প্রবীণদের অবহেলা নয়

বিশ্ব প্রবীণ দিবস ছিল ১ অক্টোবর। প্রবীণ মানে এক ঝাঁক সাদা চুলের অধিকারী ব্যক্তি হলেও তাঁরা কিন্তু অভিজ্ঞতায় ভরপুর, এক কথায় জ্ঞানের বাক্স। সেই জ্ঞানের বাক্স প্রবীণদের জানাই শ্রদ্ধা আর ভালোবাসা। সারা বিশ্বের মতো বাংলাদেশেও যথাযোগ্য মর্যাদা ও গুরুত্বের সঙ্গে দিবসটি পালিত হয়। সরকারের পাশাপাশি বিভিন্ন বেসরকারি-স্বেচ্ছাসেবী ও সমাজ উন্নয়ন সংস্থা পৃথক পৃথক কর্মসূচি গ্রহণের মাধ্যমে দিবসটি উদ্‌যাপন করে।

আমাদের দেশে সাধারণত কোনো ব্যক্তির ৬০ বছর পেরোলেই প্রবীণের ঘরে নাম লিপিবদ্ধ হয়ে যায়। আধুনিক চিকিৎসাব্যবস্থার কারণে গড় আয়ু বৃদ্ধি পাওয়ায় আমাদের বর্তমানে মোট জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক হয়ে উঠেছেন তাঁরা। জাতিসংঘের হিসাব অনুযায়ী, জন্মের পর বাংলাদেশের গড় আয়ু হচ্ছে ৭০ দশমিক ০৬ বছর। এর মধ্যে পুরুষদের ৭০ দশমিক ০৬ বছর, নারীর ৭১ দশমিক ৯৮ বছর। আর ৬০ বছর বয়সের ঊর্ধ্বে প্রায় ১ কোটি ২০ লাখ মানুষ বসবাস করছে। এঁদের কেউ কেউ এক শ বছরের মতো বয়সেও দীর্ঘ জীবনযাপন করেছেন। এর মধ্যে নারী প্রবীণেরা দীর্ঘজীবী হলেও তাঁদের অধিকাংশই মানবেতর জীবনযাপন করতে বাধ্য হন। এ দুঃসহ জীবনযাপন শুধু অসহায়ত্ব ও দুর্ভাগ্যজনক ছাড়া আর কিছু নয়। আমাদের চারপাশে যখন দেখি প্রবীণ স্বামী বা স্ত্রী সুখে শান্তিতে তাঁদের পরিবারে আছেন, তখন কত-না ভালো লাগে! কিন্তু যখন দেখি, তাঁরা অবহেলিত পরিবার বা আপনজনদের কাছে তখন খুব খারাপ লাগে। কোনো প্রবীণ ব্যক্তি যখন পরিশ্রমের কাজ করেন তখনো খুব কষ্ট লাগে। কারণ যে বয়সে তিনি আরাম আয়েশে থাকার কথা, তখন তিনি ভারী জিনিস নিয়ে কাজ করে পরিশ্রান্ত। এসব দৃশ্য দেখে প্রবীণ হয়ে বেঁচে থাকার আকুতিই মরে যায় অনেকের। তাঁরা মনে মনে প্রার্থনা করেন, বার্ধক্য আসার আগেই যেন তাঁরা পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করতে পারেন।

কাজের ভুলে বাবার বয়সী কিংবা মায়ের বয়সী কোনো নারীকে যখন বকাঝকা কেউ করে তখন খুব কষ্ট লাগে। সত্যি কথা বলতে, আমাদের সমাজে প্রবীণদের আমরা কতটা সম্মান করি জানি না, তবে অযত্ন-অবহেলা ও উপেক্ষা করতে পারলে যেন বাঁচি। মনে করে থাকি, বৃদ্ধ আর কত দিন বাঁচবে? তাঁর জন্য সময় নষ্ট করার দরকার কী। এটা কখনো আমাদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য বা মূল্যবোধ হওয়া উচিত নয়। জীবনের বেশির ভাগ সময় মানুষ তার পারিবারিক এবং সামাজিক দায়িত্ব পালন করার পর একদিন সব দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি নেয় এবং অবসর গ্রহণের পর বয়স্ক মানুষ সমাজসংস্কারের জন্য অপ্রয়োজনীয় হয়ে পড়ে। কখনো তাঁরা শেষ ঠিকানা হিসেবে কোনো বৃদ্ধাশ্রমে আশ্রয় গ্রহণ করেন।

দেশে সরকারিভাবে ২৪ লাখ ৭৫ হাজার দুস্থ নারী ও পুরুষকে বয়স্কভাতা হিসেবে মাসে ৩০০ টাকা দেওয়া হয়। দেশে ছয়টি সেফ হোম বা শান্তি নিবাস আছে, তবে সেগুলো নানা সমস্যায় জর্জরিত। বেসরকারিভাবে দেশে কিছু বৃদ্ধাশ্রম আছে, যেখানে বৃদ্ধদের সংখ্যা প্রতিদিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। পরিবারের অবহেলা, সন্তানদের উপেক্ষায় অশ্রুপাত ও হৃদ্‌রোগে মৃত্যু দেখা যায় প্রবীণদের; যা নতুন প্রজন্মের জন্য অভিশাপই বটে। আমাদের দেশে প্রবীণদের জন্য ভাবনাগুলো খুব সীমিত। এখনো পথেঘাটে আমরা বয়স্ক মানুষকে এড়িয়ে যাই। রাস্তা পার হতে সাহায্য করা, বাসের সিট ছেড়ে দেওয়া, তাঁদের সামনে ধূমপান না করা বা বাজে কথা না বলার শিষ্টাচারের শিক্ষা পারিবারিক ভাবে না হওয়ায় আমাদের দেশে প্রবীণেরা বড় বেশি অসহায় বোধ করেন।

আমাদের সমাজে এমন অনেক প্রবীণ ব্যক্তি দেখা যায়, যারা এক সময় সাজানো সংসারে থেকে বার্ধক্যে শূন্য হয়ে পড়ে আছেন। বৃদ্ধ বয়সে অনেকেই একা হয়ে পড়েন। থাকে না সংসারের কোনো কাজের চাপ, থাকে না কথা বলার মতো মানুষও। তবুও তাঁরা আপনজনদের সঙ্গে আড্ডা আলোচনা, হাসি, ভাবের আদান-প্রদান করে সময় কাটাতে চান। কিন্তু সেই অনুভূতি অনেক তরুণ প্রজন্মই বোঝেন না। বৃদ্ধ বয়সে মানুষ সঙ্গ চায় অথচ তখন অপেক্ষাকৃত কম বয়সীরা বয়স্কদের সঙ্গ এড়িয়ে চলে, তাঁদের সঙ্গে গল্প-গুজব, আলাপ-আলোচনা পছন্দ করে না। এটা বয়স্কদের জন্য করুণ ব্যাপার। অনেক প্রবীণ ব্যক্তি সঙ্গের অভাবে শারীরিক ও মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েন। তবে সমাজের শিক্ষিত প্রবীণ ব্যক্তিরা বই পড়াকে অনেক বড় সঙ্গী মনে করে সময় কাটান, এটাও সত্য।

প্রবীণদের প্রতি যত কঠোর মনোভাব পোষণ করা হোক না কেন, পৃথিবীর সব সমাজেই প্রবীণদের স্থান অনেক উঁচুতে। বিভিন্ন উপজাতি ও গোষ্ঠীতে প্রবীণেরাই সমাজের পরামর্শক। বয়সের অভিজ্ঞতায় তাঁরা সমাজকে সঠিক পথে পরিচালিত করেন। কেউ যখন কোনো সমস্যায় পড়েন, ছুটে যান প্রবীণদের কাছে। এমনও দেখা যায়, উচ্চ শিক্ষিত উচ্চ পদে আসীন ছেলে বা মেয়ে তুলনামূলকভাবে কম শিক্ষিত বাবা-মায়ের কাছে গিয়ে অনায়াসে তাঁর কর্মস্থল বা সংসার জীবনের সমস্যার কথা বলে সঠিক সমাধানের পরামর্শ চাইছেন। বাবা বা মা নিজেদের অভিজ্ঞতার আলোকে সন্তানকে সমাধানের পথ বাতলে দিচ্ছেন।

প্রবীণদের প্রতি তরুণ প্রজন্মের অসম্মান কখনো বাঙালির মূল্যবোধ হতে পারে না। এ ছাড়া দারিদ্র্য ও নিঃসঙ্গতা প্রবীণদের কাছে অভিশাপ ছাড়া কিছু নয়। আমাদের দেশে প্রবীণ নীতিমালা আছে। প্রবীণদের ‘সিনিয়র নাগরিক’ ঘোষণা করা এখন সময়ের দাবি। পৃথিবীর উন্নত দেশে ও আমাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতেও এই সম্মানের স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। এ কারণেই যেখানে যাতায়াতে, স্বাস্থ্যসেবা নিতে, ব্যাংকের লেনদেন কার্যক্রমে প্রবীণদের বিশেষভাবে সহযোগিতা দেওয়ার ব্যবস্থা আছে। ‘সিনিয়র নাগরিক’ ঘোষণা করলে এসব সুযোগ তো পাওয়া যাবেই এবং সমাজের অবহেলা, তরুণদের কাছে অসম্মান ও ব্যঙ্গ-বিদ্রূপের সম্মুখীন হতে হবে না। আমাদের অবশ্যই মনে রাখতে হবে—তাঁদের সম্মান করা, শ্রদ্ধা করা, মর্যাদা দেওয়া ও সহায়তা করা আমাদের কর্তব্য।

এখনো অনেক অফিস বা কারখানায় অল্প পরিশ্রমের কাজে প্রবীণদের নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে। আসলে প্রবীণ শব্দটার সঙ্গে অসহায়ত্বের দীর্ঘশ্বাস দেখতে অভ্যস্ত আমরা। কারণ আজও আমাদের দেশের অধিকাংশ প্রবীণ সন্তান মুখাপেক্ষী। তাঁদের শেষ ভরসা সন্তান অথচ সন্তানও কখনো কখনো বড় অসহায়, সামর্থ্যহীন। তবে অর্থ দিয়ে মা-বাবাকে বা পরিবারের প্রবীণদের সাহায্য করার চেয়ে আন্তরিকতা দেখানো, তাঁদের প্রতি সম্মান, দায়িত্ববোধ প্রদর্শন এবং নতুন প্রজন্মের মধ্যে তাঁদের প্রতি ভালোবাসার বোধ তৈরি করে দেওয়া আজ বড় বেশি প্রয়োজন। যা না হলে বছর বছর ঘটা করে প্রবীণ দিবস পালনের কোনো সার্থকতাই খুঁজে পাওয়া যাবে না।

প্রবীণেরা দেশ ও সমাজের অভিজ্ঞতার সম্পদ। আমাদের কাছে উজ্জীবনী শক্তি হিসেবে চলমান ইতিহাস এবং ভবিষ্যতের পথপ্রদর্শক। তাই আসুন প্রবীণদের সম্মান করি, ভালোবাসি, যত্ন করি।