ফিনল্যান্ডের ঘটনাবহুল মে মাস
ফিনল্যান্ডকে নিয়ে গোটা বিশ্বের কৌতূহল অনেকটাই বেড়েছে গত মে মাসের ঘটনাপ্রবাহের কারণে। ২৪ ফেব্রুয়ারি ফিনল্যান্ড থেকে প্রায় এক হাজার মাইল দূরে ইউক্রেনে যখন যুদ্ধ শুরু হলো, ব্যক্তিগতভাবে তা আমার জন্য বেশ অস্বস্তিকর ছিল। রাশিয়া বাংলাদেশের বন্ধুপ্রতিম দেশ, আমাদের স্বাধীনতাযুদ্ধে তাদের ভূমিকা অনেক এবং উচ্চশিক্ষার্থে রাশিয়া সরকারের বৃত্তিতে প্রেসিডেন্ট পুতিনের জন্মস্থান সেন্ট পিটার্সবার্গে আমার কয়েক বছর থাকার সুযোগ হয়েছে। এসব কারণে রাশিয়ার প্রতি আমার হৃদয়ে সব সময়ই একটা জায়গা থাকবে। আবার অন্যদিকে জীবনের সবচেয়ে বেশি সময় কাটিয়েছি ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) ফিনল্যান্ডে। ফিনল্যান্ডের রয়েছে রাশিয়ার সঙ্গে ৮৩০ মাইলের বিশাল স্থলসীমান্ত। ফিনল্যান্ড ১৯১৭ সালে স্বাধীনতা লাভের আগে ১০০ বছরেরও বেশি সময় ধরে রাশিয়ান সাম্রাজ্যের অধীন ছিল।
অবশেষে অনেকটা প্রত্যাশিতভাবেই গত ১৮ মে ফিনল্যান্ড সরকারিভাবে ন্যাটো সদস্যপদের জন্য আবেদন করেছে। যদিও তুরস্ক এখন এ ব্যাপারে বেঁকে বসেছে; আশা করা যায় আলোচনার মাধ্যমে তারা এ ব্যাপারে তাদের সমর্থন দিয়ে দেবে। ৭৫ বছর ধরে, এমনকি স্নায়ুযুদ্ধের সময়ও ফিনল্যান্ড সামরিকভাবে নিরপেক্ষতার নীতি ধরে রেখেছিল। বাংলাদেশ থেকে আমাকে অনেকেই প্রশ্ন করেন, তাহলে ফিনল্যান্ড হঠাৎ কেন এখন ন্যাটোতে যোগ দিতে ইচ্ছুক, বিশেষ করে যেহেতু ইউক্রেনের সম্ভাব্য ভবিষ্যৎ ন্যাটো সদস্যপদ রাশিয়া আক্রমণের মূল কারণ হিসেবে ব্যবহার করেছিল। এ যুদ্ধ শুরুর আগের জরিপ দেখায়, ফিনল্যান্ডের জনসংখ্যার মাত্র ২১ শতাংশ ন্যাটো জোটে যোগদানের সমর্থন করেছিল; এমন একটি চিত্র, যা কয়েক দশক ধরে খুব বেশি ওঠানামা করেনি। যুদ্ধ শুরুর পরে গৃহীত জরিপে প্রায় ৬০ শতাংশ, আর এই মে মাসের জরিপে ৭৬ শতাংশ ফিনল্যান্ডবাসী বলেছেন, তাঁরা ন্যাটোতে যোগদানের জন্য আবেদন করার পক্ষে থাকবেন। আমার জানামতে, ফিনিশ ইতিহাসে জনমতের এত দ্রুত ও আমূল পরিবর্তন এর আগে কখনো হয়নি। সাধারণত রাজনৈতিক নেতারা ন্যাটোর জন্য চাপ দিতেন, কিন্তু এ ক্ষেত্রে হয়েছে উল্টো। ফিনিশরা নিজেরাই চায় আর বিলম্ব না করে ন্যাটোতে যোগ দিতে।
আরেকটি সাম্প্রতিক জরিপ দেখিয়েছে, ৮৪ শতাংশ ফিনিশ এখন বিশ্বাস করে যে রাশিয়া একটি উল্লেখযোগ্য সামরিক হুমকির সৃষ্টি করেছে। রাশিয়ার সাম্প্রতিক পদক্ষেপের প্রতিক্রিয়ায় ফিনিশদের এ অবস্থান পরিবর্তন অনেকটাই স্বাভাবিক, যাঁরা ইতিহাস জানেন। উইন্টার ওয়ার (যা প্রথম সোভিয়েত-ফিন্নিশ যুদ্ধ নামেও পরিচিত), দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার তিন মাস পর ১৯৩৯ সালের ৩০ নভেম্বর ফিনল্যান্ডে সোভিয়েত আক্রমণের মাধ্যমে শুরু হয়। উচ্চতর সামরিক শক্তি থাকা সত্ত্বেও সোভিয়েত ইউনিয়ন ওই সময় মারাত্মক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছিল। লিগ অব নেশনস ওই আক্রমণকে অবৈধ বলে সোভিয়েত ইউনিয়নকে তখন বহিষ্কার করেছিল। তবে সে সময় ফিনল্যান্ডকে তার ভূখণ্ডের প্রায় ১০ শতাংশ সোভিয়েত ইউনিয়নকে দিয়ে দিতে হয়েছিল। সেই উইন্টার ওয়ারের সঙ্গে ইউক্রেনের যুদ্ধের মধ্যে অনেক মিল তারা দেখে। এরপর অবশ্য দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অংশ হিসেবে ১৯৪১ থেকে ১৯৪৪ সাল পর্যন্ত সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে ফিনল্যান্ড এবং তৎকালীন নাৎসি জার্মানি আরেকটি যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে, যা কন্টিনিউয়েশন ওয়ার বা দ্বিতীয় সোভিয়েত-ফিনিশ যুদ্ধ নামেও পরিচিত।
এদের বর্তমান প্রজন্ম কোনো যুদ্ধের অভিজ্ঞতা পায়নি, কিন্তু এদের মা-বাবা ও দাদা-দাদি সোভিয়েতদের সঙ্গে যুদ্ধের সময় দেখেছে। এ প্রজন্ম তাদের অভিজ্ঞতা নিয়েই বড় হয়েছে, সেগুলো এদের হৃদয়ে বহন করে, এটাই স্বাভাবিক। ফিনিশরা তাদের আবেগ সম্পর্কে খুব বেশি খোলামেলা নয়, তবে ইউক্রেনে যা ঘটছে, তা এমন অনুভূতি নিয়ে এসেছে, যা মনে হচ্ছে কয়েক দশক ধরে তাদের মনের ভেতরে পুঞ্জীভূত ছিল। ইতিমধ্যেই রাশিয়া ফিনল্যান্ড ও সুইডেনকে ন্যাটোতে যোগদানের বিরুদ্ধে সতর্ক করে বলেছে, এ পদক্ষেপ ইউরোপকে অস্থিতিশীল করবে। তবে ফিনিশ বিশেষজ্ঞরা সবাইকে শান্ত থাকার আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, ফিনল্যান্ড যেকোনো আগ্রাসনের জন্য প্রস্তুত। ফিনল্যান্ড গত ৩০ বছরে শক্তিশালী প্রতিরক্ষা ব্যয় বজায় রেখেছে, যেখানে ইউরোপের বাকি দেশগুলো মূলত হ্রাস করেছে। ফিনল্যান্ডের সংবিধান অনুযায়ী প্রত্যেক ফিনিশ নাগরিক জাতীয় প্রতিরক্ষায় অংশগ্রহণ করতে বাধ্য। ১৮ থেকে ৬০ বছর বয়সী প্রত্যেক পুরুষ ফিনিশ নাগরিকের জন্য সামরিক প্রশিক্ষণ বাধ্যতামূলক। বর্তমানে ফিনল্যান্ডের যুদ্ধকালীন শক্তি হিসেবে ২ লাখ ৮০ হাজার এবং রিজার্ভ রয়েছে প্রায় ৯ লাখ সৈনিক। ন্যাটোর আর্টিকেল ফাইভে বলা আছে, কোনো সদস্যদেশ আক্রমণের শিকার হলে সেটা অন্য সব দেশের ওপর আক্রমণ হিসেবে বিবেচিত হবে। তাই ন্যাটোতে যোগ দিলে রাশিয়া অদূর ভবিষ্যতে ফিনল্যান্ডকে সামরিকভাবে হুমকি দিতে সক্ষম হবে না বলেই মনে করা হয়।
রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞার কারণে ফিনল্যান্ড ইতিমধ্যে বেশির ভাগ দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য বন্ধ করে দিয়েছে, যার প্রভাব অর্থনীতিতে ব্যাপক হতে পারে। রাশিয়া হচ্ছে ফিনল্যান্ডের তৃতীয় বৃহত্তম দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যিক অংশীদার। ২০২১ সালে ফিনল্যান্ডের মোট রপ্তানির প্রায় ৫ দশমিক ৪ শতাংশ এবং একই সময়ে মোট আমদানির ১১ দশমিক ৯ শতাংশ হয়েছে রাশিয়ার সঙ্গে। এখানে বর্তমানে মূল্যস্ফীতি চলছে ৫ দশমিক ৮ শতাংশ (ইউরো জোনে ৭.৫%), কিন্তু পেলেরভো ইকোনমিক রিসার্চ ইনস্টিটিউটের পূর্বাভাষ বলছে, এ বছরে খাদ্যপণ্যের দাম ১১ শতাংশ বৃদ্ধি পাবে। বছরের প্রথম দিকে সামান্য বৃদ্ধি পাওয়ায় গ্রীষ্ম ও শরতের শুরুতে সবচেয়ে বড় বৃদ্ধি পাবে।
স্ট্যাটিসটিকস ফিনল্যান্ড সংস্থার প্রাথমিক তথ্য অনুসারে, রাশিয়া থেকে আমদানি করা এনার্জি ২০২১ সালে ফিনল্যান্ডের মোট এনার্জি চাহিদার ৩৪ শতাংশ পূরণ করেছে। গত ১৪ মে ফিনল্যান্ডে বিদ্যুৎ সরবরাহ এবং ২১ মে থেকে গ্যাস সরবরাহ বন্ধ করে দিয়েছে রাশিয়া। মোট বিদ্যুৎ চাহিদার ৮২ শতাংশ এ দেশেই উৎপাদিত হয় এবং বাকি ১৮ শতাংশ এদের আমদানি করতে হয় সুইডেন, রাশিয়া ও এস্তোনিয়া থেকে। রাশিয়া থেকে আমদানি করা বিদ্যুৎ চাহিদার ১০ দশমিক ৫ শতাংশ পূরণ করত। ফিনল্যান্ড এখন দেশীয় উৎপাদন বা আমদানি করা বিদ্যুৎ দিয়ে এটাকে প্রতিস্থাপন করবে, প্রধানত সুইডেন এবং বাল্টিক দেশগুলো থেকে। ২০২৩ সালে বিদ্যুৎ-শক্তিতে এ দেশ স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে উঠবে বলে আশা করা হচ্ছে।
রুবলে পরিশোধ করতে অস্বীকার করায় রাশিয়া ফিনল্যান্ডের আগেই পোল্যান্ড ও বুলগেরিয়ার গ্যাস সরবরাহ বন্ধ করে দিয়েছিল। ফিনল্যান্ডের অর্থমন্ত্রী বলেছেন, যদি রাশিয়া মে মাসের শেষে ইউরোপে গ্যাস সরবরাহ বন্ধ করে দেয়, তাহলে ফিনিশ অর্থনীতিতে এর প্রভাব তেল আমদানি বন্ধের চেয়ে বেশি ক্ষতিকর হবে। যদিও ফিনল্যান্ডে ব্যবহৃত এনার্জির মাত্র ৫ শতাংশের একটু বেশি প্রাকৃতিক গ্যাস, কিন্তু এর ৯২ শতাংশই রাশিয়া থেকে আমদানি করা এবং এর প্রভাব এখনো অর্থনীতি ও কর্মসংস্থানের ওপর মারাত্মকভাবে ফেলবে, কারণ এটি বড় বড় কলকারখানায় একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। মন্ত্রী আরও বলেন, ব্যবহারিক দিক থেকে এ প্রভাবগুলো বনশিল্প, খাদ্য খাত ও স্বাস্থ্যসেবা পর্যন্ত প্রসারিত হতে পারে। রাশিয়ান গ্যাস আমদানি বন্ধ হলে এটি এস্তোনিয়ার মধ্য দিয়ে আসা (বাল্টিক কানেক্টর পাইপলাইন) গ্যাসের দাম বাড়িয়ে দেবে। বিদ্যুতের দামও বাড়বে। যে সুবিধাগুলো গ্যাস প্রতিস্থাপন করতে পারে, তা তেল দিয়ে প্রতিস্থাপন করতে হতে পারে। যদিও গত বছর পর্যন্ত ফিনল্যান্ড তার অপরিশোধিত বা খনিজ তেলের মোট চাহিদার প্রায় ৭২ শতাংশ রাশিয়া থেকে কিনেছে, এ বছর তার বেশির ভাগই নরওয়ে থেকে কেনা তেল দিয়ে প্রতিস্থাপন করা হয়েছে।
এসব পরিস্থিতি নিয়ে প্রবাসী বাংলাদেশিসহ এ দেশের জনগণ উদ্বিগ্ন, তবু এখন অবধি জীবন স্বাভাবিকভাবেই চলছে। আমরা সবাই চাই এই যুদ্ধ অচিরেই শেষ হোক। তবে ইউক্রেন আক্রমণের পর ফিনিশ-রাশিয়ান সম্পর্ক একটি সম্পূর্ণ ‘নতুন যুগে’ প্রবেশ করেছে। ফিনল্যান্ড ন্যাটোতে যোগদানের পর এই দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক আবার কবে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসবে, এ ব্যাপারে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে।
বি: দ্র: এই লেখার জন্য প্রয়োজনীয় তথ্যাদি স্ট্যাটিসটিকস ফিনল্যান্ড: stat. fi এবং পেলেরভো ইকোনমিক রিসার্চ ইনস্টিটিউট ptt. fi থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে।
লেখক: মারুফ দেওয়ান, সিনিয়র প্রকৌশলী, রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট, এরিকসন, এস্পো, ফিনল্যান্ড