ফেব্রুয়ারি: আনন্দ বেদনার কাব্য
প্রতিবছর এমনি করে, ক্যালেন্ডারের নিয়ম মেনে ফেব্রুয়ারি আসে। আমরা নানা উৎসবে রঙিন হয়ে উঠি। ফেব্রুয়ারির ঠিক প্রথম দিনটিতে শুরু হয়ে যায় বাংলা একাডেমির অমর একুশে গ্রন্থমেলা। চারদিকে বসন্তের ফাগুন হাওয়ার সঙ্গে যোগ হয় আনকোরা নতুন বই আর সুবাসিত তাজা ফুলের গন্ধ। বাংলা একাডেমির সামনের সড়কটির দুপাশের প্রাচীন গাছগুলোর ধূলিমাখা সবুজ পাতার আড়ালে বসে, থেকে থেকে ডেকে ওঠে বসন্তের বিরহী কোকিল। তার সুরেলা ডাকে হয়তো কাছে আসবে কোনো প্রেমিক কোকিলা। তাই সে তন্ময় হয়ে সুর তোলে। এমন আনন্দময় সময়ে আমরা একরকম ভুলে থাকি শহীদদের রক্তের লোনা, স্বেদ গন্ধ। ভুলে থাকি হুমায়ূন আজাদ, অভিজিৎ রায় আর দীপনদের কথা। যারা একসময় অমর একুশে বইমেলার ধূলিময় প্রান্তরে প্রাণসঞ্চার করতেন।
২৫ ফেব্রুয়ারি। এই দিনে ঘটেছিল সেই লোমহর্ষক পিলখানা হত্যাকাণ্ড। আজ সকালে ঘুম ভাঙার পরপরই প্রতিদিনের অভ্যাসগতভাবেই নিউজফিডে চোখ বুলিয়ে নিচ্ছিলাম। বন্ধুদের অনেকেরই টাইমলাইনে, লেখালেখির গ্রুপে লেখকদের বিষাদমাখা পঙ্ক্তিমালায় চোখ আটকে গেল। কান্না ভেজা সেই সব শব্দ, বাক্য, স্মৃতিচারণগুলো না পড়ে ওঠার মতো শক্তি ছিল না। বুকটা বরাবরের মতোই আরও একবার কেঁপে কেঁপে উঠল!
আমার প্রজন্মের অনেকেই বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন দেখেননি। আমরা বড় হয়েছি সেই আন্দোলনের, রক্তপাতের কাহিনি শুনে, ইতিহাস পড়ে। আমি আমার শৈশবে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ দেখেছি। সেই ভয়াবহ, বীভৎস স্মৃতি এখনো আমাকে তাড়িত করে।
২০০৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারির পিলখানা হত্যাযজ্ঞের সময় দেশে ছিলাম না। অনেকের কাছেই সেই দিনটির কাহিনি শুনেছি। নানাজন নানাভাবে তাদের নিজেদের দেখা ও অন্যের কাছ থেকে শোনা ঘটনার বর্ণনা দিয়েছেন।
সেসব হৃদয়বিদারক বর্ণনা শুনে চোখের সামনে ছবির মতো ভেসে উঠেছে পিলখানার ভেতরের–বাইরের কিছু খণ্ডিত চিত্র। ভেতরের ভয়াবহ চিত্রের কথা এখানে উল্লেখ না করাই শ্রেয়। বাইরে সেসব সেনা কর্মকর্তাদের আত্মীয়-স্বজন, ধানমন্ডি এলাকার সাধারণ মানুষ, স্কুল–কলেজের বাচ্চা আর তাদের অভিভাবকেরা কতটা অসহায় অবস্থা ও বিপদের মধ্যে ছিলেন, তা অনুমান করা কঠিন কিছু নয়।
একজন লিখেছেন, ‘সকাল নয়টায় আমি মেয়েকে নিয়ে অগ্রণী স্কুলের গেটে, মেয়ের এসএসসি পরীক্ষা চলছে। বড় ছেলে বিডিআর কোয়ার্টারে। বুয়েটে মাত্র চান্স পেয়েছে। ভর্তি প্রসেস শুরু হয় নাই। আর আমার হাসবেন্ড দরবার হলে। কী বিভীষিকাময় দিন ছিল। মেয়ের পরীক্ষা শেষে আমরা বাইরে। ছেলে ভেতরে জিম্মি। আর বাবার কোনো খোঁজ নাই। চোখ বন্ধ করলেও প্রতিটি ক্ষণ এখনো স্পষ্ট। সবকিছু শেষ হলো, ছেলে ট্রমাটাইজ হয়ে ফিরল আর বাবাকে পাওয়া গেল গণকবরে। ঘটনাকে বিদ্রোহ বলা যায় না, এটি স্রেফ নৃশংস হত্যাকাণ্ড। বিচারের আশায় এখনো দিন গুনি। দিনটিকে “শহীদ সেনা দিবস” হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার দাবি নিয়ে এখনো অপেক্ষা করি।’
কী মর্মান্তিক এই ঘটনা! কী মর্মান্তিক এই বিলাপ! সেই অকাল বিধবা এক স্ত্রী, অসহায় মায়ের লেখা পড়ে আমার বুকের রক্ত হিম হয়ে গেল। তাঁর সেই সময়কার কষ্ট, উৎকণ্ঠা ভাষায় বর্ণনা করা আজ অসাধ্য। এই পরিবারটির মতোই আরও কতগুলো পরিবার তাদের বুকের মধ্যে এমনি রক্তক্ষরণ, এমনি গভীর কান্না নিয়ে ধুঁকছে, অপেক্ষার প্রহর গুনছে, তার হদিস আমরা কেউ রাখিনি। এই ব্যথা যেন শুধু তাদের একান্তই ব্যক্তিগত ব্যথা। দেশ শুদ্ধ পুরো জাতি আজও নির্বাক।
আমি বহুদিন দেশের বাইরে। তখনো বাইরে ছিলাম। কিন্তু এই খবর শুনে আমাদের আহার, নিদ্রা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। আমাদের পরিচিত কয়েকজনও আর ফেরেনি! মনে পড়ে, আমাদের পারিবারিক বন্ধু মেজর চপলের কথা। তার নববধূর হাতের মেহেদির রং তখনো ফিকে হয়নি। মেজর চপলের রক্তের মতোই তার দুহাতে টকটকে লাল রঙের মেহেদি পরা মেয়েটি অকাল বৈধব্যকে বরণ করে নিতে বাধ্য হয়েছিল।
এই হত্যাকাণ্ডের পেছনের কারণ কী ছিল, সেই রহস্য আজও রহস্যই থেকে গেছে। আমরা যেমন ’৫২, ’৭১, ’৭৫, ’৮১ মনে রেখেছি, তেমনি ২০০৯ সালও আমাদের স্মৃতিতে রক্তের অক্ষরে লেখা হয়ে থাকবে।
পিলখানা হত্যাকাণ্ডে ৫৭ জন বীর সেনা মারা গেছেন। কিন্তু বীরদের কখনো মৃত্যু হয় না। তাঁরা অমর। তাদের সঙ্গে মারা গেছেন আরও অনেকে। অনেকের পরিবারের সদস্যরা হয়েছেন ধর্ষিতা, লাঞ্ছিত!
পঁচিশের পর এসেছে আরও একটি রক্তরঞ্জিত দিন। দিনটি ছিল ২৬ ফেব্রুয়ারি। বইমেলার শেষ সপ্তাহ। মেলা তখন বেশ জমজমাট হয়ে উঠেছে। চলছে শেষ মুহূর্তের কেনাকাটা। লেখক ও ব্লগার অভিজিৎ রায় এবং তার স্ত্রী রাফিদা আহমেদ বন্যা মেলা থেকে বের হয়ে চলে যাচ্ছিলেন। তারা সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের গেট পার হয়ে টিএসসির কাছাকাছি আসতেই পেছন থেকে হঠাৎ আক্রমণের শিকার হলেন। দুজনই আহত ও রক্তাক্ত হয়ে রাস্তায় পড়েছিলেন। চেতনা ফিরে পাওয়ার পর তিনি সাহায্যের আশায় চিৎকার করছিলেন। কিন্তু শুরুতে কেউই সাহায্য করতে সাহস পায়নি। হাসপাতালে নেওয়ার পর সেই রাতেই মারা যান অভিজিৎ। রাফিদার আঘাত গুরুতর হলেও তিনি বেঁচে যান।
২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে বইমেলাকে উপলক্ষ করেই স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে দেশে বেড়াতে এসেছিলেন অভিজিৎ। এই হত্যাকাণ্ড বাংলাদেশসহ বহির্বিশ্বেও ব্যাপক আলোড়ন তৈরি করে। অভিজিৎ মার্কিন নাগরিক ছিলেন। এই কারণে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা এফবিআইয়ের একটি প্রতিনিধি দল বাংলাদেশ সফর করেন।
জাগৃতি প্রকাশনীর কর্ণধার ফয়সাল আরেফিন দীপন ছিলেন অভিজিৎ রায়ের শৈশবের সহপাঠী বন্ধু। অভিজিতের বই প্রকাশের দায়ে একই বছর দীপনকে হত্যা করা হয়।
মনে পড়ে ফেব্রুয়ারির রক্তঝরা আরও একটি দিনের কথা। ২৭ ফেব্রুয়ারি। ২০০৪ সালের ওই দিনে বইমেলা থেকে বেরিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে নিজের বাসায় যাচ্ছিলেন হুমায়ূন আজাদ। পথে ওত পেতে থাকা মৌলবাদী ঘাতকদের আক্রমণের শিকার হন তিনি। এই আঘাতের জের ধরেই কিছুদিন পর ২০০৪ সালের ১১ আগস্ট জার্মানির মিউনিখ শহরে মারা যান হুমায়ুন আজাদ। এই লজ্জা আমরা কোথায় রাখব?
হুমায়ূন আজাদ যুদ্ধ করতেন কলম দিয়ে। কলমের প্রতিঘাততো কলম দিয়েই করা উচিত। সেখানে রামদা কেন আসে? কালি না ঝরিয়ে রক্ত কেন ঝরাতে হয়? কারা এসব রক্ত পিপাসু অন্ধকারের জীব?!
আজীবন প্রথাবিরোধী ও ঠোঁটকাটা মানুষ ছিলেন হুমায়ুন আজাদ। বহুমাত্রিক এই মানুষ বাংলা সাহিত্য জগতের একজন বিরল প্রতিভা। ঘুণে ধরা সমাজের কাঠামোয় আঘাত করে, ভেঙে নতুন কাঠামোর, নতুন সমাজ গড়তে চেয়েছিলেন তিনি। কুসংস্কার ও ধর্মীয় বাড়াবাড়ি নিয়েও কলম ধরতে দ্বিধা করেননি। বাংলা ভাষা, সাহিত্যে তার অবদান কখনো বাঙালি জাতি ভুলতে পারবে না। পুরোনো প্রথা ভেঙে নতুনভাবে সবকিছু দাঁড় করাতে চেয়েছিলেন তিনি। সামাজিক, পারিবারিক বা রাষ্ট্রীয় প্রতিটি ক্ষেত্রে অসংগতির বিরুদ্ধে তাঁর কলম ছিল শাণিত। অসুন্দরের বিরুদ্ধে কলম ধরেছেন। কারও অন্যায় ও অযৌক্তিক প্রশংসায় যেমন আপ্লুত হননি, কাউকে সেভাবে স্তুতিও করেননি।
হুমায়ূন আজাদ আমার শিক্ষক ছিলেন। আমার প্রিয় লেখকও। ভালো লাগত তার মজা করে কথা বলা, হাসি কৌতুক। হুমায়ূন স্যারের ক্লাস তাই খুব কমই ফাঁকি দিয়েছি। তিনি আমাদের পড়াতেন ‘রাধাকৃষ্ণের প্রেম লীলা’।
একবার এক বন্ধুর সঙ্গে মধুমিতা সিনেমা হলে ‘সান ফ্লাওয়ার’ মুভি দেখতে গিয়েছিলাম। ঘটনাচক্রে সেদিন দৈব ঘটনার মতোই আমাদের সাহিত্য জগতের তিন মহারথীর সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। কবি শামসুর রাহমান, লেখক শামসুল হক, হুমায়ুন স্যার। তাঁরা তিনজন ছিলেন ঠিক আমাদের পেছনের সারিতে। উত্তেজনায় সেদিন ভালো করে সিনেমা দেখা হয়নি।
সেই যুগে আমাদের হাতে কোনো সেলফোন ছিল না। তাই সেলফি তোলা হয়নি। শুধু মুগ্ধ বিস্ময়ে তাঁদের গল্প শুনছিলাম। স্যার আমাকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন কবি শামসুর রাহমান ও লেখক সৈয়দ হকের সঙ্গে। আমি আপ্লুত, শিহরিত ও মুগ্ধ হয়েছিলাম।
কিন্তু আজ তাঁরা কোথায়! আলোর মশাল ধরা মানুষগুলো চলে যাচ্ছেন অন্য ভুবনে। গেল বছর থেকে মহামারি এসে হানা দিয়েছে বিশ্বজুড়ে। চারদিকে এখনো আহাজারি, এখনো মৃত্যুশোক! এত ঘোর আঁধার আগে কখনো দেখিনি। একে একে সব আলো নিভে যাচ্ছে। আমরা যেন কেবলই, ক্রমাগত তলিয়ে যাচ্ছি ঘোর অন্ধকারে!
২০২১ সালে আমরা কিছু আশার আলো দেখতে পাচ্ছি। ২০২০ সালের ধেয়ে আসা করোনা মহামারিকে বাগে আনতে বিজ্ঞানী ও গবেষকেরা খুব স্বল্প সময়ে আবিষ্কার করেছেন ভাইরাসের বিরুদ্ধে কার্যকরী বেশ কিছু ভ্যাকসিন। শুরু হয়েছে বিশ্বব্যাপী ভ্যাকসিন বিতরণ।
দেশে অভিজিৎ ও দীপন হত্যার রায় হয়েছে। এই রায়ে কেউ খুশি এবং কেউ কেউ অখুশি হবেন বা হয়েছেন। তবে বিচার হচ্ছে, সেটাই আশার কথা। প্রকৃত অপরাধীরা সাজা পাক, সন্ত্রাসবাদ নিপাত যাক, এটাই মুক্তবুদ্ধির সাধারণ মানুষের আশা।
সব শহীদের আত্মার প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা। তাদের পরিবারের সদস্যদের জন্য অতল ভালোবাসা! আমাদের দেশ ভালো থাকুক। দেশের মানুষ ভালো থাকুক। শান্তিতে থাকুক। দেশের বাইরে থাকলেও এই প্রত্যাশা সতত!