প্রবাসে একদিন, একচিলতে বাংলাদেশ

হল-ভর্তি মানুষ। সবাই মনোযোগী হয়ে ওঠেন। ‘আমার সোনার বাংলা’ বাজতে থাকে। দেহ-মন শিহরিত হয়। স্বদেশের কথা মনে পড়ে।
এ সময় প্রাণের বাংলাদেশ হাজির হয় এর আপন ঔজ্জ্বল্য নিয়ে। ‘আমার আকাশ আমার বাতাস’ সবার অন্তরে স্পন্দন তোলে। বিভিন্ন ঋতুতে বাংলার রূপ-রসের সৌন্দর্যে তাঁর সন্তান হয়ে ওঠে পাগলপারা। এখানেও প্রিয় বাংলাদেশের ধানখেত, গাছগাছালির কল্পদৃশ্য বাঙালির মনে এনে দেয় স্বর্গের অনুভূতি।
আবুধাবির হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল। এটি ৩০ মার্চের দৃশ্যপট। প্রতি বছরই বাংলাদেশ দূতাবাস আবুধাবিতে স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে একটি প্রাণের আয়োজন করে থাকে। এবারও এর ব্যত্যয় ঘটেনি। এখানে এদিন বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূতদের আমন্ত্রণ জানানো হয়। আসেন প্রবাসী সমাজের বাংলাদেশি সদস্যরা। দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে নর-নারীরা পারস্পরিক ভালোবাসাকে শাণিত করে নেন। দূতাবাস সম্মান জানায় এই দেশের রাষ্ট্রীয় প্রতিনিধি, বিদেশি কূটনীতিক ও স্বদেশভূমির মানুষকে। অতিথিরা আপ্যায়িত হন পরম যত্নে।
শুরুর পর্বে সবাইকে স্বাগত জানান সংযুক্ত আরব আমিরাতে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মোহাম্মদ ইমরান। মাইক্রোফোনে তখন দূতাবাসের রাজনৈতিক কাউন্সিলর মোহাম্মদ শাহাদৎ হোসেন। বার্তাটি পুরোনো। তবে তাৎপর্যপূর্ণ। ২৬ মার্চ বাংলাদেশ স্বাধীনতা ঘোষণা করে। আর সে কারণেই এই আয়োজন প্রবাসী বাঙালিদের কাছে অহংকার ও আবেগের। তিনি থামেন। রাষ্ট্রদূত বলেন, ‘দুই দেশের সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্কের কথা। একই বছরে একই সঙ্গে দুটি দেশ স্বাধীনতা অর্জন করে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দেশের মানুষের জন্য সেরা উপহারটি দিয়ে গেছেন। এ কারণেই বঙ্গবন্ধু অদ্বিতীয়, অনন্য। একইভাবে এই বালির দেশের সন্তান শেখ যায়েদ বিন সুলতান আল নাহহিয়ান আলাদা দেশ সৃষ্টি করেন। দুজনই শ্রেষ্ঠ।

রাষ্ট্রদূত ইমরান জানান, দুই দেশই পারস্পরিক সম্পর্কে লাভবান হয়েছে। হাতে হাত ধরে সামনে এগোবে দুই দেশ। এ সম্পর্কে গভীরতর হবে বলে প্রত্যাশা ব্যক্ত করেন তিনি।
হলের প্রবেশপথে দূতাবাস কর্মকর্তারা অভ্যর্থনা জানান অতিথিদের। এই তো বাঙালি সংস্কৃতি। মনপ্রাণ সঁপে দিয়ে অভ্যাগতকে গ্রহণ করা। এ সময় শ্রম কাউন্সিলর আরমানউল্লা চৌধুরী ছিলেন বেশ তৎপর। প্রথম সচিব মোহাম্মদ জসিমউদ্দিন একই লাইনে দাঁড়ানো। আরেক প্রথম সচিব ড. মোকসেদও সেখানে। আছেন তাঁদের সহধর্মিণীরা। ফুলেল ভালোবাসা নিয়ে তাঁরা তখন অতিথিদের স্বাগত জানান।
একেবারে সামনে একটি টেবিল। এখানে কিছু ছবি ও স্মারকের প্রতীকী বাংলাদেশ নিয়ে দাঁড়িয়ে চার তরুণ-তরুণী। মেহেদী হাসান তাঁদের কেন্দ্রে। সামনে প্রস্ফুটিত ফুল। যেন এর মধ্য থেকেই তাঁদের বেরিয়ে আসা। হাসি হাসি মুখ। একপর্যায়ে স্মারক তুলে দেওয়া হয় আগুন্তকদের হাতে। তাঁরা মূলত ভালোবাসা ছড়িয়ে দেন অতিথিদের মাঝে।
ভাটিয়ালি বাজছে লঘু সুরে। ‘আমায় ভাসাইলিরে, আমায় ডুবাইলিরে। অকূল দরিয়ার মাঝে কূল নাইরে।’ কী যে মোহনীয় সে টান। নদীমাতৃক দেশ চোখের সামনে ভেসে ওঠে। দূরে গ্রাম-প্রকৃতি। বৃষ্টি নামছে অঝোরে। বিপুল জলরাশির ওপর দিয়ে চোখ পড়ছে দিগন্তে। এক ধরনের ভয় আর প্রাণের আকর্ষণ সেই গানে। কী যে অনুভূতি!

আয়নার মতো দেশকে দেখা যাচ্ছে। আর কথা হচ্ছে অভ্যাগতদের সঙ্গে। বাংলাদেশি প্রকৌশলী মোয়াজ্জেম হোসেন আবুধাবির বিদ্যুৎ বিভাগের বড় দায়িত্বে আছেন। তিনি অনুষ্ঠান আয়োজনের গুরুত্ব তুলে ধরেন। এমন সমাবেশের মধ্য দিয়ে একতা ও পরস্পরকে উপলব্ধির অনুষঙ্গগুলো আরও চাঙা হয়। নতুন প্রজন্ম এমন গুণে গুণান্বিত হোক—এমন প্রত্যাশা ব্যক্ত করেন তিনি।
পাশেই জাবেদা রশীদ। তিনি গরিব ছাত্র, দুস্থ নারী-প্রতিবন্ধীদের জন্য কাজ করে যাচ্ছেন। জাবেদা জোর দিয়েই বলেন, ‘দেশকে প্রচণ্ড ভালোবাসি বলেই ছুটে আসি মানুষের কাফেলায়।’ রেহানা রহমান দেশের গানে বেশ স্বাচ্ছন্দ্য। তিনি বলেন, যে অবস্থাতেই থাকি না কেন মনে পড়ে দেশকে।
সাঈদা জামান চৌধুরী বাংলাদেশ উইমেন অ্যাসোসিয়েশনের উপদেষ্টা। তিনি একাত্তর তুলে আনেন। বলেন, সেই দিন ভোলার নয়। দিলমাত আরা মাসুদ স্বাধীনতা দিবসের তাৎপর্য ব্যাখ্যা করেন। তাঁর কথা-নিজের দেশকে উপলব্ধির জন্য ২৬ মার্চের কাছে বারবার যেতে হয়। তাঁর সঙ্গে আলাপের সময় দুবাইয়ে বালাদেশ কনস্যুলেটের প্রধান মাসুদুর রহমান ছিলেন তাঁর পাশে। আবু ইসলাম দেশ ভালোবাসাকে মহৎ একটি ‘বোধ’ বলে উল্লেখ করেন। তারও প্রত্যাশা—এমন অনুভূতি যেন তাজা থাকে সবসময়।
পল্লিগীতি বাজছে। ‘হলুদিয়া পাখি সোনারই বরণ, পাখিটি ছাড়িল কে।’ এই গানেই আছে পাখিটি ফাঁকি দিয়ে চলে গেছে। তার মুখে অজস্র গান শোনা যেত। অথচ সে চলে যায় মায়ার বাঁধন কেটে। সেই শোক এখন চরাচরে। এই-ই বাংলাদেশ। এখানে পাখির মতো স্বর্গীয় জীবের উপস্থিতি। আবার একই সঙ্গে একে হারানোর বেদনা। একাত্তর সেই কথা বলে। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন হয়েছে বাংলাদেশ। কিন্তু দেশমাতা হারিয়েছেন তাঁর সোনার টুকরো সন্তানদের।

অতিথিরা খাদ্যসামগ্রীর সামনে গোল হয়ে দাঁড়ানো। একটি নয়, কয়েকটি কেন্দ্র করা হয়েছে। তারা কেউবা মিষ্টান্ন,²কেউবা ফল তুলে নিচ্ছেন। তাদের তৃপ্তি মনের একই সঙ্গে জিহ্বায়।
দুবাই কনস্যুলেটের কনসাল ড. তানবির মনসুর। তাঁর কথাই বলা যায়। প্লেটের ওপর তাঁর চামচ নাড়ানোর শব্দ। সেই সঙ্গে দেশের প্রতি ভালোবাসার গল্পও শোনান তিনি।
মুনীরা আজম আজকের দিনটি খুবই খুশির বলে বর্ণনা করেন। নাদিজদা চম্পাও প্রায় অভিন্ন সুরে জানান, ‘আনন্দময় একটি সময়ের সওয়ার আমরা।’ কনস্যুলেটের প্রথম সচিব কিরিটি চাকমা সবাই যেন স্বাধীনতা দিবসের মূল্যবোধ ধারণ করে—এমন কামনা ব্যক্ত করেন।
‘জাত গেল জাত গেল বলে একি আজব কারখানা সত্য কাজে কেউ নয় রাজি সবই দেখি তা না না না…।’ বোঝা যায়, লালনের অমর সুর। ‘ ব্রাহ্মণ চন্ডাল চামার মুচি একি জলেই সব হয় গো সুচি দেখে শুনে হয় না রুচি যমে তো কাউকে ছাড়বে না…।’ এতেই সব পরিষ্কার হয়।
সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির আহ্বান এই গানে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের স্বদেশভূমির চেতনাও তা-ই। মহিলা সমিতির সভাপতি জাকিয়া হাসনাত ইমরান তখন কথা বলছেন বিদেশি এক রাষ্ট্রদূত পত্নীর সঙ্গে। সম্ভবত অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের এই ধারণাটাই ব্যাখ্যা করছেন তিনি। সমিতির সাধারণ সম্পাদক পপি রহমান। চোখে মুখে তাঁর আনন্দ। বলেন, এমন দিনে তারে স্মরণ করা যায় যে এনেছে আমার দেশ। যেন কবিতাই পড়েন।
সমিতির সাংস্কৃতিক সম্পাদক আনজুমান আরা শিল্পী। দুই অর্থেই তিনি শিল্পী। বলেন, মুক্তিযুদ্ধ না হলে বাংলাদেশ হতো না। কারিশমা ইনাম যোগ করেন, মুক্তিযুদ্ধের বীরদের আমরা পড়ি। মন্তব্য তার। তাঁরা আমাদের হৃদয়ে স্থান করে নিয়েছেন। সঙ্গে তখন তাঁর জীবনসঙ্গী শ্রম কাউন্সিলর।
শাওন সাওদা খান বলেন, ‘দেশ নিয়ে গর্ব করার আছে অনেক কিছু।’ তাঁরই পাশে তখন দাঁড়ানো মোস্তাফিজুর রহমান খান। এই দম্পতি আল-আইন থেকে এসেছেন। মেজবাউদ্দিন অবসর জীবন কাটাচ্ছেন। তিনি বলেন, ‘একাত্তরের মূল্যবোধে প্রত্যেকের উচিত নিজ জায়গা থেকে কাজ করা।’ যুক্তরাষ্ট্রে থাকেন ডা. শওকত রাজ্জাক। তিনি এখানে বারজিল হসপিটালের পরামর্শক হিসেবে কাজ করেন। তাঁর কথা—বাংলাদেশ এখন তাঁর সম্মানের জায়গায়। এই মর্যাদা ধরে রাখার জন্য সবাইকে সতর্ক হতে হবে বলে মন্তব্য করেন তিনি। জুনায়েদ মালিক বলেন অন্যভাবে, আমাদের গর্ব একাত্তর আমাদের অহংকার মুক্তিযুদ্ধ। আমরা এগোচ্ছি স্বাধীন জাতি হিসেবে। দেখা হয় নাজনীন এজাজের সঙ্গে। বলেন, অনেক কষ্টের স্বাধীনতা। সাইফুন্নাহার জলি যোগ করেন, সে জন্যই আমরা পেয়েছি লাল-সবুজে খচিত পতাকা ও সবুজ পাসপোর্ট। একই ধারায় শারমিন মোয়াজ্জেমের প্রকাশ—এ আমার গর্ব। রোকেয়া খাতুন তাঁর আবেগ ধরে রাখতে পারেন না। বলেন, ‘এমন অনুষ্ঠানে আমরা শামিল হই, মিশে যাই মিলনমেলায়।’ প্রতিবেদক বলেন, ‘এ এক বাংলাদেশ, একচিলতে বাংলাদেশ।’
তখনো গান বাজে। ফটোসেশন চলছে। ক্যামেরায় ক্লিক, ক্লিক। গিটারের সুর মোহময় করে তুলে পরিবেশ। ‘ধনধান্য পুষ্পভরা, আমাদের এই বসুন্ধরা!’
আমরা এগোই একরাশ ভালোবাসা ধারণ করে। একচিলতে বাংলাদেশের গর্বকে সঙ্গে নিয়ে।