পড়াশোনা শেষ করার কয়েক মাসের মধ্যেই একটি ভালো চাকরি পেয়ে গেলাম। কর্মস্থলের ঠিকানা নিউইয়র্ক থেকে প্রায় পঁচিশ মাইল উত্তরে ইয়ংকার্স শহরে। চাকরি পাওয়ার কিছুদিন পর নিজেই এক বেডরুমের একটি অ্যাপার্টমেন্টে উঠে পড়ি। রুম শেয়ার করে আর কত! এখনতো উপার্জন ভালো। অ্যাপার্টমেন্টের মাসিক ভাড়া এক হাজার ডলার। বাড়ির ঠিকানা লং আইল্যান্ড সিটি, থার্টি ফার্স্ট অ্যাভিনিউ ও টুয়েলভ স্ট্রিট রাস্তার ঠিক উত্তর পাশে। তিন তলার এক বেডরুমের একটি নতুন বাড়ি। চারপাশটা বেশ খোলামেলা। সব দিক থেকে মন্দ নয়। আমার অ্যাপার্টমেন্টের সামনেই একটি সরু রাস্তা। রাস্তার ওপাশেই অর্থাৎ দক্ষিণ পাশেই আমার অ্যাপার্টমেন্টের সমান উচ্চতায় আরেকটি অ্যাপার্টমেন্ট মুখোমুখি দাঁড়িয়ে। বারান্দায় দাঁড়ালে সামনের অ্যাপার্টমেন্টের অন্দরমহলের সবটাই দেখা যায়। বিষয়টা একটু বিব্রতকর বৈকি! প্রাইভেসি বলে কথা! কিন্তু এই বিব্রতকর বিষয়টিতেই যে প্রাণের খোঁজ মিলতে পারে, তা কে জানত!
বিষয়টা আপনাদের খুলেই বলি। প্রতিদিন অফিস থেকে বাসায় আসতে আমার বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হয়ে যায়। বিকেলে বাসায় এসে একটু ফ্রেশ হয়ে বারান্দায় বসে আয়েশ করে কফিতে চুমুক দিতে দিতে বইয়ের পাতায় চোখ রাখা ছিল আমার প্রতিদিনের অভ্যাস। একদিন কফিতে চুমুক দিতে দিতেই দেখি ওপারের বাড়িটায় এক শ্বেতাঙ্গ মেয়ে দিব্যি আরাম করে চুল এলিয়ে দিয়ে কফির মগ হাতে নিয়ে বারান্দায় বসে আছে। আহা কী সুন্দর চুল! কী সুন্দর তার চেহারা! বয়স বাইশ তেইশ হবে। হালকা পাতলা গড়ন। সোনালি চুল। হয়তো এখনো বিশ্ববিদ্যালয় সীমানা অতিক্রম করেনি। মনে মনে মেয়েটির একটি নাম রেখে দিলাম। ‘শবনম’।
জানেন তো, এই আমেরিকায় সবাই নিজ নিজ প্রাইভেসি নিয়ে খুব সচেতন। আমিও তার ব্যতিক্রম হব কেন? খুব স্বাভাবিকভাবে আমিও তাই নিজের কাজে যতটুকু সম্ভব মগ্ন থাকাটাকেই শ্রেয় মনে করলাম। কিন্তু ইচ্ছা করলেই কি সব সময় মগ্ন থাকা যায়? লক্ষ্য করলাম, মেয়েটিও যেন কফির মগে চুমুক দিতে দিতে আমার দিকে আড় চোখে তাকায়। মনে পড়ে গেল আলফ্রেড হিচককের ‘রিয়ার উইনডো’ সিনেমাটির কথা। তাহলে কি আমার জীবনেও সিনেমার মতো কোনো কাণ্ড ঘটে যাবে?
তখন আমিও বয়সে তরুণ। প্রাণে অসুরের মতো শক্তি, আর হৃদয়ে যেন সব সময় একটা ডিনামাইট ফুটছে। এভাবেই বেশ কিছুদিন আমাদের আড়চোখে দেখাদেখি চলতে থাকল। বলতে দ্বিধা নেই, অফিস থেকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বাসায় চলে আসতে শুরু করলাম। কারণ একটাই, যদি শবনমকে কিছুক্ষণের জন্য হলেও দেখতে পাওয়া যায়!
একদিন বিকেলে কী মনে করে বাসায় আসার পথে বাড়ির মোড়ের গ্রোসারি দোকান থেকে একগুচ্ছ সূর্যমুখী ফুল কিনে নিয়ে এলাম। উদ্দেশ্য ঘরটা একটু সুন্দর করে সাজাব। আর তা ছাড়া সেদিন মনটাও কেন জানি খুব উড়ো উড়ো হয়ে ছিল। তখন মনের ভেতরে থেকে থেকেই বয়ে যাচ্ছিল পাগলা হাওয়ার বাতাস। যথারীতি সেদিনও হাতে কফির মগ নিয়ে বারান্দায় একটা চেয়ার টেনে বসলাম। কিন্তু এ কী! শবনমকে আজ বাড়ির বারান্দায় দেখা গেল না! ওকে দেখতে না পেয়ে মনটা কেন জানি খচ্ করে উঠল। কোনো অঘটন ঘটেনি তো?
অঘটন যে একটা ঘটেছে তা দেখতে মিনিট পাঁচেকও আমার অপেক্ষা করতে হলো না। কিছুক্ষণ পরেই দেখি শবনম বেশ সেজেগুজে হাতে একটা কফির মগ নিয়ে সেই চিরচেনা দৃশ্যের মতো চুল এলিয়ে একটা চেয়ার টেনে বসল। এবার আমার মুখোমুখি। আমি মুখ ঘুরিয়ে একটা বইয়ের পাতায় ডুবে থাকার ভান করলাম। আড়চোখে তাকিয়ে দেখি শবনমের ঠিক পাশের চেয়ারটি দখল করে বসে আছে আরেক শ্বেতাঙ্গ পুরুষ। তাদের আচার-আচরণ দেখে বুঝতে অসুবিধা হলো না যে, শ্বেতাঙ্গ ছেলেটি মেয়েটির প্রেমিক। খুব স্বাভাবিকভাবে মুহূর্তেই মন খারাপ হলো আমার। সেই সঙ্গে নিজের প্রতি রাগও হলো। আমি কিনা মনে মনে কত আকাশকুসুম ভেবে বসে আছি। নাহ! বারান্দায় বসে থাকাটাও আমার জন্য চরম বিরক্তিকর হয়ে উঠল। সোজা ঘরের ভেতর ঢুকে জানালাগুলোর সব পর্দা ভালোভাবে টেনে দিলাম। সেই সঙ্গে টেনে দিলাম মনের পর্দাটাও। তবে যতই পর্দা টানাটানি করি না কেন, তাদের তাদের উপস্থিতি ও গতিবিধির ওপর আমার নজর সব সময় থাকত।
তারপর আবার সেই আগের মতো রুটিন। এভাবেই দিনগুলো বেশ কেটে যাচ্ছিল। মাঝে মাঝেই অনিচ্ছা সত্ত্বেও দেখতে পেতাম, শবনম আর তার প্রেমিক খুব ঘনিষ্ঠ হয়ে পাশাপাশি বসে আছে। কখনো তারা কথা বলছে, আড্ডা দিচ্ছে; আবার কখনো তারা পরস্পরকে গভীরভাবে ভালোবাসছে। এসব প্রতিদিন দেখতে কার ভালো লাগে? কিন্তু তারপরও প্রতিদিনই এই দুই প্রেমিক সত্তাকে আড়চোখে দেখি, পুলকিত হই। ব্যস, এ পর্যন্তই। একদিন বিকেলে দেখলাম শবনম তার খাটে শুয়ে আছে। মাথার পাশে তার প্রেমিক পুরুষটি বসে, হাত বুলিয়ে দিচ্ছে মাথায়। তাহলে কি শবনম অসুস্থ! আহা কী হলো মেয়েটির? মনের অজান্তেই জানতে ইচ্ছে করে। ‘চুলোয় যাক সে’, নিজেই আবার বিড়বিড় করে বলি। কিন্তু অবাক হয়ে লক্ষ্য করি মেয়েটির সম্পর্কে জানতে আমার মন কেন যেন ব্যাকুল হয়ে আছে।
এদিকে প্রায় প্রতিদিনই শবনমকে তার সিঙ্গেল খাটে অলস হয়ে শুয়ে থাকতে দেখি। তার প্রেমিকটি প্রতিদিন বিকেলে নিয়ম করে ওর সেবা শুশ্রূষা করে আবার চলে যায়। মনে মনেই বিড়বিড় করে বলি, ‘তাহলে কি মেয়েটি বড় কোনো অসুখে পড়েছে? কেন সে সারাক্ষণ শুয়ে থাকবে? কেন সে বারান্দায় আর আগের মতো বসে না? কেন সে আর আগের মতো হাসে না?’ এসব ভাবনা ভাবতে ভাবতে আবার নিজেই নিজেকে বলি, ‘না, হয়তো ছুটিতে আছে। আর জ্বর ঠান্ডা তো হতেই পারে। তা আর এমন কী?
একদিন দেখি মেয়েটির দেখাশোনার জন্য হাসপাতাল থেকে একজন সেবিকা এসেছে। সেবিকাকে দেখে আমার অন্তর-আত্মার কোথায় যেন একটা মোচড় দিল। তাহলে কি ওর কঠিন কোনো অসুখ হয়েছে? এদিকে দেখতে দেখতে শবনমের সেই মায়াবী মুখটা কেমন জানি রুক্ষ হয়ে উঠেছে। শুকিয়ে কঙ্কাল! তাহলে কী শবনম ক্যানসারের মতো মারাত্মক কোনো রোগে আক্রান্ত? ভয়ে আমার ঠোঁট কেঁপে উঠল। ইচ্ছে করল রাস্তা পেরিয়ে ওদের বাড়িতে যাই, খবরটা নিয়ে আসি। কিন্তু কীসে বাধল যেন। ‘যদি কিছু মনে করে?’ এসব ভেবে আর যাওয়া হয়ে ওঠে না। প্রতি দিনই এক অস্থিরতা নিয়ে ঘরে ঢুকি। মাথায় একটাই প্রশ্ন ঘোরে, শবনমের কেন এমন হলো? বাংলাদেশে আম্মাকে কল করে শবনমের জন্য দোয়া করতে বলি।
একদিন আমাদের বাসার নিচে বিকট শব্দ করে একটি অ্যাম্বুলেন্স এসে থামল। অ্যাম্বুলেন্সের পেছন পেছন একটা এনওয়াইপিডির গাড়িও রয়েছে। বুঝতে পারলাম, শবনমকে আজ হাসপাতালে নেওয়া হবে। নিচে তাকিয়ে দেখি দুজন স্বাস্থ্যবান নার্স স্ট্রেচার নিয়ে বাড়িটার ভেতর ঢুকে গেল। তাদের অনুসরণ করল এনওয়াইপিডির এক কর্মকর্তা। জানালার গ্রিল ধরে চোখের সামনে চলমান ঘটনাগুলো অনেকটা সিনেমার দৃশ্যের মতো দেখতে থাকলাম। তিন তালায় শবনমের শোয়ার ঘরে তার ছেলে বন্ধুটাকে দেখা গেল। একজন বয়স্ক নারী ও পুরুষকেও দেখতে পেলাম। তারা সবাই মিলে শবনমকে ধরে খাট থেকে তুলছে। অনুমান করি বয়স্ক নারী ও পুরুষটি সম্ভবত শবনমের বাবা-মা হবেন। বেদনায় নীল হয়ে যাওয়া তাদের চোখগুলো আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলাম। বেশ বুঝতে পারছিলাম যে, শবনমের সময় ঘনিয়ে আসছে।
হায় খোদা! শবনমকে সেদিন দেখে চিনতেই পারিনি। শুকিয়ে কঙ্কাল হয়ে গেছে। এই কঙ্কালসার শরীরেই কাপড় পরে সে তৈরি হয়ে নিয়েছে। এদিকে নার্স দুজন শবনমকে ধরে স্ট্রেচারে শুইয়ে নিচে নিয়ে এল। অ্যাম্বুলেন্সের দরজাটা পেছন দিক থেকে খোলা ছিল। নার্স দুজন খুব দক্ষতার সঙ্গে স্ট্রেচারসহ শবনমকে অ্যাম্বুলেন্সের ভেতরে নেওয়ার চেষ্টা করল। আমি তিন তলা থেকে মাথা নিচু করে সে দৃশ্য দেখছিলাম। হঠাৎ লক্ষ্য করলাম শবনম আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমাদের চোখাচোখি হতেই সে মুখে হাসি ফুটিয়ে তার কঙ্কালসার হাতটি শুধু নাড়াল। আমিও ওর দিকে তাকিয়ে আমার হাত নাড়ালাম। আমি খুব আবেগপ্রবণ মানুষ। ইচ্ছে হচ্ছিল হাউমাউ করে কাঁদি। তাহলে হয়তো বুকটা একটু হালকা হবে। কিন্তু তা সম্ভব হচ্ছিল না। আমি শুধু হাত দিয়ে আমার চোখ ঢাকলাম।
তারপর অনেক দিন শবনমের আর কোনো খবর পাইনি। আমিও আমার প্রতি দিনের কাজে ব্যস্ত হয়ে গেলাম। তবে প্রতি দিনই বাড়িটার দিকে একবার হলেও তাকাই। সেখানে দেখতে পাই শুধুই অন্ধকার। এক প্রেতপুরি যেন। কেউ থাকে না সেখানে। বেশ বুঝতে পারি শবনম হাসপাতালে। হয়তো লড়ছে ক্যানসার বা কঠিন কোনো রোগের সঙ্গে। আশা যে, হয়তো একদিন ঠিক সে সুস্থ হয়ে ফিরে আসবে। আবার সে কায়দা করে কফির মগটা নিয়ে বারান্দায় এসে আয়েশ করে বসবে। বারান্দার ফুল গাছের টবে পানি দেবে।
কিন্তু না; শবনম আর আসে না। একদিন দেখি ওদের বাড়িতে বেশ কিছু মানুষের জটলা। শবনমের সেই প্রেমিকও সেই জটলায় দেখা গেল। দেখতে পেলাম তারা সবাই মিলে শবনমের আসবাবপত্রগুলো ধরে ধরে নিচে নামাচ্ছে। আসবাবপত্র বলতে ছিল ডজন খানিক ফুলের টব, চারটি চেয়ার, একটি সিঙ্গেল বেডের বিছানা, একটি বড় টিভি, একটি আলমারি ও কিছু কাপড়-চোপড়।
ঠিক করলাম শবনমের অ্যাপার্টমেন্টে যাব। শবনমের সব খবর শুনব। যখন মনে মনে এমন ভাবনা ভাবছি, তখন ওপার থেকে শবনমের প্রেমিকটি আমাকে দেখে হাঁক দিল, ‘আমি কি তোমার সঙ্গে একটু দেখা করতে পারি?’ আমি বললাম, ‘অবশ্যই। চলে এসো। আমি তোমার অপেক্ষা করব।’ বলতেই ছেলেটি ‘আসছি’ বলে কিছুক্ষণের মধ্যেই আমার অ্যাপার্টমেন্টে চলে এল।
ছেলেটির নাম জানা গেল। ডেভিড। যা ভেবেছিলাম তাই, সে শবনমের প্রেমিক। জানা গেল তারা খুব শিগগিরই বিয়ে করার পরিকল্পনা করেছিল। কিন্তু তত দিনে সব শেষ! ‘সব শেষ! মানে?’, আমার চোখে বিস্ময়। ডেভিড মাথা নিচু করে শুধু বলল, ‘সে আর নেই। ওর ক্যানসার ধরা পড়েছিল। একেবারে লাস্ট স্টেজ। চিকিৎসকেরা কিছু করতে পারল না। এই তো প্রায় এক সপ্তাহ হয়ে গেল আমাদের ছেড়ে চলে গেছে।’ বলেই ওর চোখ মুছল।
আমি এবার আর আমার চোখের জল ধরে রাখতে পারলাম না। পৃথিবীটা এত কঠিন কেন? এত প্রাণবন্ত একটি মেয়ে মাত্র মাস ছয়েকের ভেতরই চলে গেল? আমি এই কঠিন সত্যটাকে কোনোভাবেই মানতে পারছিলাম না। এবার আমার কাছ থেকে ডেভিডের বিদায় নেওয়ার পালা। বিদায় নিতে গিয়ে সে হঠাৎ দরজার সামনে এসে দাঁড়িয়ে পড়ল। তারপর আবার আমার দিকে কী মনে করে যেন এগিয়ে এল। পকেট থেকে একটা ছোট কাগজ বের করে আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, ‘হাসপাতালে বিছানায় শুয়ে ও একদিন আমাকে বলেছিল এই কাগজটা যেন আমি তোমাকে দিই। আমি তাকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম তোমার সঙ্গে দেখা করে ওর কাগজটা তোমাকে দেব।’
আমি কাঁপা কাঁপা হাতে কাগজটা হাতে নিলাম। ঝাপসা চোখে সেই চিরকুটটি খুলে পড়তে শুরু করলাম। সেখানে লেখা রয়েছে, ‘প্লিজ, প্রে ফর মি।’ এটা পড়ে আমি ফের চোখ বন্ধ করে ফেললাম। কিছুক্ষণ পর চোখ মেলে দেখি দরজাটা খোলা। ততক্ষণে ডেভিড চলে গেছে। আমি তখনো অশ্রুসজল চোখে শক্ত মুঠোয় বন্দী করে রেখেছি সেই চিরকুট।
এখনো যখন চোখ বন্ধ করি, মাঝে মাঝেই চোখের সামনে ভেসে উঠে সেই চিরকুট। স্পষ্ট দেখতে পাই সেখানে গোটাগোটা অক্ষরে লেখা রয়েছে কয়েকটা শব্দ। ‘প্লিজ, প্রে ফর মি।’
শবনম, তুমি ভালো থেকো।