প্রবাসে বাঙালি নারী

আমার দুই সন্তান। ছেলের বয়স ১৭ ছুঁই ছুঁই, আর মেয়ে ১১। আমি ক্যালিফোর্নিয়ায় একটি আন্তর্জাতিক কোম্পানিতে বেশ দায়িত্বপূর্ণ একটি পদে কাজ করি। দায়িত্বের ভারে মাথা প্রায় সারা দিনই দপ দপ করে। আমার এ দেশীয় যে সব মহিলা সহকর্মী এবং যাদের বাচ্চা আছে তাদের কাছে প্রায়ই শুনি, জীবনকে ব্যালান্স রাখার জন্য তারা বেবি সিটার রাখে। সেই সব বেবি সিটাররা বাচ্চাকে স্কুল থেকে তুলে বাড়িতে নিয়ে আসে, খাওয়ায়, হোম ওয়ার্ক করায়। নাচ, গান, খেলা সব ধরনের প্র্যাকটিসে গাড়ি চালিয়ে নিয়ে যায়, নিয়ে আসে। মা যখন বাড়ি ফেরে বাচ্চা তখন তার সমস্ত দিনের শেষে মার সঙ্গে হাসি খুশি পনেরো মিনিট সময় কাটাতে রেডি। এতে মার জীবনের কষ্ট অনেকখানি কমে যায়। আমি এই সব খালি শুনি, কিন্তু কখনো করতে পারি না। আমার মনে ভয় হয়, অচেনা অজানা মানুষের সঙ্গে বাচ্চা বাসায় থাকবে, না জানি কম হয়। ছেলেটা যখন ছোট ছিল, রাজ্যের অপরাধবোধ ঘিরে থাকত, এতটুকু মানুষকে সারা দিন ডে কেয়ারে থাকতে হবে। যত দেরি করে পারি অফিসে যেতাম, ৪টা বাজতে না বাজতেই দৌড় মারতাম অফিস থেকে ওকে নেওয়ার জন্য। আমি যে বাঙালি মা, রাজ্যের অপরাধবোধই যে আমার ধর্ম।
এ দেশে অনেক ধরনের ফ্রিজজাত খাওয়া পাওয়া যায়। চাকরিজীবী মায়েরা অনেকেই সেসব খাওয়া পরিবারকে পরিবেশন করে। বাচ্চারা নিজেরাই নিজেদের খাওয়া মাইক্রোওয়েভে গরম করে নেয়। মাকে রান্নার পেছনে সময় নষ্ট করতে হয় না। অনেকে দোকান থেকে টেক আউট আনে, কেউ বা ক্যাটারিং করায়। আমি পারি না। উইক এন্ড আসলেই মাছ, মাংস, সবজি, ডাল সব বাঙালি খাওয়া রান্না করি পুরা সপ্তাহের জন্য। সেসব খাওয়া খেতে খেতে টায়ার্ড হয়ে বাচ্চারা বলে, আমাদের কেন রোজ ভাত খেতে হয়? তাই ওদের বায়না মেটাতে এখন বাঙালি খাওয়ার সঙ্গে আমেরিকান, ইতালিয়ান, মেক্সিকান, চাইনিজ সব ধরনের রান্নার আধা খেঁচরা চেষ্টা চালাই। আমার বাচ্চারা যেন মার হাতের রান্না খেয়ে বড় হয়। আমি যে বাঙালি মা, আমাদের মায়া বড্ড বেশি।

আমার ছেলের বন্ধুরা সবাই গাড়ি চালিয়ে এদিক-ওদিক যায়। ঘুরতে, স্কুলে, অন্য কাজে। আমি ছেলেকে লাইসেন্স নিতে অনেক দেরি করিয়েছি ছলে বলে, গড়িমসি করে। ও এখন একা গাড়ি চালাবে মনে হলেই বুক কাঁপে। না জানি কি হয়। ভর দুপুরে জরুরি মিটিঙের মাঝখানে আমি বা ছেলের বাবা দৌড় মারি ছেলেকে ওর কাজের জায়গায় নামিয়ে দিয়ে আসতে। ছেলের বাবা আমাকে বোঝায় তোমাকে ছাড়তে হবেই। এভাবে আর কত দিন? আমি ছাড়তে পারি না। আমি যে বাঙালি মা, আমাদের কাছে সন্তান সব সময়ই শিশু।
অফিস থেকে এসে অসহ্য খিদেয় পেট চোঁ চোঁ করে। খাওয়া দাওয়া সব রেডি। কিন্তু একা খেতে পারি না, ইচ্ছে করে না। সেই খিদে পেটে বসে থাকি কখন আমার বর আসবে, এক সঙ্গে খাব বলে। আমি যে বাঙালি বউ, আমাদের মন বড় মমতাময়ী।
আমার এক সহকর্মী এক দিন অফিসে আসল খুব খুশি হয়ে। কারণ তার ছেলে ও মেয়ে বাসা থেকে চলে গিয়েছে, আলাদা বাসা নিয়েছে। যাওয়ার আগে ওদের রুম পরিষ্কার করে দিয়ে গেছে। সে এখন ইচ্ছামতো ঘর সাজাতে পারবে। আমার ছেলের এক বছর পরে ইউনিভার্সিটিতে যাওয়ার কথা। ও না থাকলে বাসাটা কেমন খালি হয়ে যাবে, সেটা ভাবলেই আমার দম বন্ধ হয়ে আসে। তাই আমি জোর করে সে কথা ভুলে থাকি। আমি যে বাঙালি মা, ছেলে মেয়ে কে জড়িয়ে কুড়িয়ে থাকাতেই যে আমাদের শান্তি, ওদের মুখের হাসি আমাদের বুকে শান্তির পরশ বুলিয়ে দেয়।
পৃথিবীর কেউ কিন্তু বাঙালি মাকে, বাঙালি বউকে ছাড় দেয় না। কাজ তার পাওনা কড়ায়-গন্ডায় উশুল করে নেয়। একবার কাজের জায়গায় ঢুকে গেলে, আমি হয়ে যাই কাজের। কাজের হাজারটা দাবি, জটিলতা, দিনের ১০/১৫টা মিটিং সামলাতে হিমশিম খেলেও মস্তিষ্কের প্রতিটি কোষে কোষে ছায়ার মতো ঘুরতে থাকে স্বামী বিশেষ করে সন্তানের চিন্তা। ওর এটা রেজিস্ট্রেশন করতে হবে, ডেড লাইন পার হয়ে যাচ্ছে। ওকে এখানে নিয়ে যেতে হবে। এই সব তো আছেই, সেই সঙ্গে প্যারালাল ভাবে চলে ছেলেটা পড়ায় মন দিচ্ছে না, মেয়েকে কোন্ স্কুলে দেব? এ দেশে পড়ালেখার সঙ্গে বাচ্চাদের বিভিন্ন জিনিসে পারদর্শী হতে হয়। সেই সঙ্গে ভলান্টিয়ার কাজ করতে হয়। আরও আছে ধর্ম, সংস্কৃতি, ভাষা, মূল্যবোধ—এক কথায় নিজের আত্মপরিচয় শেখানোর জন্য আলাদা প্রচেষ্টা।
এত সব করে, ডাক্তার যখন বলে, তোমার কিন্তু নিয়মিত ব্যায়াম করা দরকার, খাওয়া দাওয়াও সাবধানে করতে হবে। তখন মনে হয় সময় কোথায়? আমি যে বাঙালি মেয়ে। যেখানেই থাকি না কেন আমার জিন বারবার আমার সকল পরিচয় ছাপিয়ে, জীবনের সকল চাহিদাকে দাবিয়ে মনে করিয়ে দেয় আমি বাঙালি নারী, বাঙালি মা, বাঙালি স্ত্রী।