প্রসঙ্গ: সাস্কাতুনে বাংলাদেশি কমিউনিটির নির্বাচন

ভোটের পর
ভোটের পর

তিন সপ্তাহ আগের কথা। শুভ্র বরফের চাদরে ঢাকা সাস্কাতুন শহরে প্রচণ্ড ঠান্ডায় জবুথবু সবকিছু। বরফে জমে গেছে গাছপালা, নদী আর লেক। প্রয়োজন ছাড়া কেউ বাসার বাইরে যায় না। এই শীতল ঠান্ডায় তখন উষ্ণ ছিল শুধু বাঙালি কমিউনিটি। কারণ বাংলাদেশি কমিউনিটির সংগঠন বিকাশের নির্বাচন। এই নির্বাচন হয়ে গেল গত ২৫ নভেম্বর। দুই প্যানেলে দাঁড়িয়েছিলেন মোট ১৬ জন প্রার্থী। বিপুল ভোটে কামনাশীষ দেবের প্যানেলের ছয়জন এবং বাকি দুজন অন্য প্যানেল থেকে—মোট আটজন বিজয়ী হয়েছেন।

এই নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ভোটের আগে ব্যাপক প্রচারণা হয়েছিল। প্রথমে আমাদের সাধারণ ভোটারদের কাছে মজা করার পর্যায়ে ছিল এই নির্বাচন। তবে ভোট প্রার্থীরা ছিলেন ভীষণ সিরিয়াস। তারা বাংলাদেশি কমিউনিটিতে কাজ করার বিভিন্ন প্রতিশ্রুতি নিয়ে বাড়ি বাড়ি ঘুরেছেন। দুই পক্ষই ছিল চরম আশাবাদী। যদিও বিজয়ী হবে একটি প্যানেল। কমিউনিটির লোকজন ভীষণ উত্তেজিত। শহর তখন দুই দলে বিভক্ত। একদল সহযোগিতা করছে কামনাশীষ দেবের প্যানেলকে। অন্য দল ছিল নুরুল হুদা পলাশের সঙ্গে। দুজনই কমিউনিটিতে পরিচিত ও জনপ্রিয় মুখ।

গণনার সময় অপেক্ষায় সমর্থকেরা
গণনার সময় অপেক্ষায় সমর্থকেরা

তুমুল উত্তেজনা, ঝগড়া, ইমেইল যুদ্ধ, ব্যক্তিগত আক্রমণ কোনো কিছুই বাদ ছিল না। প্রার্থীদের প্রচারণায় ছিল নতুনত্ব। ফেসবুকে একদল নির্বাচনী অঙ্গীকার দিল তো অন্য দলও সঙ্গে সঙ্গে তাদেরটা পোস্ট করল। একদল সকালে ভিডিও বার্তা দিল তো অন্য গ্রুপ বিকেলের মধ্যে তাদের ভিডিও বার্তা পোস্ট করল।
ভোটের রাজ্যে তুরুপের তাস ছিল সাসকাচেওয়ান ইউনিভার্সিটির ছাত্র-ছাত্রীরা। ভোট ব্যাংকে তারা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। দুই দলই তাদের নির্বাচনী ইশতেহার নিয়ে তাদের কাছে হাজির হয়। সঙ্গে বিপুল খাওয়া-দাওয়া। আবার সেই হিন্দু-মুসলমান বিতর্কও কম হলো না। একজন সভাপতি প্রার্থী যেহেতু হিন্দু ছিলেন, সে কারণে একজন হিন্দুকে মুসলমান হিসেবে ভোট দেওয়া কতটুকু ধর্মসম্মত সে প্রশ্নও উঠেছিল। দুই-এক জায়গায় ইসলামি জলসাও হলো নির্বাচনী প্রচারণার অংশ হিসেবে।
ভোট ব্যাংক হিসেবে বিবেচনায় এল এলাকাভিত্তিক ভোটার। এর মধ্যে অন্যতম সিলেটী এবং নোয়াখালীর ব্যবসায়ী, নদীর পূর্ব পাশে যারা তারা পূর্ব ও নদীর পশ্চিম পাশে তার পশ্চিম এবং নতুন-পুরোনো। চলল ছোট ছোট গ্রুপে পার্টি ও খাওয়া-দাওয়া। সেখানে নির্বাচনী প্রচারণা, ভোটের হিসাব-নিকাশের সঙ্গে ভূরিভোজ, হাসাহাসি কম হলো না। নারীরা দামি শাড়ি, পুরুষেরা সুটেড-বুটেড হয়ে সে সব পার্টির ঔজ্জ্বল্য আরও বাড়িয়ে দিলেন।
প্রার্থীদের নির্বাচনী খরচও কম ছিল না। পোস্টার ছাপানো, লিফলেট তৈরি, ভোটার নিবন্ধন, খাওয়া-দাওয়া, ভোটারদের গাড়ি দিয়ে ভোটকেন্দ্রে আনা-নেওয়াসহ নির্বাচনী খরচ কমপক্ষে হাজার দশেক ছাড়িয়ে গেল। প্রার্থী নিজে, বিভিন্ন ব্যবসায়ী গ্রুপ, কর্মীরা ডোনেট করে এই নির্বাচনী ব্যয়ভার বহন করলেন।
অন্য সবার মতো আমার পরিবারও এই নির্বাচনের ব্যাপারে ছিল ভীষণ উত্তেজিত। বিশেষ করে বাংলাদেশ থেকে আসা আমার ছোট বোনের স্বামী শাহিন। সে বাংলাদেশ থেকে এসেছে বছর খানিক। এখনো বাংলাদেশকে ভুলতে পারেনি একদম। দেশের জন্য মন কেমন করে। ওর জন্য এই নির্বাচন যেন এক আনন্দ বার্তা বইয়ে নিয়ে এসেছে। প্রথম দিকে তার এক বন্ধু তাকে নিয়ে গেল এক দলের ক্যাম্পেইনে। সে মোটামুটি কনভিন্স হয়ে এল। পরদিনই আরেক বন্ধু ফোন করে বলল, তুমি এটা কী করলে। আমিতো অমুক দলের হয়ে কাজ করছি। তুমি আমাদের হয়ে কাজ করো। শাহিন তখন মহা বিপদে। শ্যাম রাখি না কুল রাখি।
আমাকে বলল, আপা কি করি বলেন তো?

সভাপতি পদে বিজয়ী কামনাশীষ দেব
সভাপতি পদে বিজয়ী কামনাশীষ দেব


মজা করে বললাম, তুমি দুই দলের মিটিং মিছিলেই যাও। তোমাকে তো কেউ চেনে না।
সে লাজুক হেসে বলল, তাই কী হয়?
হেসে বললাম, তাহলে আর কী করা, চুপ করে ঘাপটি মেরে বসে থাক।
নির্বাচন বলে কথা। ঘাপটি মেরে বসে থাকতে বললেই কি থাকা যায়? প্রার্থীদের ফোন আসছে দিন-রাত। প্রার্থী বাসার দরজায় কড়া নাড়ছেন সস্ত্রীক—‘ভোটটা কিন্তু আমাকেই দিতে হবে। আমি হচ্ছি আপনার কাছের লোক।’
কথা কিন্তু মিথ্যা নয়। ছোট্ট একটা শহর সাস্কাতুন। বাঙালির সংখ্যা প্রায় সাড়ে তিন থেকে চার হাজার। এর মধ্যে ভোটার প্রায় বারো শ। সবাই সবাইকে চেনে। ঈদ, পূজা দলবেঁধে সবাই একসঙ্গে করেন। হিন্দু-মুসলমানের অসাম্প্রদায়িক ঐক্য। সবাই বাঙালি, এটাই বড় পরিচয় যেন।
কিন্তু নির্বাচনকে কেন্দ্র করে কমিউনিটি দুই দলে বিভক্ত। বাসায় চায়ের আড্ডায় আমরা কে জিতবে কে হারবে তা নিয়ে তুমুল ঝড় তুলতে লাগলাম। কে কত ভোটে জিতবে, ভোট ব্যাংক কতগুলো ইত্যাদি। কখনো কথা-কাটাকাটি, রাগারাগি ছোটখাটো মান অভিমানও বাদ গেল না।
ছোট বোন শীলা বলল, এত দেখি বাংলাদেশের নির্বাচনকেও হার মানাচ্ছে। বাংলাদেশে তবু জিতলে ক্ষমতা, টাকাপয়সা পাওয়া যায়। এখানে কমিউনিটির প্রেসিডেন্ট হয়ে কি প্রাপ্তি?
এই প্রশ্নের উত্তরে আমরা পুরোনো সাস্কাতুনবাসী হিসেবে ঝাঁপিয়ে পড়লাম—কী বলিস! মঞ্চে উঠে বক্তৃতা দেওয়া, পার্টিতে দাওয়াত, লোকজনের কাছে সম্মান ইত্যাদি তো বাঙালির রক্তে মিশে আছে।
এর মধ্যে ঘটে গেল আরেক ঘটনা। প্রাক্তন এক প্রেসিডেন্ট কমিউনিটির দলীয় ইমেইলে একপক্ষের জন্য ভোট চাইলেন। কিন্তু তিনি তার ইমেইলে অন্যপ্রার্থীকে হেয় করে তুলনামূলক এক আলোচনার সূত্রপাত করেছেন বলে অন্য পক্ষ অভিযোগ করল। সাধারণ মানুষের মনে তীব্র ক্ষোভের আগুন জ্বলে উঠল কমিউনিটিতে। শুরু হলো ইমেইল চালাচালি। কিছুক্ষণ পরপর সবাই মোবাইল টিপতে লাগল, যদি গ্রুপ ইমেইলে কোনো নতুন ইমেইল আসে। ইমেইল চালাচালিতে আমার ঘরেও শুরু হলো তীব্র উত্তেজনা। এজাজের কাছে ঘন ঘন ফোন আসতে লাগল নিরপেক্ষ হয়ে একটি লেখা ছাপানোর জন্য।
আচ্ছা ভোটের ময়দানে কি বাঙালি নিরপেক্ষ হতে পারে?
এরপর এল সেই প্রতীক্ষিত ভোটের দিন। সকাল থেকেই লোকে লোকারণ্য ভোটকেন্দ্র। ওখানে হাসছে সবাই। জোরে কথা বলছে। কেউ কেউ ঘেমে নেয়ে একাকার। বাঙালিদের যেন বিশাল এক উৎসব সেদিন। সবাই সেজেগুজে ভোট দিতে এসেছেন। সবার চোখে-মুখে উৎসাহ, উৎকণ্ঠা, আনন্দ মিলে মিশে যেন ছোট্ট বাংলাদেশ হয়ে গেছে মেসি স্কয়ারের এই ছোট্ট চার্চটা।
অবশেষে সকল আগ্রহ উৎকণ্ঠার অবসান ঘটিয়ে মধ্যরাতে ঘোষণা করা হলো ফলাফল। অবশেষে চরম উত্তেজনা, অস্থিরতা কাটিয়ে জনগণের বিপুল ভোটে জয়ী হলেন কামনাশীষ দেব। তার প্যানেলে শুধু দুজন পরাজিত হলেন।
পরাজিত পক্ষ হেরে গিয়ে যদিও বলল না, সূক্ষ্ম কারচুপি। তবে তারা কিছুতেই এই পরাজয়কে মানতে মানসিকভাবে রাজি নয় যেন। আবারও শুরু হলো টেকনিক্যাল যুদ্ধ। শুরু হলো ফেসবুকে কিছু কুৎসিত কবিতা, মন্তব্য ও আক্রমণ। চলল ইমেইল চালাচালি। তবে পরাজিত পক্ষের দুই-একজন এ বিষয়ে বেশি আগ্রাসী ছিলেন। তারা জয়ী দলের সমর্থকদের ব্যক্তিগতভাবে আক্রমণ করা শুরু করলেন। ঠান্ডার শহরে উত্তেজনা জ্বালাও-পোড়াওয়ের পর্যায়ে না হলেও কম নয় যেন। একজন আরেকজনকে আঘাত দিয়ে যাচ্ছেন, নোংরা মন্তব্য লিখছেন। এ যেন আমাদের সেই পরিচিত রাজনীতি, রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, ব্যক্তিকে অসম্মান করার মানসিকতা—আমার পুরোনো চেনা বাংলাদেশি সংস্কৃতি। যে ভোটের মাঠ, নির্বাচনী প্রচারণা আনন্দের ছিল, উত্তাপের ছিল, সেটি চরম কাদা ছোড়াছুড়িতে রূপান্তরিত হলো।
এত কিছুর মাঝে একদল ছিল ভীষণ অনাগ্রহী ও চুপচাপ। তারা আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম। তাদের কথা বলে শেষ করতে চাই এই আলোচনা। এই প্রজন্ম যারা বড় হচ্ছে এই দেশে তারা ভীষণ বিরক্ত হয়ে ভোটদান কিংবা ভোটের মাঠ বয়কট করল। যেমন আমার কন্যা রোদেলার বান্ধবী সেজুতিকে অনেক অনুরোধ করেও ভোটকেন্দ্রে নেওয়া গেল না। রোদেলা আঠারো হয়নি বিধায় ভলান্টিয়ারে নাম লিখিয়েছিল। সেও ঘোষণা দিল, যাবে না।

সপরিবারে লেখিকা
সপরিবারে লেখিকা

ভোটের দুই দিন পর ওকে একা পেয়ে, একটু রেগেই বললাম কেন তুমি যাওনি? কেন যাবে না, কমিউনিটির প্রোগ্রামে?
—কেন শুনতে চাও?
—হ্যাঁ বলো?
সোফার কোণায় বসে তার প্রিয় কুকুর ওকলির মাথায় হাত বোলাচ্ছিল সে। শান্ত চোখে বলল, আমাদের স্কুলে যখন নির্বাচন হলো আমরা পাঁচজন প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী ছিলাম জানো তো? তাদের মধ্যে আমি আর শ্যাম পাস করেছি। যখন ভোটের রেজাল্ট দিচ্ছিল আমরা পাঁচজন প্রতিদ্বন্দ্বী শক্ত করে হাত ধরাধরি করে গোল হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলাম। ভোটের রেজাল্ট যখন হলো, তখন বাকি তিনজন, যারা পাস করেনি কান্নায় ভেঙে পড়ল।
আমি অবাক চোখে, মুগ্ধ হয়ে শুনছিলাম। আমাদের নতুন প্রজন্মের কথা।
জিজ্ঞেস করলাম, তারপর কি হলো?
ছলছল চোখে রোদেলা বলল, আমারও ভীষণ কান্না পাচ্ছিল আম্মু। আমি পাস করে আনন্দের পরিবর্তে কষ্ট পাচ্ছিলাম। ওদের জন্য ভীষণ কষ্ট হচ্ছিল। ওদেরকে জড়িয়ে ধরে আমরা পাঁচজন একসঙ্গে কাঁদতে থাকলাম। অনেকক্ষণ কাঁদলাম, যতক্ষণ না ওরা শান্ত হয়।
—ওরা তোমার সঙ্গে এখন কথা বলে?
—হ্যাঁ অবশ্যই বলে। আমরা এখনো অনেক ভালো বন্ধু। মেয়ে একটু থামল, আমার দিকে দুই চোখ মেলে তাকিয়ে আবারও বলল, আমরা তোমাদের মতো অত ড্রামাটিক নই। তোমাদের ওই বাঙালি ভোটের সংস্কৃতি আমার ভালো লাগেনি। আমরা সব সময় অন্যের অনুভূতি ও পছন্দকে সম্মান করি। আমরা তোমাদের মতো অন্যকে এত বাজেভাবে আঘাত করি না। এটা মানবিক নয়।
মেয়েটা চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলে সব সময়। ওই চোখের ভাষা আমি পড়তে ভয় পেলাম। এ দেশে বড় হওয়া বাচ্চারা সত্যি কথা বলতে ভয় পায় না। তারা কাউকে ছেড়ে কথা বলে না। তাই আমি আমার বাঙালি ভোটের সংস্কৃতি নিয়ে আর কথা বলতে চাইলাম না। চুপ করে রইলাম। সব সময় চেষ্টা করেছি সন্তানের কাছে নিজের দেশ, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে বড় করে উপস্থাপন করতে। এই সামান্য ভোটের কারণে মেয়ের কাছে আর সেটা নষ্ট করতে চাই না বলে চুপ করে রইলাম।
কদিন ধরে ঠান্ডা কমেছে। বরফগুলো গলতে শুরু করেছে। রাস্তাঘাট, বাড়িঘর সবকিছু সোনালি রোদ্দুরে ঝলমল করছে। আশা করি প্রকৃতির মতো বদলে যাবে সাস্কাতুন বাংলা কমিউনিটির পরিবেশ। বরফের মতো গলে যাবে সবার ক্ষোভ, রাগ, প্রতিহিংসা। আবার শহরটা এক শহরে পরিণত হবে। আবার হিন্দু, মুসলমান, খ্রিষ্টান সবাই মিলে নতুন করে সৌহার্দ্য আর সম্প্রীতির বন্ধনে আবদ্ধ হবে।। আমাদের সন্তানদের কাছে মানবিকতার, সাম্প্রদায়িকতার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন হবে।

ভিকারুন নিসা: সাস্কাতুন, সাসকাচেওয়ান, কানাডা।