প্ল্যান্ট-বেসড কোভিড টিকা, বাংলাদেশ কি পারবে সম্ভাবনাময় এ প্রযুক্তি কাজে লাগাতে
বিজ্ঞানের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো মানুষের ব্যবহারের জন্য প্ল্যান্ট-বেসড টিকা অনুমোদন দিল কানাডা। এর নাম কোভিফেঞ্জ, যা কোভিড-১৯–এর বিরুদ্ধে কাজ করে। এটির উৎপাদনকারী মেডিক্যাগো নামের মাঝারি আকারের একটি বায়োফার্মা কোম্পানি। এটি এখন পর্যন্ত কানাডা সরকারের ৬ নম্বর অনুমোদিত টিকা, যা কোভিড-১৯–এর বিরুদ্ধে কাজ করে। এটি এমন সময় বের হলো, যখন জনগণের মানসিক স্বাস্থ্য, টিকাবিরোধী ও কোভিড বিধিনিষেধবিরোধী আন্দোলন বিবেচনা করে কানাডা সরকার কোভিড বিধিনিষেধ ধীরে ধীরে শিথিল করার দিকে এগোচ্ছে। বিশেষ করে সম্প্রতি রাজধানী অটোয়াতে ট্রাকচালকদের নজিরবিহীন আন্দোলন। তারপরও ট্রুডো সরকারের কাছে নিজস্ব উৎপাদিত ভ্যাকসিনের তাৎপর্য অনেক। অন্য দেশের ওপর নির্ভরতা অনেকটা কমিয়ে আনবে। কানাডা সরকার ইতিমধ্যে এ কোম্পানির সঙ্গে ২০ মিলিয়ন ডোজের চুক্তি করে ফেলেছে, আরও ৫৬ মিলিয়ন ডোজের অপেক্ষায় আছে।
২০২২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি স্মরণীয় হয়ে থাকবে মূলত দুটি কারণে। ১. এটি কানাডার নিজস্ব উৎপাদিত কোভিড-১৯ টিকার অনুমোদন; ২. প্রথমবারের মতো প্ল্যান্ট-বেসড টিকা, যা জৈবপ্রযুক্তি জগতে সম্ভাবনার নতুন দ্বার খুলে দেবে।
প্ল্যান্ট-বেসড টিকা হলো টিকার অ্যাকটিভ অংশটি, যা ফার্মাসিউটিক্যালসের পরিভাষায় এপিআই বা অ্যাকটিভ ফার্মাসিউটিক্যালস ইনগ্রিডিয়েন্টস প্ল্যান্ট বা গাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়। এখানে গাছটি বায়োরিঅ্যাকটর বা এই অ্যাকটিভ অংশ তৈরির কারখানা হিসেবে কাজ করে। গাছের পাতা থেকে ভিএলপি বা ভাইরাস লাইক পার্টিকল সংগ্রহ করা হয়, যা টিকার মূল উপাদান হিসেবে কাজ করে।
কোভিড-১৯ টিকার জন্য ভাইরাসের সারফেস প্রোটিনকে টার্গেট করা হয়। যার জেনেটিক কোড সিনথিসাইজ করে জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের মাধ্যমে ব্যাকটেরিয়ার মধ্য দিয়ে দেওয়া হয়। পরে সেটি ব্যাকটেরিয়া থেকে তামাকজাতীয় গাছের পাতায় স্থানান্তরিত করা হয়ে। গাছ তখন সেটিকে নিজের জেনেটিক ম্যাটেরিয়াল মনে করে সেখান থেকে কোভিড-১৯ ভিএলপি তৈরি করে। এটি একধরনের প্রোটিন, এখানে কোনো জেনেটিক ম্যাটেরিয়াল থাকে না, যা থাকে ফাইজার-বায়োএনটেক বা মডার্না টিকায়। শুরু থেকে ফার্মাসিটিউক্যালস গ্রেডের টিকা পেতে সময় লাগে যেখানে মাত্র পাঁচ থেকে ছয় সপ্তাহ, সেখানে অন্যান্য প্রযুক্তির টিকা পেতে সময় লাগে চার থেকে ছয় মাস।
ফাইজার-বায়োএনটেক ও মডার্নার টিকার তুলনায় মেডিক্যাগো টিকার কার্যকারিতা যথেষ্ট ভালো। তথ্যমতে, ফাইজার–বায়োএনটেক ও মডার্নার কার্যকারিতা যেখানে যথাক্রমে ৩৯-৮৪% ও ৫০-৭২%, সেখানে মেডিক্যাগো টিকার কার্যকারিতা ৭৫.৩%। তবে দ্বিতীয় ডোজের পর মেডিক্যাগো টিকার কার্যকারিতা পাওয়া গেছে ৭১%। এ তথ্য কোভিড ডেলটা ধরনের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হলেও আগের অন্যান্য ধরন, যেমন আলফা, ল্যামডা, গামা, মিউয়ের ক্ষেত্রেও এই টিকা কার্যকর। অমিক্রন ধরনের বিরুদ্ধে এখনো গবেষণা শেষ হয়নি, তবে এর বিরুদ্ধেও কার্যকর বলে প্রাথমিক প্রমাণ পাওয়া গেছে।
প্ল্যান্ট-বেসড এই টিকা আসার ফলে যাঁরা টিকাবিরোধী ছিলেন, তাঁরা নমনীয় হবেন বলে আশা করা যায়। যাঁরা এত দ্রুত কোভিড-১৯ টিকা আসায় (আগের টিকা আসতে সময় লাগত যেখানে ৮-১০ বছর) যথাযথ গবেষণা হয়নি বলে টিকা নিরাপদ কি না সন্দেহে ছিলেন, তাঁদের আর সেই ভয় থাকবে না। কারণ, এটি গাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়।
এখানে কোনো জেনেটিক ম্যাটেরিয়াল নেই। ভাইরাসের কোনো সংস্পর্শ ছাড়াই এটি তৈরি করা হয়। সাধারণত অন্য টিকাগুলোতে ভাইরাস বা অন্য কোনো সেলের সাহায্য নিতে হয় প্ল্যান্টের পরিবর্তে, যা নিয়ে তাদের ভয় থাকে। যদিও সেসব টিকার অ্যাকটিভ অংশের সঙ্গে ভাইরাস বা সেলগুলোর চলে আসার সুযোগ নেই বললেই চলে। তা ছাড়া প্ল্যান্ট-বেসড টিকায় অন্য যেসব উপাদান থাকে, তা সব ফুড গ্রেডের, যা আমরা অন্যান্য খাবারের সঙ্গে প্রতিনিয়ত খেয়ে থাকি। পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নিয়েও বাড়তি কিছু নেই, অন্যান্য টিকার মতোই স্বাভাবিক পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া আছে।
প্ল্যান্ট-বেসড টিকা আলোচনার অন্যতম কারণ হলো, এটি অনেক কম দামে পাওয়া যাবে। অন্য টিকা তৈরি করতে যেখানে কয়েক মাস লাগে, সেখানে কোভিফেঞ্জ কয়েক সপ্তাহে তৈরি করা যায়। ট্র্যাডিশনাল টিকার প্ল্যান্টগুলোতে অনেক বেশি ইনভেস্ট করতে হয়, ভাইরাস বা সেলগুলো কালচার বা আবাদ করতে অনেক স্কিলড লোকজনকে নিয়োগ দিতে হয়। এগুলো অনেক সংবেদনশীল হওয়ায়, অনেক নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে এদের আবাদ করতে হয়, যা কষ্টসাধ্য ও ব্যয়বহুল। অন্যদিকে প্ল্যান্ট-বেসড টিকার ক্ষেত্রে গাছগুলোকে গ্রিনহাউসে সহজেই সাধারণভাবে প্রশিক্ষিত লোকের মাধ্যমেই বড় করা যায়। আরও বড় কথা, সেল-বেসডের চেয়ে গাছ থেকে উৎপাদন অনেক বেশি পাওয়া যায়।
সামনের দিনগুলোতে এ প্রযুক্তি বেশ সাড়া ফেলবে বলে বিজ্ঞানীরা আশাবাদী। এটি ব্যবহার করে অ্যান্টিবডি, অ্যান্টি-ক্যানসার থেকে শুরু করে অনেক ড্রাগ তৈরি করার অপার সম্ভাবনা খুলে দিয়েছে, যা বাংলাদেশের মতো দেশগুলোর জন্যও আশীর্বাদ হতে পারে। যেহেতু অনুন্নত বা উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে ইনভেস্টমেন্ট একটা বড় ব্যাপার, তাই কম ইনভেস্টমেন্টে এমন প্রযুক্তিগুলোতে আমরা সহজেই মানিয়ে নিতে পারি।
আমরা যদি যুক্তরাষ্ট্র, কানাডার কথা বলি, তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্র্যাজুয়েটদের উদ্ভাবনী শক্তিকে কাজে লাগাতে প্রচুর পরিমাণে স্টার্ট-আপ কোম্পানিকে প্রণোদনা দিয়ে থাকে। চাকরির বাজারে বড় বড় কোম্পানির চেয়ে এসএমই (স্মল অ্যান্ড মিডিয়াম সাইজ এন্টারপ্রাইজ) কোম্পানিতেই চাকরির আধিক্য দেখা যায় এবং এরাই একসময় উদ্ভাবনের দুয়ার খুলে দেয়, যা বড় কোম্পানিগুলোর পক্ষে সম্ভব হয় না। কেননা তারা ট্র্যাডিশনাল বিজনেস পলিসির বাইরে তেমন বের হতে চায় না। কোভিড-১৯ টিকা উদ্ভাবনে বায়োএনটেক, মডার্না, সিনোভ্যাক, মেডিক্যাগো তারা প্রায় সবাই নতুন, যাদের বয়স ২০ বছরের মধ্যে। আগে বিশ্বে তাদের পরিচিতি ছিল না বললেই চলে। বড় কোম্পানিগুলোর মধ্যে জনসন অ্যান্ড জনসনই এখানে ব্যতিক্রম। তবে ফাইজার বা মিতসুবিশির মতো বড় কোম্পানিগুলো পরে এগিয়ে এসেছে বায়োএনটেক ও মেডিক্যাগোকে সহায়তা করতে।
বাংলাদেশের তারুণ্যনির্ভর মেধাবীরা অনেক গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারে প্রযুক্তি বিপ্লবের ক্ষেত্রে। যেহেতু কর্মসংস্থান একটা বড় চ্যালেঞ্জ বাংলাদেশের জন্য, স্টার্ট-আপ কোম্পানিকে বিকশিত হতে দিলে, একদিকে যেমন সরকারি চাকরিতে চাপ কমবে, মেধা পাচার কম হবে, মেধার অপচয় কম হবে (দুঃখজনক হলেও সত্য, এখন সবাই বিসিএস ক্যাডার হতে চায়), মেধার যথাযথ ব্যবহার হবে, তেমনি অন্যদিকে বিশ্বায়নের যুগে বাংলাদেশকে মর্যাদা নিয়ে দাঁড়াতে সাহায্য করবে। আর যা–ই হোক, ধার করা জিনিস দিয়ে মর্যাদা বেশি দিন রক্ষা করা যায় না। বাংলাদেশকে নিজস্ব প্রযুক্তিতে শক্তিশালী হতেই হবে এবং সেটা হতে পারে তরুণদের যথাযথ কাজের জায়গা তৈরি করার মাধ্যমেই।
লেখক: পিএইচডি বায়োসায়েন্স গবেষক, ইউনিভার্সিটি অব নিউ ব্রান্সউইক, ফ্রেডেরিক্টন, কানাডা।
ই-মেইল: [email protected]