প্রসঙ্গ বাংলা চলচ্চিত্র

কবে কখন কীভাবে বাংলা সিনেমা প্রীতি বা আসক্তি আমাকে স্পর্শ করেছে, সে দিন তারিখ মনে করে বলা মুশকিল। কিশোরগঞ্জ জেলার কটিয়াদী থানায় আমার জন্ম। ছেলেবেলাটা কেটেছে সেখানে। কটিয়াদী আমার তীর্থভূমি। আমার পরিবার রক্ষণশীল তবে ধর্মীয় গোঁড়ামি বা কুসংস্কারে বিশ্বাসী নয়। যারে যাবি যদি যা পিঞ্জর খুলে দিয়েছি গানটি আমি প্রথম শুনি আমার নানার কণ্ঠে। সন্ধ্যা তারার আলো-আঁধারির মাঝে আমি আমার মাকে অনেক দিন আবিষ্কার করেছি আমার সকল দুঃখের প্রদীপ জ্বেলে দিবস গেলে করব নিবেদন, আমার ব্যথার পূজা হয়নি সমাপন গানটি গেয়ে চোখের জলে বিলীন হয়ে যেতে।
আমার ছোটবেলায় প্রতি শুক্রবার বিটিভিতে দেখানো হতো বাংলা সিনেমা। অধীর আগ্রহে আমরা অপেক্ষায় থাকতাম, ঘোষক বা ঘোষিকা কখন বলবেন, বিকেল তিনটা ২০ মিনিটে আপনাদের জন্য থাকছে পূর্ণদৈর্ঘ্য বাংলা ছায়াছবি…। কটিয়াদী বাজারে কথাচিত্র ও মকুল নামে আমার নানাদের দুটো সিনেমা হল আছে। মুকুল সিনেমা হলটি আমাদের বাসার লাগোয়া আর বাসা থেকে ৫০০ গজ দূরত্বে ছিল কথাচিত্র। স্কুল ছুটির দিনে ও উৎসব-পার্বণে সিনেমা দেখা ছিল আমাদের অন্যতম বিনোদন।
চলচিত্রের স্বর্ণালি দিনে বাংলা সিনেমা দেখাকে শুধু বিনোদন বললে ভুল হবে, চিন্তা চেতনায়ও প্রভাব ফেলে অনেকখানি। ছুটির ঘণ্টা সিনেমাটির কথাই যদি বলি তা কখনো আমার স্মৃতিতে সুখের নয়, আর্তনাদ ও বিষাদের। সে ভয় এখনো আমাকে তাড়িয়ে বেড়ায়। অশিক্ষিত ছবি দেখে কতবার যে নিজেকে মাস্টার সুমন কল্পনা করেছি তার হিসাব নেই। কৈশোরে দিপু নাম্বার টু আমার মুগ্ধতা কেড়ে নিয়েছে। আরও পরে প্রেমে পড়েছি রাজ্জাক সালমান শাহকে স্বপ্নের নায়ক ভেবে। ষাটের দশক থেকে শুরু করে নব্বই দশক পর্যন্ত ঢাকার ছবির রমরমা বাণিজ্য ছিল। সেই সঙ্গে ছিল চলচ্চিত্রসংশ্লিষ্ট তারকা ও কলাকুশলীদের কর্মচাঞ্চল্য। এই সময়টুকুকেই মূলত চলচ্চিত্রের সোনালি যুগ বলা হয়।
নব্বই দশকের শেষের দিকে এসে সোনালি যুগের পতন শুরু। মুক্ত বাজারের ভোগসর্বস্ব সংস্কৃতির পরিণাম ভয়ংকর। দীর্ঘ গৌরবের পথ-পরিক্রমার বর্তমানে অশ্লীলতা ও ভাঁড়ামির প্রেক্ষাপটে অনেক প্রাচীন ও অভিজাত প্রেক্ষাগৃহ এখন বন্ধ হয়ে গেছে। রাজনৈতিক অস্থিরতা, ভারতীয় চলচ্চিত্রের অনুপ্রবেশ আর যৌথ প্রযোজনায় ক্রমাগতভাবে রিমেক সব চলচ্চিত্রের ভিড়ে বাংলাদেশি সিনেমার মৌলিকতা জৌলুস হারিয়ে প্রায় বন্ধ হওয়ার পথে। কোনো কোনো মালিক প্রেক্ষাগৃহের কাঠামো পরিবর্তন করে এখন বহুতল বিপণিবিতান বানিয়ে ভিন্ন ব্যবসায় যুক্ত হতে চাইছেন। এ রকম পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের চলচ্চিত্র নিয়ে আমাদের নতুন করে ভাবার ও সেই নিরিখে চলচ্চিত্রের গতিপ্রকৃতি নিয়ে নতুন দিকনির্দেশনা খুঁজে বের করার সময় এসেছে।
আজকাল অনেকেই এফডিসির বাংলা সিনেমা নিয়ে নাক সিটকান, অশ্লীলতার কথা বলেন। আবার ড্রয়িংরুমে বসে ঠিকই চলি কে পিছে ক্যায়া হে থেকে শুরু করে চিকনি চামেলি কোনোটাই দেখা বাদ দেন না। তারা পামেলা অ্যান্ডারসনের বেওয়াচ যেমন দেখেন, সানি লিওনের পর্নো কিংবা হিন্দি সিনেমাও অনেকে দেখতে ছাড়েন না। তাদের হয়তো জানা নেই উপমহাদেশের চলচ্চিত্র মূলত বাঙালিদের হাত ধরেই যাত্রা করে।
বাংলাদেশের মানিকগঞ্জে জন্মগ্রহণ করা হিরা লাল সেনের হাত ধরে ১৮৯৮ সালের দিকে বাংলা তথা উপমহাদেশের চলচ্চিত্রের গোড়াপত্তন। ১৯৫৫ সালে আবদুল জব্বার খানের মুখ ও মুখোশ দিয়ে বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের এক নতুন দিগন্ত শুরু হয়। ষাটের দশকে বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের একটা বিপ্লব ঘটল। এ সময়ে চলচিত্রের কিছু কীর্তিমান নির্মাতা তাদের মেধার দীপ্তি ছড়াতে লাগলেন। তাদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে রচিত হলো বাংলাদেশের চলচ্চিত্র সোনালি ইতিহাস। জহির রায়হান ও খান আতাউর রহমানরা অগ্রপথিক হয়ে রইলেন চলচ্চিত্র নির্মাতাদের কাছে। মানুষের মনের কথা, প্রাণের সঙ্গে প্রাণ মিলিয়ে যে ভাষা সুর বিশ্বব্যাপী সকল ভাষাভাষীদের আপ্লুত করে তা বাংলা ভাষা। ফলে এই সংকটকালেও আমরা পেয়েছি বিচিত্র বিষয়ের অনন্য সব চলচ্চিত্র। দেশে-বিদেশে অনেক পুরস্কার অর্জন করেছে আমাদের চলচ্চিত্র। এ সময়েই নির্মিত হয়েছে মনপুরার মতো অত্যন্ত জনপ্রিয় চলচ্চিত্র। সুভা, আয়না, ঘানি, মাটির ময়না, রানওয়ে, খেলাঘর, আমার বন্ধু রাশেদ, শঙ্খনাদ, ডুব সাঁতার, নিরন্তর, হাজার বছর ধরে, চন্দ্রগ্রহণ কিংবা আহা অথবা গেরিলার মতো ভালো চলচ্চিত্র। একমাত্র সুস্থধারার চলচিত্রই হচ্ছে সেই মাধ্যম। চলচিত্র এমন একটি মাধ্যম, যা দিয়ে নিজস্ব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দেওয়া সম্ভব। বিশ্ব দুয়ারে বাংলা চলচিত্র কথাটি বর্তমান সময়ে ঘুমন্ত চলচ্চিত্রপ্রেমীদের মগ্ন চৈতনে শিস বাজাবে। আমাদের চলচ্চিত্র শিল্পের স্বার্থে সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে সোনালি যুগের গৌরব পুনরুদ্ধারের লক্ষ্যে কাজ করার জন্য এগিয়ে আসা উচিত।
তবে এ দায় দর্শকের একার নয়। সরকার, পরিচালক, প্রযোজক, কলাকুশলী-শিল্পী সকলের। প্রযুক্তির কল্যাণে চলচ্চিত্রের ভাষা বদলে গেছে। বদলেছে নির্মাণের ধরন। এই ধরনটুকুর সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে জীবনঘনিষ্ঠ, মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক অথবা সামাজিক সংকটের চলচ্চিত্রের পাশাপাশি অপেক্ষাকৃত তরুণ পরিচালকেরা সাইকোলজিক্যাল থ্রিলার বা ব্যক্তিগত চলচ্চিত্র নির্মাণে আগ্রহী হয়ে উঠছেন। দেশের শীর্ষস্থানীয় দু-একজন নির্মাতাকে দেখা যায় বর্তমান প্রেক্ষাপটের দোহাই দিয়ে চলচিত্রের ভাষা, কাহিনির বারোটা বাজিয়ে দিতে। তাদের মাথায় থাকে না দেশের সামাজিক প্রেক্ষাপট বা পরিবার পরিজন নিয়ে সিনেমাটি উপভোগ করা যাবে কি না! আন্তর্জাতিক অ্যাওয়ার্ড ফেস্টিভ্যালই তাদের গন্তব্য। সিনেমা কেবল বাণিজ্য নয়। সিনেমা হতে পারে দেশজ প্রেমকাহিনি, ইতিহাস নির্ভর সামাজিক প্রেক্ষাপট ও আধুনিকায়নের ছোঁয়াসম্পন্ন। বাণিজ্যিক চিন্তা থাকবে, সেখানে শৈল্পিকতা থাকবে, রুচিশীলতা থাকবে, শিল্পীদের পোশাক পরিধান বর্তমান প্রজন্মকে আকৃষ্ট করতে হবে। বাংলা চলচ্চিত্র আমাদের গর্ব। বাংলা চলচ্চিত্রকে বিশ্ববাজারে উপস্থাপন করা সেই সঙ্গে বাংলাদেশকে প্রমোট করা। কিন্তু বাংলাদেশের চলচিত্রের ব্যবসায়িকভাবে সফলতা অর্জনের জন্য লড়াইটা বেশ চ্যালেঞ্জিং। কারণ আমাদের দেশে সরকার আর্ট ফ্লিমের জন্য আর্থিক অনুদান দিলেও বাণিজ্যিক সিনেমায় পৃষ্ঠপোষকতা করে না।
সব কিছু ছাপিয়ে বাংলা ভাষা আর বাংলা চলচিত্রকে ভালোবেসে অস্ট্রেলিয়াপ্রবাসী বেশ কয়েকজন চলচ্চিত্রপ্রেমী কাজ করছেন বিশ্ব দুয়ারে বাংলা চলচিত্র নিয়ে। কয়েক বছর আগে সিডনিতে প্রথমবারের মতো বাংলাদেশি চলচিত্র মনপুরা ও চোরাবালি প্রদর্শিত হয়। এরই ধারাবাহিকতায় অস্ট্রেলিয়ান ডিস্ট্রিবিউটর কোম্পানি অসবেন মিডিয়া সেন্টারের তত্ত্বাবধানে থার্ড পারসন সিঙ্গুলার নাম্বার, গহিনে শব্দ ও সর্বশেষ জিরো ডিগ্রি সিনেমার প্রিমিয়ার শো হয়েছে। তবে, ভারতীয় সিনেমার মতো তা সারা সপ্তাহজুড়ে প্রদর্শিত হয়নি। একটি নির্দিষ্ট সময়ে নির্দিষ্ট শো প্রদর্শনের মাধ্যমেই শেষ করতে হয়েছে।
উল্লেখ্যযোগ্য সংখ্যক নয়, তবুও একটি সিনেমা প্রদর্শনকালের সময় থেকে অন্যটির জন্য বছরখানেক অপেক্ষা করতে হয়েছে। অন্যদিকে ভারতীয় চলচিত্র সমগ্র অস্ট্রেলিয়া জুড়ে সপ্তাহব্যাপী চলে। অস্ট্রেলিয়ায় বসবাসকারী সকল কমিউনিটির দর্শকদের মুখে মুখে ভারতীয় সিনেমার উচ্চ প্রশংসা। ক্ল্যাসিফিকেশন বোর্ড ও দীর্ঘমেয়াদি নানা নিয়মকানুন মেনে সিডনিতে জিরো ডিগ্রির সাফল্যের এক মাসের মধ্যে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে শিহাব শাহিন পরিচালিত বাংলা চলচ্চিত্র ছুঁয়ে দিলে মন সিনেমার প্রিমিয়ার শো। ছবিটিতে অভিনয় করেছেন আরেফিন শুভ, জাকিয়া বারী মম, ইরেশ জাকেরসহ অনেকে৷ সার্বিক তত্ত্বাবধানে রয়েছে সিডনির টরিও ফিল্ম ইন্টারন্যাশনাল।
এই প্রতিষ্ঠানটি প্রায় দুই বছর ধরে চলচিত্র নিয়ে গবেষণা করছে। ছুঁয়ে দিলে মন তাদের প্রথম পরিবেশনা৷ উল্লেখ্য, ছবিটি বাংলাদেশে প্রায় চার সপ্তাহ ধরে মহাসমারোহে চলছে৷ গত ৯ মে নিউইয়র্কের বোম্বে থিয়েটারে পূর্ণ প্রেক্ষাগৃহ হয়েছে৷ বাংলাদেশ ও বাংলাদেশি কমিউনিটির জন্য এটি নিঃসন্দেহে গর্বের।
আন্তর্জাতিক ভাবে বাংলা চলচিত্রকে ছড়িয়ে দিতে প্রযোজনা সংস্থা বাসভূমি নির্মাণ করতে যাচ্ছে পূর্ণদৈর্ঘ্য বাংলা চলচিত্র। বাসভূমির কর্ণধার সিডনিপ্রবাসী পরিচালক, নাট্যকার আকিদুল ইসলাম জানান, আগামী জানুয়ারিতে চলচিত্রটির শুটিং শুরু হবে। অস্ট্রেলিয়ার বিভিন্ন শহরে চিত্রায়ণ হবে সিনেমাটির। বাংলাদেশের মূলধারার চলচ্চিত্রের জনপ্রিয় তারকাদের পাশাপাশি অস্ট্রেলিয়াপ্রবাসী অভিনেতা-অভিনেত্রীরা এতে অভিনয় করবেন। প্রযোজনা সংস্থা বাসভূমির পক্ষ থেকে জানানো হয়, চলচিত্রটির সম্ভাব্য নাম দরজা খোলো প্রিয়ন্তি। আগামী ৭ জুন সিডনিতে বাসভূমির ১২ বছর পূর্তি উৎসবে দরজা খোলো প্রিয়ন্তির শুভ মহরত অনুষ্ঠিত হবে।
বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে চলচ্চিত্রের অবস্থা ও অবস্থান শৈল্পিক ও কাহিনি নির্ভর হলে তা নতুন প্রজন্মকে ভাবাবে। ভবিষ্যৎ জীবনে তারা যেখানেই পড়ুক কিংবা যাই পড়ুক তা তাদের সুপথ দেখাবে। রোমানরা যেমন গ্রিক সভ্যতাকে পৃথিবীব্যাপী ছড়িয়ে দিয়েছিল, অ্যাসেরীয়রাও একই ধরনের ভূমিকা পালন করেছিল ব্যাবিলনীয় সভ্যতা বিশ্বময় ছড়িয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে। সেই ধারাবাহিকতায় বলতে চাই আমরাও পারি, আমরাও করব জয় একদিন...নিশ্চয়!
(১৬ মে ২০১৫)