‘ফুল নেব না অশ্রু নেব ভেবে হই আকুল’
ঘটনাটা ২০০৭ সালের। কাইজার সান্টাক্লারা হাসপাতালের সেকেন্ড ইয়ার মেডিসিন রেসিডেন্ট আমি, এটা স্ট্যানফোর্ড এফিলিয়েড প্রোগ্রাম। মেডিকেলের ছাত্রছাত্রীরা আসে স্ট্যানফোর্ড থেকেই। তাদের পড়াতে হবে, রোগী ভর্তি করবে তারা, সুপারভাইজ করব আমি। সেটা ছাড়াও নব্য পাস করা ইন্টার্নদের পড়ানো, সুপারভাইজ করা তো আছেই। প্রথম দিন অনেক শঙ্কা নিয়ে যাইনি বললে মিথ্যা বলা হবে। ভিন্ন দেশ থেকে এসেছি আমি, অথচ সম্মানের এক বিন্দু ঘাটতি দেখিনি কখনো। এখনো সদ্য পাস করা ডাক্তারদের মাঝেমধ্যে শেখাতে হয়, কেউ সম্মানের জায়গায় থেকে নড়ে না। আমার পেশাকে তাই অসম্ভব ভালোবাসতে শিখেছি সিনিয়র বা জুনিয়র সবাইকে দেখে। সম্মান তো মন থেকেই আসে। একজন শিক্ষককে যদি ছাত্ররা সম্মান না করতে পারে, তাহলে শিখবে কীভাবে (হৃদয় মণ্ডল স্যার, যতটুকু শিখিয়েছেন, তত ঋণী করে রেখেছেন ছোট ছোট বাচ্চাদের, অসম্মান করে ঋণ বেড়েছে বরং বহুগুণ)।
মেডিসিনের রোগী যেমন আমি দেখি, প্রয়োজনে হৃদয় বিশারদ, লিভার বিশারদ, কিডনি বিশারদ, শল্য চিকিৎসকদের ডাকি, তাঁরাও আমাদের ডাকেন রোগীর টেককেয়ারের জন্য। রোগী সুস্থ হয়ে বাসায় ফেরেন সবার প্রয়োজনীয় চেষ্টায়। সবাই যেন একই মস্তিষ্কের বিভিন্ন অংশ। একজন আরেকজনকে ছাড়া চলতে পারেন না। যদি শল্য চিকিৎসককে মেডিসিনের রোগী দেখতে বলা হয় বা আমাকে সার্জারি করতে বলা হয়, তাহলে কী হবে সে রোগীর? বিজ্ঞানের শিক্ষক কেন ধর্মীয় শিক্ষা দিতে বাধ্য থাকবেন? বিজ্ঞান আর ধর্ম পাশাপাশি চলবে একে অপরের পরিপূরক হয়ে। বিরোধিতা হবে কেন? নিরাপদসহ অবস্থান হবে সব ধর্ম একসঙ্গে। বিজ্ঞানও চলবে নিজের গতিতে।
আমার জন্য পবিত্র কোরআন শরিফ একটা পূর্ণাঙ্গে জীবনব্যবস্থা। অর্থসহ বাচ্চাদের শেখাতে চেষ্টা করেছি। সেই সঙ্গে নামাজ পড়া ও রোজা করা। কিন্তু আমি পারিনি একা কাজটি করতে। মিস মুনা নামের লেবানিজ শিক্ষক তাদের যত্ন করে শিখিয়েছেন বছরের পর বছর। ছেলেমেয়েকে বলেই রেখেছি তারা সুসন্তান হিসেবে পৃথিবীর বুকে বেঁচে না থাকতে পারলে আমার পুরোটা জীবন ব্যর্থ। তারা একই কথা হাজারবার শুনে চরম বিরক্ত। তবু চেষ্টা করে যাব। পৃথিবীতে সুন্দর রাখার দায়িত্ব তাদের। পথ দেখানোর দায়িত্ব আমাদের। শিক্ষক অবমাননাকারী শিক্ষার্থীদের মা-বাবা কিন্তু দায়িত্ব এড়াতে পারেন না। তাদের ভবিষ্যতের জন্যই পারেন না। কারণ, দোয়া ও শিক্ষা সবার লাগবে। একাই এক শ কেউ না। তারা ফুল নেবে না অশ্রু নেবে, দেখে-জেনে-শিখে তারপর নেবে। আর জীবনের প্রয়োজনে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা তো অন্য শিক্ষকেরা দিচ্ছেন। নিজের জীবনের বিনিময়ে। শিক্ষার আলো ছড়িয়ে নিজে দরিদ্র অবস্থানে থেকে চিকিৎসক, প্রকৌশলী, বিচারক, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক বানানো সোজা কথা নয়।
চিকিৎসাবিজ্ঞানে হিপোক্রেটিস, ইবনে সিনা, বিধান চন্দ্র—কার অবদান অস্বীকার করা যাবে? আবার আমাদের নবীজিও শিক্ষক। তাঁর শিক্ষায় শিক্ষিত হলে সম্মান, ভালোবাসা, মানবতা এমনিতেই আসে। শুনছিলাম বিদায় হজের ভাষণ। মুন্সিগঞ্জের ঘটনা কিছুতেই মেলে না।