প্রেয়সী রূপসা নদী

আজও হৃদয়ের মাঝে নিভৃতে একটি নদীর কান্নার শব্দ শুনি। নদীটি আমাকে ডাকে প্রেমিকার স্বরে। কৈশোর ও যৌবনকালে নদীটা আমাকে দিয়েছে সঙ্গ। রূপমাধুরীতে বিদ্যমান সেই নদীর নাম রূপসা নদী। রূপসার রূপের কাছে সর্বদা নতজানু আমার হৃদয়। আমি রূপসা নদীর কাছে শিখেছি অজানাকে জানার উপায়। ব্যথাহত বুক নিয়ে রূপসার পাড়ে বসে খুঁজে পেয়েছি দুঃখ ভোলার পন্থা। বিমোহিত হয়ে শান্তির খোঁজে ছুটে গিয়েছি নদীটির কূলে। প্রতিদিন জোয়ার–ভাটার স্রোতোধারায় নদীর বুক থেকে শুনতে পেতাম নতুন জীবনের জয়গান।

আমার প্রথম যৌবনে প্রথম ভালোবাসা রূপসা নদী। রাত যতই গভীর হতো, রূপসা নদীর রূপ ততই পরিস্ফুটিত হতো। রাতের নীরবতায় রূপসা নদী খুলে দেখাত হাজার বছরের সব রূপের মহিমা। বর্ষা মৌসুমে গর্ভবতী নারীর মতো ফুটে ওঠে রূপের সৌন্দর্য। পাড়ে বসে বিমুগ্ধ হয়ে দেখতাম ঢেউয়ের পেছনে ছুটে চলা ছোট ছোট ঢেউ। তখন বেসুরো গলায় গেয়ে উঠতাম গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের লেখা কালজয়ী গান,
‘ও নদীরে, একটি কথা শুধাই শুধু তোমারে।
বলো কোথায় তোমার দেশ
তোমার নেই কি চলার শেষ!’

গোধূলিবেলায় নীড়ে ফেরা দলবদ্ধ পাখির সঙ্গীহারা মায়াবী ডাক বাউলা বাতাসে ভেসে আসত। রূপসার কূলে বেদেরা নৌকায় সাজাত ভাসমান সংসার। জেলেরা মনের সুখে গান গাইতে গাইতে নৌকা ভাসিয়ে করত মৎস্য শিকার। মাঝেমধ্যে সুন্দরবনের গোলপাতা বোঝাই নৌকা দেখা যেত। পণ্যবাহী জাহাজ হর্ন বাজিয়ে ধীরে ধীরে চলে যেত গন্তব্যে। ঢেউয়ের সঙ্গে সারিবদ্ধ ডলফিনের কাঁথা সেলাইয়ের ফোঁড় দেখতাম। সাদা কাশফুলগুলো নিবিড় ভালো লাগায় দুলে উঠত। আমি বিমোহিত হয়ে চেয়ে দেখতাম কাশফুলের নৃত্য।

আমার মনের অজান্তে রূপসা নদীকে দিয়েছি হৃদয়। পৃথিবীর যে দেশেই থাকি, রূপসার মতো আমাকে আর কোনো নদী প্রেম দিতে পারেনি। নদীর সঙ্গে আমার প্রথম যৌবনের সব স্মৃতি আজও অমলিন। আজও গভীর রাতে রূপসা নদীর ঢেউ আমার ক্লান্ত হৃদয় ছুঁয়ে দেয়। দূর প্রবাস থেকে সেই স্মৃতিগুলো খুঁজি বারবার। গোধূলিবেলায় ডুবুডুবু সূর্যের রক্তিম আভায় তোমার সৌন্দর্য দেখার সাধ হয় খুব। ভালো থেকো রূপসা নদী। আজও ভুলিনি তোমাকে।