প্রিয় বাবা

প্রিয় বাবা,
আজ থেকে দুই বছর আগে ঠিক আজকের এই দিনে তুমি আমাদের ছেড়ে পরলোকে পাড়ি জমিয়েছ। মৃত্যুর কিছুক্ষণ আগে যখন তোমার গুরুতর অসুস্থতার (হার্ট অ্যাটাক) কথা প্রথম জানতে পারি, তখন কানাডায় নিজ বাসায় কম্পিউটারে বসে কাজ করছিলাম। সঙ্গে সঙ্গে সে সময় ইতালিতে অবস্থানরত বড় ভাইয়ের সঙ্গে কথা বলে ঢাকায় বেসরকারি এয়ার অ্যাম্বুলেন্স কোম্পানিগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ করি। যত দূর মনে পড়ছে, এয়ার অ্যাম্বুলেন্স কোম্পানিগুলো জানায়, সরকারের অনুমতি না থাকায় বিকেল ৫টার পর তারা অ্যাম্বুলেন্স সেবা দিতে পারে না। যখন আমি তাদের সঙ্গে কথা বলছিলাম তখন রাত ৯টার বেশি। আমি একটি কোম্পানির সঙ্গে পরদিন সকালে তাদের সার্ভিস নেওয়ার ব্যাপারে কথাবার্তা ফাইনাল করি। কর্তৃপক্ষ জানায়, সরকারি অফিস সংক্রান্ত কিছু কাজ শেষে সকাল সাড়ে ১০টা নাগাদ তারা ঢাকা থেকে রওনা হতে পারবে। সে সময় দেশে অবস্থানরত তোমার মেজ ছেলে ইতিমধ্যে তোমাকে অ্যাম্বুলেন্সে নিয়ে সড়কপথে শ্যামনগর হতে খুলনা রওনা হয়ে গেছে। আমাদের সৌভাগ্য, তোমার একটি সন্তান (তিনিও বেশির ভাগ সময় মূলত ইতালিতে থাকেন) সে সময় তোমার সঙ্গে ছিল এবং যে কিনা তার সবটুকু হৃদয় ও শতভাগ আন্তরিকতা দিয়ে তোমাকে বাঁচিয়ে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করে গেছে।
খুলনাগামী অ্যাম্বুলেন্সে অবস্থানরত মেজ ভাইকে ঢাকায় এয়ার অ্যাম্বুলেন্স কোম্পানির সঙ্গে কথাবার্তা চূড়ান্ত করার বিষয়টা জানালাম। সে সময় ইতালিতে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত বড় ভাই ও আমি প্রতি মুহূর্তে যোগাযোগের মধ্যে ছিলাম। পরবর্তী ঘণ্টা দু-একের মধ্যে বাংলাদেশ থেকে তোমার মৃত্যু সংবাদ আমাদের কাছে চলে আসে। খুলনাগামী অ্যাম্বুলেন্সের মধ্যে এত নিঃশব্দে, এত নীরবে তুমি আমাদের সবাইকে ছেড়ে চলে গিয়েছিলে যে, তোমার হাত ধরে বসে থাকা মা ও মেজ ভাই কেউই বুঝে উঠতে পারিনি যে তুমি ততক্ষণে আমাদের সবাইকে ছেড়ে পরলোকে পাড়ি জমিয়েছ। তোমার প্রস্থান ছিল এত নীরবে, এত নিভৃতে!
তোমার মৃত্যু সংবাদ পাওয়ার পর আমি হতবিহ্বল হয়ে পড়ি। আমার নিজের পৃথিবীটা যেন ওলটপালট হয়ে যাচ্ছিল। এক অসহনীয় দুঃখ, কষ্ট ও বেদনা আমাকে গ্রাস করে। বাবা, আমার বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছিল, এতটা আকস্মিকভাবে তুমি আমাদের ছেড়ে চলে যেতে পার। দুই মেয়ে স্কুলে, আমার স্ত্রী তখন তার অফিসে। বাসায় একা আমি ফিরে যাই কমপক্ষে এখন থেকে ৩৫ বছর আগে। এই পুরোটা সময়ে তোমার সঙ্গে কাটানো স্মৃতিময় মুহূর্তগুলো তাৎক্ষণিক আমার কল্পনার জগতে স্পষ্ট ছবির মতো ভেসে উঠে। শত শত হাজার হাজার সেসব স্মৃতিছবির মধ্যে অত্যন্ত দুর্বার ও সীমাহীন গতিতে আমি হাতড়াতে থাকি, খুঁজে ফিরি তোমার সান্নিধ্যে আমার একান্ত স্মৃতিময় মুহূর্তগুলো। বাবা, তুমি বিশ্বাস করো, কত শত সহস্র এমন অমূল্য স্মৃতি আমার কল্পনায় গভীরভাবে ধরা দেয়। আমি সারা জীবন বিশ্বাস করে এসেছি, বাবা-মা–ই তার সন্তানের কাছে সর্বশ্রেষ্ঠ সম্পদ যার সঙ্গে পৃথিবীর কোনো কিছুর তুলনা চলে না। বাবা-মায়ের মতো এত নিঃস্বার্থভাবে কেউ তার সন্তানকে ভালোবাসতে পারে কিনা তা আমার জানা নেই। তোমার চার সন্তানকে সমাজে শিক্ষা, সম্মান নিয়ে বড় হতে দেখার স্বপ্নে ও তাদের মঙ্গলের জন্য যে সীমাহীন শ্রম তুমি দিয়েছ ও অসীম ত্যাগের দৃষ্টান্ত রেখে গেছ, তা আমাদের কাছে এক অমূল্য সম্পদ ও অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত। তুমি তোমার জীবনের যে আদর্শ আমাদের সামনে রেখে গেছ তা আমরা সব সময় সযত্নে লালন করেছি।
বিশ্বাস করো বাবা, যে বাবা-মায়ের প্রতি আমার আন্তরিকতা ও ভালোবাসাকে আমি সব সময় আমার জীবনের থেকেও বড় করে দেখে এসেছি, সেই আমি তোমার মুখখানি শেষবারের মতো দেখার শক্তি পুরোপুরিই হারিয়ে ফেলেছিলাম। তোমার জানাজা ও দাফন শেষে মেজ ভাই সে সময়ে ধারণ করা অসংখ্য ছবি ইমেইলে আমাকে পাঠান। গত দুই বছরে ওই ছবিগুলো দেখার মতো মানসিক শক্তি আমি আজও অর্জন করতে পারিনি। সামাজিক যোগাোযোগ মাধ্যমে ভাই ও আত্মীয়স্বজনরা কখনো তোমার ছবি পোস্ট করলে আমি যত দ্রুত সম্ভব কম্পিউটারের স্ক্রিন থেকে আমার দৃষ্টিকে সরিয়ে ফেলি।
বাবা, ছোটবেলা থেকে তোমার সততা, দৃঢ় ব্যক্তিত্ব, নিজ পরিবারের প্রতি গভীর আনুগত্য, ভালোবাসা ও তোমার বিশাল হৃদয় আমাকে প্রতিটি মুহূর্তে গর্বিত ও মুগ্ধ করেছে। শূন্য থেকে জীবন শুরু করে শুধু অক্লান্ত পরিশ্রম ও নিজের প্রতি প্রচণ্ড আত্মবিশ্বাস রেখে আমাদের লেখাপড়া শিখিয়ে সমাজে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর মূলভিত্তি তুমিই তৈরি করে দিয়েছ। আজ পর্যন্ত আমার জীবনে আমি যত মানুষের সঙ্গে পরিচিত হয়েছি তার মধ্যে তোমাকে সব সময়ই আমার কাছে অত্যন্ত সাহসী, দৃঢ়চেতা ও প্রগাঢ় ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মনে হয়েছে। তোমার চরিত্রের এই অনুকরণীয় দিকগুলো প্রতি মুহূর্তে আমি আমার জীবনে গভীরভাবে ধারণ করার চেষ্টা করেছি। তোমার ব্যক্তিত্বের দৃঢ়তা ও সাহস আমাকে প্রতি মুহূর্তে অনুপ্রেরণা জোগায়।
৮০ বছরের কিছু বেশি সময়ের জীবিতকালে শত শত মানুষকে তোমার প্রতি অগাধ ভালোবাসা, শ্রদ্ধা ও আন্তরিকতায় সব সময় মুগ্ধ থাকতে দেখেছি। বাবা, আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় তুমি রাজাকারদের হাতে অনেকবার শারীরিকভাবে নিগৃহীত হয়েছ। তোমার পিঠে থেকে যাওয়া সে রকম দু-একটা নির্যাতনের চিহ্ন তুমি তোমার জীবনের শেষদিন পর্যন্ত বহন করেছ। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে মুক্তিযোদ্ধাদের সক্রিয়ভাবে সাহায্য ও সহযোগিতা করার জন্য তুমি অনেকবার জীবনের ঝুঁকি নিয়েছিলে।
বাবা, তোমাকে হারিয়ে আমাদের জীবনে এক বিরাট শূন্যতা তৈরি হয়েছে যা কখনোই পূরণ হওয়ার নয়। আজ তুমি আমদের মাঝে নেই, বারবার মনে হয় কেন তোমার জন্য আরও বেশি কিছু করতে পারিনি। তোমার জন্য এক বিরাট হৃদয় ধারণ করতাম আমরা তোমার সব সন্তানেরা। মাঝে মাঝে আমার মনে হয়, তোমার প্রতি তোমার সন্তানদের যে বিশাল আন্তরিকতা, শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা ছিল তা তোমার জীবিতকালে তুমি কতটুকু অনুভব করতে পেরেছিলে। তুমি যদি পুরোপুরি অনুধাবন নাও করে থাকো, তবু আমি বিশ্বাস করি সৃষ্টিকর্তা ঠিকই আমাদের মনের কথা জানতেন এবং এখনো জানেন। আমি জানি পৃথিবীর সবাইই সৃষ্টিকর্তার কাছে ফিরে যেতে হবে, ফিরে যাব আমি, আমরা সবাই কিন্তু তবুও তোমাকে হারানো আজও মেনে নিতে পারি না।
আমার জীবনের অন্তিম ইচ্ছার কথা কি তুমি জানো, বাবা? অন্তিম শয়ানে আমি তোমার খুব কাছাকাছি থাকতে চাই। তোমার পাশে চিরনিদ্রায় থাকতে পারাটাই হবে আমার জীবনের একমাত্র শেষ চাওয়া। কানাডায় পিএইচডি গবেষণারত খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমার এক বন্ধু কয়েকদিন আগে তার বাবার স্মৃতিচারণে ফেসবুকে লিখেছিল, ‘বাবা তোমার ডাকের অপেক্ষায় আছি’। আমার বন্ধুর মতো আমিও সব সময় তোমার ডাকের অপেক্ষায় থাকব। বাবা, তুমি ভালো থেকো। যত দিন বাঁচব একটি মুহূর্তও তোমাকে ভুলে থাকার নয়। মহান সৃষ্টিকর্তার কাছে তোমার আত্মার শান্তি কামনা করি।

(ড. এস এম বজলুর্ রহমান, অধ্যাপক হিসেবে ফিশারিজ অ্যান্ড মেরিন রিসোর্স’ টেকনোলজি ডিসিপ্লিন,খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত ছিলেন। বর্তমানে কানাডার সাস্কাতুন শহরে বসবাসরত। )