ফেসবুকে প্রতিবাদ কতটা কার্যকর হবে

ফেসবুকের অসংখ্য প্রোফাইল পিকচার বিশেষত নারীদের আইডি কালো হয়ে আছে। কেন এমন হচ্ছে? বিশেষ করে নারীদের ক্ষেত্রেই এমনটা হয়েছে কেন? আপনার বন্ধু, আত্মীয়, সহকর্মী অনেকেই আজ নিজের ঝকঝকে প্রোফাইল পিকচার ঢেকে ফেলেছে কালো রঙে৷ সবাই নিজের প্রোফাইল কালো করে দিন, এমন বক্তব্যও ছড়িয়ে পড়ছে৷ একটু খেয়াল করলে বোঝা যাবে, এটি এক ধরনের প্রতিবাদ৷ দেশে একের পর এক ঘটে চলা নারী নির্যাতনের প্রতিবাদেই এমন প্রচার।

সমস্যার গোড়ায় হাত দেওয়া চাই। নিজেদের সুরক্ষার কথা ভেবেই প্রোফাইল কালো করার মধ্য দিয়ে সেই প্রতিবাদ আর স্লোগানে শামিল হচ্ছেন হাজারো নারী। ঘরে বসে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এমন প্রতিবাদে শামিলের সংখ্যা নেহাতই কম নয়৷ ডিজিটাল মাধ্যম হওয়ায় তা ছড়িয়েছে দেশে-বিদেশের নানা প্রান্তে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক ফিড ছেয়ে গেছে কালো রঙের প্রোফাইল ছবিতে। নারীদের নির্দিষ্ট সময়জুড়ে ফেসবুকের প্রোফাইলে নিজের নির্বাচিত ছবির জায়গায় কালো রঙের ছবি রাখার আহ্বান জানিয়ে ৬ অক্টোবর ফেসবুক ব্যবহারকারীদের ইনবক্সে পাঠানো হয় ইংরেজি একটি বার্তা। এটি ছিল এমন—‘কাল, নারী ব্ল্যাকআউট চলবে সকাল ৮টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত। নারী ছাড়া বিশ্বকে কেমন দেখায়, সেটি বোঝাতেই এই আন্দোলন। আপনার প্রোফাইল ছবি কালো বর্গাকৃতির করে দিন, যাতে পুরুষ চমকে ওঠে এই ভেবে যে, নারীরা গেল কোথায়। এই বার্তা শুধু নারীদের পাঠান, এটা পারিবারিক নির্যাতনের বিরুদ্ধে একটি পদক্ষেপ। এটা মজা করার বিষয় নয়। ছড়িয়ে দিন।’

সংহতি প্রকাশের লক্ষ্যে এই আন্দোলন নারীদের একত্রিত করার ইচ্ছে থেকে শুরু করা হয়েছে। ফেসবুকে নারীরা অন্য নারীদের প্রতিবাদে যোগ দিতে উৎসাহ দিতে মেসেজ পাঠিয়ে আসছে। সিলেটে লোমহর্ষক গণধর্ষণের ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতেই নোয়াখালীতে এক নারীকে বিবস্ত্র করে ভিডিও ছড়িয়ে দেওয়ার খবর প্রকাশের পর বর্বর নির্যাতনের ভিডিও ভাইরালের পর ক্ষোভে ফুঁসছে বাংলাদেশ। নারী নির্যাতনের প্রতিবাদ হিসেবে অনেকেই এই ব্ল্যাকআউট উদ্যোগে অংশ নিয়েছেন। রাজপথের মতো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও প্রতিবাদে মুখর লাখো মানুষ। স্লোগান উঠেছে সবখানে। ধর্ষকদের বিচার চাই।

নারীদের সঙ্গে অনেক পুরুষ ফেসবুক ব্যবহারকারীও এই প্রতিবাদ কর্মসূচিতে যোগ দিয়েছেন। অস্ট্রেলিয়ার নিউক্যাসল বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি ক্যান্ডিডেট সাবরিনা সৈয়দ (সেঁজুতি) তার প্রোফাইল পিকচার কালো করে ইংরেজিতে লিখেছেন, ‘বাংলাদেশে নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোল।’

সাংবাদিক মারিয়া সালাম এই ভিন্নধর্মী প্রতিবাদের পক্ষ নিয়ে ফেসবুকে লিখেছেন, ‘সারা দেশে নারীদের প্রতি যে সহিংসতা, তার প্রতিবাদেই আজ নারীরা একটা দিন নিজেদের প্রোফাইল ছবি কালো রাখবেন। এতে তেমন কোনো লাভ হবে না। এটি আপাতদৃষ্টিতে মনে হলেও সামান্য হলেও লাভ আছে, ক্ষতি নেই। আজ ফেসবুকে সব মেয়েরা কই, এই প্রশ্নের উত্তর কোনো ছেলেই খুঁজবে না। বরং অনেকেই মুখ টিপে হাসবে, অফিসে টিপ্পনী কাটবে। আবার অনেকেই বলবে, এসবে কাজ হবে না, আপনারা ভালো হয়ে যান, সব ঠিক হয়ে যাবে, আপনি ভালোতো সব ভালো। এগুলো শুনে গায়ে জ্বালা হবে, চোখে পানি আসবে, আবার ক্ষেপে গিয়ে আমরা তর্ক করব। এই এত কিছুর পরেও, আমরা যে তর্ক করব, প্রোপিক চেঞ্জ করব না, সারা দিন সেটা কালো রাখব, সেখানেই আছে আমাদের টিকে থাকার মন্ত্র।’

মারিয়া সালাম আরও লিখেন, ‘আমাদের অনেক বন্ধু, ভাই এসে আমাদের এই কালো ছবিতেও লাইক দেবে, কমেন্ট লিখবে, আপনারা এগিয়ে যান, আমরা আছি সঙ্গে। এখানেই আমরা নতুন করে চলার অনুপ্রেরণা পাব। সব প্রতিবাদেরই একটা শক্তি আছে। কোনো প্রতিবাদকেই খাটো করে দেখার সুযোগ নেই।’ তবে তিনি এও লিখেছেন, ‘দিনে দিনে আমরা যেদিকে যাচ্ছি, এই সব নিরীহ প্রতিবাদের পাশাপাশি কার্যকর পদক্ষেপ না নিলে নারীর প্রতি সহিংসতা টেবিলে আলোচনার বিষয় হয়েই রয়ে যাবে।’

এ রকম প্রতিবাদের সঙ্গে ভিন্নমত পোষণ করে অস্ট্রেলিয়াপ্রবাসী ফারিয়া লোবা লিখেছেন, ‘অপরাধ কি আমার? আমিতো উজ্জ্বলতর হতে চাই! আমাকে কেন অদৃশ্য হতে হবে! আমাকে কেন অন্ধকারে হারিয়ে যেতে হবে?’

রাজধানীর একটি ইংরেজি স্কুলের শিক্ষক মিঠুন সুলতানা লিখেছেন, ‘প্রোফাইল পিকচার কালো! কিউট অ্যান্ড লাভলি প্রতিবাদ! এরপরের প্রোফাইল পিক হবে আবারও সুইট অ্যান্ড ফেয়ার অ্যান্ড লাভলি!’

এভাবেই এ রকম প্রতিবাদের পাল্টা মতও ঘুরছে ফেসবুকে। তাদের প্রশ্ন—শুধু প্রোফাইল পিকচার কালো করেই কি দেশের মেয়েদের সুরক্ষা দেওয়া যাবে? নাকি এর জন্য গড়তে হবে আরও বড় কোনো আন্দোলন?