প্রবাসে কেমন আছেন আমাদের বাবা-মা

প্রতীকী ছবি। সংগৃহীত
প্রতীকী ছবি। সংগৃহীত

সুমন মাথা নিচু করে বসার ঘরে বসে আছে। দুশ্চিন্তায় তার নিজের মাথার চুল ছিঁড়তে ইচ্ছা করছে। কিছুক্ষণ আগেই ঢাকায় বাবার সঙ্গে কথা হয়েছে। মায়ের অবস্থা ভালো নয়, কিডনি কাজ করছে না। ডায়ালাইসিস শুরু করা দরকার। সুমন বাবা–মায়ের একমাত্র সন্তান। অনেক বছর ধরেই সে সপরিবারে আমেরিকায় আছে। মা-বাবা ঢাকায় থাকেন। তাদের আমেরিকার গ্রিন কার্ড আছে। কিন্তু বহু কষ্টে ছয় মাস থেকেই তারা অস্থির হয়ে দেশে ফেরত গেছেন এক বছর দেশে থাকার পারমিশন নিয়ে। সুমনের সব সময় তাদের নিয়ে দুশ্চিন্তা হয়। এক ধরনের অপরাধ বোধেও ভোগে সে। একমাত্র ছেলে হয়েও সে বাবা–মায়ের কোনো দেখাশোনা করতে পারে না। অবশ্য সব সময় ওকে বাবা-মা তাকে এই বলে সান্ত্বনা দেন যে, তারা আত্মীয়স্বজন ও পাড়া প্রতিবেশী নিয়ে ভালোই আছেন। সুমন মিছেমিছি দুশ্চিন্তা করে। ছেলে তার বাচ্চাকাচ্চা, বউ নিয়ে সুখে থাকলেই তারা খুশি।
কিন্তু আজ বাবার গলার স্বর ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছিল তিনি খুব ঘাবড়ে গেছেন। মার ডায়বেটিস ও ব্লাড প্রেশার দুটোই হাই। এ সময়ে সুমনের পাশে থাকা খুব দরকার। সুমন বাবাকে কোনো দুশ্চিন্তা করতে নিষেধ করেছে। কালকে ভোরেই সে দেশে টাকা পাঠিয়ে দেবে। অফিসের খুব জরুরি একটা প্রজেক্ট চলছে। ছুটি পাওয়া কঠিন হবে, তবুও হয়তো ম্যানেজ করতে পারবে। কিন্তু সুমনের স্ত্রী নায়লা গর্ভবতী। সুমন চলে গেলে এই শরীরে লাবিবকে নিয়ে সে একা থাকবে কীভাবে? দুই বছরের লাবিব ভীষণ দুরন্ত। সুমন কোনো কূল কিনারা পাচ্ছে না। কখন যে নায়লা ওর পাশে এসে বসেছে সে টের পায়নি। ওকে বিপদ থেকে উদ্ধার করতে নায়লাই এগিয়ে এল।
নায়লা বলল, সুমন তোমার দেশে যাওয়াটা খুব জরুরি। আমাদের নিয়ে চিন্তা করো না। আমি এই কয়টা দিন না হয় বাসায় থেকে কাজ করব। তুমি এখনই টিকিট দেখ।
সুমন নায়লার প্রতি গভীর কৃতজ্ঞতা অনুভব করে।
এর ঠিক দুই দিন পরে ঢাকায় পৌঁছে সুমন। বিমানবন্দর থেকে সরাসরি হাসপাতালে। মাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। ডায়বেটিস, ব্লাড প্রেশার কন্ট্রোলে এনে তারা ডায়ালাইসিস শুরু করবে। ডায়ালাইসিস শুরুর পর মায়ের শরীরের অবস্থা আরও খারাপ হয়ে যাচ্ছে দ্রুত। গায়ের রং পুড়ে গেছে। নিজের মাকেই যেন চেনা যায় না। সুমন সিদ্ধান্ত নিতে পারে না, কী করবে। এখানে ডায়ালাইসিস চালিয়ে যাবে নাকি, আমেরিকা নিয়ে যাবে? সে মাত্র দুই সপ্তাহের ছুটি নিয়ে এসেছে। কিন্তু মার সুস্থ হতে কত দিন লাগবে, আদৌ শরীর ভালো হবে কিনা, কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। আরও সপ্তাহ খানেক দেখে ডাক্তারকে সে জিজ্ঞেস করে, মাকে নিয়ে ফ্লাই করা যাবে কিনা। ডাক্তার পারমিশন দিলে সে আর কারও কথা শুনল না। ফার্স্ট ক্লাসের টিকিট তার সাধ্যের মধ্যে নয়, তারপরেও শুধু মায়ের জন্য একটা ফার্স্ট ক্লাসের টিকিট করে। প্লেনে উঠে বাবাকে বলে, মন শক্ত কর বাবা, দেশের কথা ভুলে যাও, মায়ের জন্য হলেও এবার তোমাদের আর সহজে দেশে ফেরা হবে না। ছেলের কথা শুনে করিম সাহেব একটা দীর্ঘশ্বাস গোপন করেন।

প্লেনের জার্নির ধকল মা সামলাতে পারবেন কিনা সেটা নিয়ে সুমন খুব দুশ্চিন্তায় ছিল। অবশেষে কোনো মতে তাদের নিয়ে ক্যালিফোর্নিয়া পর্যন্ত পৌঁছাতে পেরেছে তাতেই সে খুশি। ক্যালিফোর্নিয়ার সুবিধা হলো, বয়স্ক মানুষ গ্রিন কার্ড নিয়ে আসলে বেশ তাড়াতাড়ি চিকিৎ​সার সুযোগ-সুবিধা পেয়ে যান। অফিস বাদ দিয়ে দৌড়াদৌড়ি করে সুমন সব ব্যবস্থা করে ফেলে। সপ্তাহ খানেক পরে ডাক্তারের কাছে যখন যেতে পারে, মায়ের অবস্থা দেখে ডাক্তারকে বেশ চিন্তিত হন। ঢাকায় বেশ কিছু ভুল চিকিৎসা হয়েছে। যে কারণে তার কিডনি প্রায় কাজই করছে না। ডায়ালাইসিস তো করতে হবেই। তাতেও ভালো হওয়ার সম্ভাবনা অনেক কম। এখানে ডাক্তাররা খুব স্পষ্ট কথা বলেন। কিছুই লুকান না।
মার দুচোখ ভরা পানি। বাবা আমি বাঁচব তো? আমার যে খুব শখ ছিল তোর একটা মেয়ে দেখে যাব।
সুমন মাকে জড়িয়ে ধরে বলে, মা, পৃথিবীর সবচেয়ে ভালো চিকিৎসার ব্যবস্থা হবে তোমার জন্য। তুমি নিশ্চয়ই ভালো হয়ে যাবে।
মা খুব একটা ভরসা পান বলে মনে হয় না। করিম সাহেব শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন।

প্রতীকী ছবি। সংগৃহীত
প্রতীকী ছবি। সংগৃহীত


ডায়ালাইসিস শুরু হওয়ার পর আস্তে আস্তে মায়ের অবস্থা আশ্চর্যজনকভাবে ভালো হতে থাকে। সুমন আর নায়লার ওপরে প্রচণ্ড চাপ যাচ্ছে। দুজনেই চাকরি করে। সব সামলে তাদের হিমশিম অবস্থা। প্রথম প্রথম একদিন পরপরই মায়ের ডায়ালাইসিস হয়েছে। সুমনকে ছুটি নিতে হয় মাকে আনা নেওয়া করার জন্য। নায়লা বাজার, রান্না, বাচ্চা সব দেখছে। উপরন্তু বাসায় আনার পর শাশুড়ির বাথরুম, গোসল এগুলোও ওকেই করতে হচ্ছে। সুমনের পক্ষে তো আর সাহায্য করা সম্ভব নয়। নায়লার জন্যও সুমনের মায়া লাগে। বেচারি এই শরীরে কীভাবে কী যে করছে। একটু সময় পেলে ও হয়তো থালাবাসন ধুয়ে দেয়। লন্ড্রি বা ভ্যাকুয়াম করে দেয়। এই কয় দিনে ওর ওজন কমেছে। ব্লাড প্রেশারও বেড়েছে। তারপরেও যখন দেখে মায়ের মুখ থেকে সেই কালো ছায়াটা সরে গেছে, একটু একটু করে জীবনের চিহ্ন ফিরে আসছে, তখন খুব শান্তি লাগে।
এত ঘন ঘন ছুটি নিতে হচ্ছে বলে অফিসের বস খুব বিরক্ত। সামনে নায়লার ডেলিভারি, তখনো ছুটি লাগবে। এদিকে ডাক্তার বলেছে যে, সারা জীবনই ডায়ালাইসিস করতে হবে। সপ্তাহে তিন দিন করে। উপায়ান্তর না দেখে সরকারি সাহায্যের জন্য আবেদন করে সুমন। সরকারি গাড়ি এসে মাকে নিয়ে যাবে ডায়ালাইসিস করতে। বাবা যাবেন সঙ্গে। প্রথম যেদিন গেলেন, কী যে অপরাধী লাগছিল নিজেকে আর প্রচণ্ড টেনশন। কিন্তু এ দেশের নিয়মকানুন খুব ভালো। রোগী একা কোথাও চলে গেলেও চিকিৎসা ঠিকমতোই হবে। আস্তে আস্তে এই রুটিনে তারা সবাই অভ্যস্ত হয়ে যায়।
দীর্ঘদিন কিডনি অকেজো থাকায় মার স্মৃতি শক্তি আজকাল ধীরে ধীরে কমে আসছে। অনেক সময়ই অনেক এলোমেলো কথা বলেন। ডাক্তার বলেছেন, এর আর কোনো চিকিৎসা হবে না। সুমনের ভাবনা হয় নায়লাকে নিয়েও। ও যেন ভুল না বোঝে। করিম সাহেব সারা জীবন খুব স্ত্রী ভক্ত মানুষ। দীর্ঘ চল্লিশ বছরের সংসার। গভীর মমতা দিয়ে অসুস্থ স্ত্রীকে ঘিরে রেখেছেন তিনি। স্ত্রী যে মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এসেছে এ দেশের চিকিৎসার কারণে, সেটা তিনি বোঝেন ঠিকই। কিন্তু যখনই মনে হয়, এখানে থাকতে হবে সারা জীবন, তখনই অস্থির হয়ে যান। সুমন তাদের দেশে যাওয়ার কথা শুনতেই রাজি না। ছেলের কাছে আজ যেন তারা দুজন দুই শিশু। তার বন্ধ জীবনের একমাত্র জানালা নাতি লাবিব। সে ডে কেয়ার থেকে ফিরে আসলে বাড়িটা যেন প্রাণ ফিরে পায়। দাদুর কাছে গল্প শুনতে শুনতে ঘুমায় সে।
নায়লার সি সেকশনের দিনক্ষণ ঠিক করা ছিল। ওরা জানতে চায়নি ছেলে না মেয়ে। ভাগ্যক্রমে সেদিনটিতে মায়ের ডায়ালাইসিস ছিল না। সুমন আশা করেনি মা হাসপাতালে যেতে পারবেন। কিন্তু সকাল বেলা উঠে তিনি রেডি হয়ে বসে আছেন। মা মরা মেয়েটার অপারেশন হবে, আর আমি বাড়িতে বসে থাকব? আমি ঠিকই যেতে পারব।
অগত্যা লাবিবকে ডে কেয়ারে দিয়ে মা-বাবাকে নিয়ে হাসপাতালে গেল সুমন। মাকে দেখে নায়লা যেন অনেকখানি সাহস পেল। ওটিতে ঢোকার আগে মা দোয়া পড়ে ওর মাথায় ফুঁ দিয়ে দিলেন। নায়লা শক্ত করে মায়ের হাত চেপে ধরে আছে। দৃশ্যটা দেখে সুমনের কেন যেন খুব ভালো লাগল, মন বলছে আজ দিনটা খুব শুভ।
ওটির বাইরে তারা তিনজন বসে আছে। মা ক্রমাগত দোয়া পড়ে যাচ্ছেন এক মনে। পাশে বাবার সৌম্য মূর্তি। কিছুক্ষণ পরে নার্স খবর দিল, ওদের একটি মেয়ে হয়েছে। মা সুমনকে এসে জড়িয়ে ধরে বললেন, আজ আমার সব দুশ্চিন্তার অবসান হলো। আজ আল্লাহ তোকে নতুন মা দিয়েছেন। এখন আমি নিশ্চিন্তে আল্লাহর কাছে চলে যেতে পারব। আমার ছেলেটা আর মায়ের আদর থেকে বঞ্চিত হবে না। হাসতে হাসতেই ব্যাগ থেকে এক জোড়া অতি পুরোনো সোনার ছোট্ট চুড়ি বের করলেন তিনি। মায়া ভরে তাকিয়ে থেকে বললেন, আমার বাবা আমার জন্য গড়িয়ে দিয়েছিলেন। আমার তো আর মেয়ে হলো না। তাই রেখে দিয়েছিলাম, তোর যদি কখনো মেয়ে হয় তাকে দেব বলে।
সুমন তখন ভাবছে কে বলবে মা কয়দিন আগেও মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছিল? কে বলবে যে কোনো দিন হতে পারে তার মায়ের শেষ দিন? স্মৃতি শক্তি এলোমেলো হয়ে যাওয়া অসুস্থ মা ঠিকই মনে করে নিয়ে এসেছেন প্রিয় উপহার অনাগত নাতনির জন্য। (শেষ)
ধারাবাহিক এ রচনার আগের পর্ব পড়তে ক্লিক করুন:
প্রবাসে কেমন আছেন আমাদের বাবা মা?