প্রেমের জোয়ারে ওরা

ফেসবুক, স্কাইপ কিংবা মুঠোফোনের এ সময়ে তরুণদের প্রেম হয়ে যায় ‘ক্রাশ’। ছবিটি প্রতীকী। ছবি: কবির হোসেন

জানালা দিয়ে ঘরের ভেতরে দেখতেই সোহেলের চোখ আটকে যায় নিধির দিকে। সোহেলের দৃষ্টি স্থির হয়। নিধি গড়পড়তা বাঙালি মেয়েদের চেয়ে আকর্ষণীয়। চেহারায় একধরনের মায়া মেশানো। তবে ইদানীং কোমরে বেশ কিছুটা মেদ জমেছে। সোহেল বারান্দার জানালা দিয়ে অপলক তাকিয়ে থাকে। মেয়েদের অন্য মনে পোশাক পরা দেখতে সোহেলের খুব ভালো লাগে। এ দৃশ্য যে সোহেল আজই দেখছে, তা নয়; প্রায় প্রতিদিনই দেখে।

লুকিয়ে। নিধি টের পেলে ‘কী দেখছ’ বলে মৃদু একটা ধমক লাগায়। নিধি একটা বাচ্চাদের স্কুলে পড়ায়। ও সব সময় ফিটফাট হয়ে স্কুলে যায়। রাতের পোশাক খুলে শাড়ি পরা শেষ হলে ব্যাগটা কাঁধে নিয়ে স্কুলে রওনা দেয় নিধি।

শহরের একটু বাইরে ঠিক ব্রহ্মপুত্র নদীর পাড়ে সদ্য বানানো একটি ফ্ল্যাটে ওরা ভাড়া থাকে। নিধির স্কুলটা কাছে। সোহেলের অফিসটা নদীর পাড়ে পার্কের মাঝ দিয়ে হেঁটে যেতে হয়। ওর দারুণ লাগে। সমস্যা—একটিই মাত্র বাথরুম। তবে অন্যান্য সুবিধা অনেক। সামনে ছোট্ট একচিলতে বারান্দা। ওদের দুজনেরই খুব প্রিয়। দুটি চেয়ার আর একটি ছোট টেবিল আছে। কাজ থেকে ফিরে সন্ধ্যায় ওরা বারান্দায় বসে চা খায় আর নানা গল্প করে। ওদের প্রতিদিনের হ্যাপি আওয়ার। বাসাটা নদীর দিকে মুখ করা। সারাক্ষণ নদী থেকে ধেয়ে আসে পরাগ–ছড়ানো বাতাস। সোহেল নদীর পাড়ে পার্কটাতে নিয়ম করে সকালে হাঁটতে যায়।

প্রেম ও দাম্পত্যে সংশ্লিষ্ট দুই পক্ষকেই দায়িত্ব নেওয়ার চর্চা করতে হবে। ছবিটি প্রতীকী
ছবি: কবির হোসেন

পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদ। একদা চঞ্চলা। বৈশাখে শীর্ণ, হেঁটে নদী পার হওয়া যায়। তবু বর্ষায় পূর্ণযৌবনা। নদীটাকে বাঁধ দিয়ে শিকলে বাধা হয়েছে। শরতে জেগে উঠা চর শুভ্র কাশফুলে ভরে থাকে। বিবর্তন। নদীর সঙ্গে হাঁটলে একটা অন্য রকম অনুভূতি আসে—দেখা হয় চলমান জীবন। চলে খেয়া পারাপার। জেলেরা মাছ ধরে; নদীর পাড়েই ঝুপড়ি নিয়ে বসে যায়। কেউ আঙিনায় ফোটা হলুদ কুমড়ো ফুল নিয়ে বসে। কেউ ঘটিতে গরুর দুধ। সকালে হাঁটতে এসে অনেকেই টাটকা মাছ আর সবজি নিয়ে বাড়ি ফেরে। এই হলো নদীর সংসার।

সকালে হাঁটতে এসে দেখা হয় হিমাদ্রি কবিরাজের সঙ্গে। পার্কেই তার সঙ্গে পরিচয়। সত্তরের বেশি বয়স অথচ দেখলে বোঝা কঠিন। আজকাল মানুষ তো আর কবিরাজের কাছে যায় না। হিমাদ্রিবাবু পেট চালাতে কবিরাজির সঙ্গে হোমিওপ্যাথিও করেন; যদিও কবিরাই তার মূল পেশা বা নেশা। শীত, গ্রীষ্ম, বর্ষা পার্কে হাঁটতে আসেন। বৃষ্টির দিনে ছাতা হাতে। সোহেলকে দেখলেই কথা বলতে চান। সোহেল মাঝেমধ্যে বসে। দুই প্রজন্ম। হিমাদ্রি কবিরাজের কাছে পুরোনো দিনের গল্প শোনে।

সোহেল কি হিমাদ্রিবাবুর কাছে বলবে? সোহেল জড়তা কাটাতে পারে না। ইদানীং ওকে একটা ভয় চেপে ধরেছে। কয়েক মাস থেকে কোথাও তার একটা সমস্যাটি হচ্ছে—অন্তিম মুহূর্তে হঠাৎ চুপসে যাচ্ছে সে। কিছু একটা ওকে আচ্ছন্ন করছে। গভীর তৃপ্তি থেকে বঞ্চিত হচ্ছে নিধি। আবার সে নিধির ভালোবাসায় ডুব দিতে চায়, কিন্তু পারে না। কয়েক মাস ধরে বহুবার চেষ্টা করেছে সোহেল। জোর করে যে কিছু একটা করতে চেয়েছে, তা–ও নয়।

নিধি তো এখনো আগের মতোই আকর্ষণীয় আছে। বরং নিধির আড়ষ্টতা আগের চেয়ে অনেক কেটেছে। এখন ছন্দ মেলাতে তার কোনো অসুবিধা হয় না। ডাক্তারের সঙ্গেও কথা বলেছে। কয়েকটি টেস্টের পর বলেছেন, সব ঠিক আছে। এ রকম হতে পারে। ভয়ের কিছু নেই। ঠিক হয়ে যাবে। সেদিন বিছানা ছেড়ে উঠতে উঠতে নিধি বলল, কী বিশ্রী একটা ফিলিংস! আমার ভালো লাগছে না। কথাটা সোহেলের লেগেছে।
আজ বৃষ্টির সকাল। মেঘে মেঘে আকাশ ভরা। অন্ধকার করে, থেমে থেমে বৃষ্টি আসছে ঝমঝমিয়ে। সঙ্গে এলোমেলো দমকা বাতাস। বর্ষার বৃষ্টি। টিভিতে বলছিল নিম্নচাপের প্রভাবে বৃষ্টি নামবে। বৃষ্টি কয়েক দিন চলতে পারে।

সোহেল আজও আর চোখে নিধিকে দেখছিল। আজ কি নিধি ইচ্ছা করেই ওকে দেখছে না? চোখ তুলে সোহেলের দিকে তাকিয়ে বলে, সিনেমা শেষ? নিধির চটুল মন্তব্যে হকচকিয়ে যায় সোহেল। নিধি কাছে আসে, কোনো ভূমিকা না করেই বলে, আজ স্কুলে যেতে ইচ্ছা করছে না। তুমিও অফিস বাদ দাও। ফোন করে দাও। আজ খুব অন্য রকম লাগছে। ইচ্ছা করছে সারা দিন তোমার সঙ্গে থাকি। বারান্দায় দুজনে বৃষ্টিতে ভিজি। তোমার আদর খাই। ওদের বিয়ে হয়েছে মাত্র তিন বছর। এখনো কোনো বেবি হয়নি। সেই হিসাবে এখনো বলতে গেলে হানিমুন সময় চলছে। অসময়ে নিধির এমন আমন্ত্রণ সোহেলকে অবাক করে। নিধি সোহেলের গা ঘেঁষে দাঁড়ায়। নিধি পেছন থেকে সোহেলকে কাছে টেনে নেয়।

সোহেল ভয় পায়। অফিসে জরুরি একটি কাজের অজুহাত দিয়ে বলে, খুব জরুরি কাজ, অফিস যেতেই হবে। তবে রাতে তোমার জন্য একটি সারপ্রাইজ আছে। আসলে সোহেল এড়িয়ে যেতে চাইছিল। পেছন থেকে সোহেলকে জড়ানো অবস্থাতেই নিধি বলে, ভয় পাচ্ছ কেন সোহেল। আমার সিনিয়র সহকর্মী ডলি আপার সঙ্গে কথাটা বলেছিলাম। আমরা কিছুদিন একটু পৃথক থাকলে নাকি সমস্যাটা মিটে যাবে। আমি ভাবছি কয়েক দিনের ছুটি নিয়ে মায়ের বাড়ি থেকে বেড়িয়ে আসব।

কথাটায় সোহেলের খুব মন খারাপ হয়। বিয়ের পর থেকে দুজনে কখনো আলাদা থাকেনি। এমনকি সোহেল অফিসের কাজে গেলেও নিধিকে সঙ্গে নিয়েছে। কাজের শেষে দুজনেই এক্সট্রা কয়েকটি দিন নতুন জায়গায় কাটিয়েছে। কদিন আগেও চাঁদনি রাতে লঞ্চে করে বরিশাল গেছে। দামি কেবিনের বারান্দায় বসে রাতের জোছনা দেখেছে। সে রাতও তারা বৃথা যেতে দেয়নি। সোহেল আদরে আদরে পাগল করেছে নিধিকে।

বৃষ্টির বেগ বাড়তে থাকে। দমকা হাওয়ায় পর্দা উড়ে যায়। বৃষ্টির ছাট এসে দুজনকে ভিজিয়ে দেয়। ভেজা কাপড়ে সোহেল নিধিকে জাপটে ধরে থাকে। সোহেলের হাত চঞ্চল হয়ে ওঠে। কতটা সময় যায়, ওরা টের পায় না। জানালা–দরজা সব খোলা থাকে। প্রকৃতির চঞ্চলতার সঙ্গে যোগ হয় ওদের খেলা। ভেজা ফ্লোরে দুজনের শীত শীত করতে থাকে। নিধির ভেজা শাড়িটা সোহেলের শরীরের ওপর দিয়ে দেয়—মুক্ত পোশাকহীন পৃথিবীর আদিম মানব–মানবি ওরা।

লেখক: আবদুল্লাহ জাহিদ, ব্যবস্থাপক, কুইন্স লাইব্রেরি, নিউইয়র্ক, আমেরিকা। [email protected]