্যাশা বইমেলার অন্যতম উদ্যোক্তা বিশ্বজিত সাহার কাছে। জয়তু বইমেলা!