প্রবাসে এক বছর আর শূন্য জীবনের গল্প

আমার জার্মানিতে পড়তে আসার গল্পটা একটু ভিন্ন। অন্যদের মতো উচ্চশিক্ষা অর্জনের অভিলাষ কিংবা উন্নত দেশের উন্নত জীবন পাওয়ার অভিপ্রায় থাকলেও মূল কারণ ছিল আমার মায়ের স্বপ্ন পূরণ। তিনি খুব করে চেয়েছিলেন আমি মাস্টার্স করতে বাইরে যাই এবং পরবর্তীতে পিএইচডি করি। গত বছর ১২ অক্টোবর জার্মানির মাটিতে পা রেখেছিলাম। আম্মুসহ পরিবারের সবাই খুবই খুশি ছিল। আমি আসার প্রাক্কালে কিন্তু ঘড়ির কাঁটা এক বছর ঘুরতে না ঘুরতেই জীবনের গল্পটা বদলে গেল।
জার্মানি আসার সময় ইচ্ছে ছিল মাস্টার্স শেষ করে কাউকে না জানিয়ে হঠাৎ করেই দেশে ফিরব। বাসায় পৌঁছে কলিংবেল দেওয়ার পর দরজা খুলে হঠাৎ আমাকে দেখে আম্মু খুশিতে পাগল হয়ে যাবেন। আনন্দে কান্না চোখ নিয়ে আমাকে জড়িয়ে আদর করবেন আর চুল টেনে দেবেন। আম্মুর এমন বহু আনন্দ দেখার ইচ্ছে মনে পুষে রেখেছিলাম। ঠিকই একদম হঠাৎ করেই গত ঈদের দুদিন আগে দেশে গেলাম। কিন্তু দরজায় যাওয়ার পর আম্মু একটুও খুশি হয়ে দৌড়ে আসেননি, আমাকে জড়িয়ে ধরেননি, আদরও করেননি। কারণ ড্রয়িংরুমে আম্মুর নিথর দেহ পড়ে ছিল আর নাকে ছিল দুই টুকরা সাদা তুলা। যে দৃশ্য দেখার জন্য কখনো প্রস্তুত ছিলাম না। বিধাতা বড্ড অসময়ে জীবনের সবচেয়ে কঠিন সময়টার মুখোমুখি করলেন। ইস্পাত কঠিন হাতে মায়ের পবিত্র শরীরটাকে নিজ হাতে শুইয়ে দিয়ে আসলাম আর না ফেরার গন্তব্যে আর আমি হয়ে গেলাম মাতৃ আদর শূন্য এক যুবক।
ইতিহাস কখন কী রূপে সামনে আসে কেউ জানেন না। এইতো সেই ১১ অক্টোবর যেদিন আমি চট্টগ্রাম থেকে বিদায় নিচ্ছিলাম ইউরোপের উদ্দেশে। বিদায় দিতে আসা পাথরসম কঠিন আব্বুর চোখেও জল। আর বুঝতেই পারছিলাম আম্মুর ভেতরটা শুকিয়ে মরুভূমি হচ্ছে। কিন্তু চোখের পানি ফেলা ছাড়া আর কোনো কথা বলছেন না। পরম মমতায় দুই হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে মাথায় দোয়া পড়ে ফুঁ দিলেন। কে জানত সে জড়িয়ে ধরাই হবে মায়ের শেষ জড়িয়ে ধরা।। ২০ সেপ্টেম্বর ২০১৫। এই দিন আমার ভিসা হয়। অ্যাডমিশন লেটার হাতে পাই আরও দুই মাস আগে। আমি সারপ্রাইজ দেওয়ার জন্য আগে থেকে কাউকে কিছু জানাইনি। দূতাবাস থেকে পাসপোর্ট সংগ্রহ করে রাত ১১টার দিকে ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম পৌঁছাই। আম্মু গ্রামে গিয়েছিলেন ওই দিন। বাসায় পৌঁছে আম্মুকে ফোন করে খবরটা জানাই আর তিনি ফোনের ওপাশ থেকে আনন্দে অঝোরে কাঁদছেন আর তার আশপাশের মানুষদের আমার কথা বলছেন।
আমি অনার্সে ওঠার পর থেকে এই একটা স্বপ্নই আম্মু সব সময় দেখতেন; তাঁর ছেলে বিদেশে পড়তে যাবে। বুদ্ধি হওয়ার পর থেকে আমার ছোট ছোট অর্জনগুলো আম্মুর জন্য ছিল বিশাল। কখনো বিতর্ক প্রতিযোগিতা কিংবা অন্য কিছুতে পুরস্কার পেলে সেগুলো আম্মুর হাতে দিতাম। আম্মু বাসায় যাঁরাই আসতেন সেসব তাঁদের দেখাতেন। পত্রিকায় কোনো লেখা বা ছবি প্রকাশিত হলে নিকট আত্মীয়দের ফোন করে বলতেন পৃষ্ঠা-কলাম নম্বরসহ।। আমি একটু খুশি হব এমন কিছু বুঝতে পারলে তার সবটুকু দিয়ে আমাকে খুশি করার চেষ্টা করতেন। এর প্রতিদান দিতে না পারা যন্ত্রণা এত তীব্র হবে আগে বুঝিনি। তিনি প্রার্থনা করতেন, অনুপ্রেরণা দিতেন, কাঁদতেন আবার হাসতেন। গত বছর মক্কা থেকে ফিরে আসার পর আপু বলেছিল আম্মু নাকি কাবা শরিফ ধরে কেঁদেছেন আমার জন্য। তাঁর সন্তানদের জন্য। তাঁর সন্তানেরা ঠিকই বড় হচ্ছে, শুধু তিনি দেখবেন না।
মাঝখানে দুটি ঈদ চলে গেল প্রবাস জীবনে। এক ঈদের ঠিক দুই দিন আগে আম্মুকে মাটির ঘরে চিরনিদ্রায় ঘুমাতে দিয়ে আসলাম আর অন্য ঈদ ল্যাব-জবের প্রেশারে সকাল সন্ধ্যাও ভুলে গিয়েছিলাম। পুরো রমজান জুড়ে আম্মু খুব টেনশন করতেন আমার ইফতার ও সাহরি খাওয়া নিয়ে। বাংলাদেশের যেসব খাবার এখানে নেই তা ভিডিও কলে খাওয়া অনেকটা নিষিদ্ধ ছিল আমার বাসায়। আম্মু বলতেন ঈদে একা একা আমার ছেলেটা কি করবে! অথচ ছেলে ঈদ একা করেনি করেছে দেশে, করেছে চট্টগ্রামের হিলভিউয়ের ৭ নম্বর রোডে, শুধুমাত্র তিনি বোঝেননি ছেলে দেশে এসেছিল, তিনি দেখেননি ঈদ কেমন হলো। ভবিষ্যতে আর কোনো উৎসব হয়তো আমার পূর্ণ হবে না।

মৃত্যু আম্মুকে প্রায় সময় হাতছানি দিত। আমি চলে আসার আগে আম্মু প্রায় সময় বলতেন, তুই আমার জানাজা পাবি কিনা কে জানে। হয়তো ফ্রিজিং অ্যাম্বুলেন্সে আমাকে রেখে দেবে তুই আসার জন্য। গত এক বছর আপুদের এই একই কথা অনেকবার বলেছিলেন। আম্মু চলে যাওয়ার তিন দিন আগে আকস্মিকভাবে আম্মু আমাকে বললেন, আমার শরীর খারাপ লাগছে, যদি আমি মরে যায় তুই দেশে আসিস না, কারণ এই মাসে তোর পরীক্ষা। আমি স্বভাবজাত হেসে দুষ্টুমি করে বললাম, ধুর আমি কেন আসব, একটু ভিডিওতে দেখব এরপর তুমি তোমার মতো আমি আমার কাজে। কে জানত আম্মু তিন দিন পরের বাস্তবতা বলে দিচ্ছিলেন হাসির ছলে। ২ জুলাই ক্লাস আর জব সেরে আমিও সারা বাংলাদেশের মতো গুলশানে হামলার বিস্তারিত দেখতে টিভির সামনে। বাংলাদেশের সাহ্রির সময় ছোট ভাইকে ফোন দিই আর সে বলে আম্মুর খারাপ লাগছে, আমি কিছুক্ষণ পর ফোন দিচ্ছি তোমাকে। এক ঘণ্টা পর আমি আবারও ফোন দিতেই সে কেঁদে বলল, আম্মু হসপিটালের আইসিইউতে। সেদিন হসপিটালে নেওয়ার সময় আম্মু আব্বুর কাছে ক্ষমা চেয়ে বলেন, আমি আর ফিরব না, এই আমার শেষ যাওয়া। পথে ছোট ভাইকে বলেন, আমার কথা তোর ভাইয়াকে জানাস না, ও টেনশন করবে। আর বড় আপুকে বলেন, আজকে থেকে তুই ওদের মা। অবস্থা ভালো না হওয়া আম্মুকে অতি দ্রুত হেলিকপ্টারযোগে ঢাকায় নেওয়া হলো। কিন্তু যত দ্রুতই ঢাকায় নেওয়া হোক না কেন, বিধাতা ডেকে পাঠিয়েছেন তাঁকে, যেতেই হবে। তাই হার্টের দুটি ব্লক আর এট্রিয়াম ও ভেন্ট্রকলের মাঝে একটি ছিদ্রের কাছে চিকিৎসাবিজ্ঞান পরাজিত হলো আর এভাবেই আমার মা নাই হয়ে গেলেন। দেহের সমস্ত রক্ত মাংস আমাকে তৈরি করলেন আর কিছু না নিয়ে হঠাৎ চলে গেলেন।
আম্মু-আব্বুর বিয়ের ১৪ বছর পর আমার জন্ম চট্টগ্রামের রাউজান উপজেলার গহীরাতে। প্রথম কয়েকজন কন্যা সন্তান হওয়ায় একটি পুত্র সন্তানের শখ আম্মু বহু বছরের। আম্মু বলতেন, আমার জন্মের পর আমাদের গ্রামের গাছপাতাও নাকি খুশি হয়েছিল। আমার জন্ম সোনার চামচ মুখে নিয়ে নয়। একজন সাধারণ চাকরিজীবী বাবার পরিশ্রম আর আমার মায়ের কষ্টের ফসল আজকের আমি বা আমরা ভাই-বোনেরা। ১৯৯৫ সালে ছোট একটি বাড়ি করে আব্বু আম্মুকে নিয়ে শহরে চলে আসে। এরপর দেখেছি তাদের নতুন যাত্রার লড়াই। প্রাইমারি স্কুলে একটি দোয়েল মার্কা নোট দিতেন আব্বু টিফিনের জন্য আর বাসায় ইলিশ মাছের টুকরাকে দুই ভাগ করে আম্মু ভাই বোনদের খাওয়াত। আম্মু যাওয়ার আগে শহরে দুই তলা বাড়ি, গ্রামে ছোট্ট আরেকটি নতুন বাড়ি সবই দেখে গিয়েছেন কিন্তু পরম সুখ বলতে যা বোঝায় তা পাননি। কারণ তিলে তিলে সব গড়ে তুলেছেন তিনি আর যখনই ছেলেমেয়েরা বড় হলো আর তার পড়ন্ত জীবনের শান্তি উপলব্ধির সময় হলো তখনই চলে গেলেন। আম্মুর মনে অনেক সাধ থাকলেও কখনো বলতেন না। বলতেন তোরা যখন অনেক টাকা আয় করবি তখন সব ইচ্ছে পূরণ করব। এখন ভাবি চাকরি জীবনে মায়ের ইচ্ছেগুলো কীভাবে পূরণ করব! টিউশনি করে যখন আম্মুর হাতে অল্প কিছু টাকা দিতাম কিংবা কোনো উপহার দিতাম আম্মু হাসি খানা পরিমাপ করার কোনো যন্ত্র পৃথিবীতে আবিষ্কৃত হয়নি। আম্মু চাইতেন আমরা বলি আম্মু না থাকলে আমাদের এত দুর আসা হতো না অথচ তাঁর সামনে কখনো এই চিরন্তন সত্য বলা হয়নি। বরং আমরা উল্টোটা বলতাম, কারণ এমন বললেই আম্মু ক্ষেপে যেতেন আর ভাইবোনরা সবাই এটা নিয়ে মজা করতাম। তখন আম্মু বলতেন, এখন বুঝবি না, যখন আমি থাকব না তখন বুঝবি ‘মা’ কি ছিলাম। আম্মু বিশ্বাস কর এখন প্রতিটি দিন আর প্রতি মুহূর্তে বুঝি তুমি কি ছিলে। তোমার বটবৃক্ষের ছায়া কত বিশাল সেটা আগেও বুঝেছি কিন্তু কখনো বলা হয়নি। কারণ ভেবেছিলাম বলার বহু সময় বাকি। আমি এখনো বিশ্বাস করতে পারি না, আমার পৃথিবী আমার প্রাণপ্রিয় মা আর নেই। এমনটা কথা ছিল না আম্মু, আমরা মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না। আমাকে নিয়ে, আমাদের নিয়ে এত টেনশন কে করবে? এত যত্ন করে কে আগলে রাখবে? যাওয়ার আগে একটুও ভাবলে না। পুরো পৃথিবী এক করেও তোমার শূন্যতা পূরণ হবে না। তোমার বিন্দু বিন্দু ভালোবাসায় এই দেহ গঠিত, কিছু ফেরত দেওয়ার আগে কেন চিরঋণী করে চলে গেলে। একটিবার ফিরে এসে দেখে যাও এই জীবনে তোমাকে কতটা প্রয়োজন।
আমি জানি আম্মু শেষ নিশ্বাস পর্যন্ত আমার কথা ভাবছিলেন। ভাবছিলেন তাঁর ছেলে কি আসবে? আরেকটিবার কি কথা হবে? নাকি আম্মু যেমনটা ভেবেছিলেন লাশ ফ্রিজে রেখে দিতে হবে তেমনটা হবে! ইশ্, একবার যদি জানতে পারতাম আম্মুর মনে কি চলছিল তখন। আম্মু নাকি দ্বিতীয় দিন লাইফ সাপোর্টের মাস্ক খুলে কিছু একটা বলতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ডাক্তার খুলতে দেননি। আমি দ্বিতীয় দিন অর্থাৎ ৪ জুলাই রওনা দিই আম্মুর চিকিৎসার সময় পাশে থাকার জন্য। ঢাকার সকল হসপিটাল একে একে না করে দিচ্ছিল। তারা আম্মুর ওপেন হার্ট করাতে রাজি হচ্ছিল না। অতঃপর একটি হসপিটাল রাজি হলো তবে বলে দিল বাঁচাতে পারার আশঙ্কা মাত্র ৫ শতাংশ। আর বাকি ৯৫ শতাংশ আশঙ্কা অপারেশন টেবিলে চলে যাওয়ার। এসব নিয়ে কথা হচ্ছে তখন বাংলাদেশ সময় রাত ৯টা আর আমি তুরস্কের ইস্তাম্বুল শহরে ট্রানজিটে। ফোনে বললাম ১ শতাংশ চান্স থাকলেও অপারেশন করতে। কারণ আর উপায় নেই।। শেষমেশ সিদ্ধান্ত হলো পরদিন অর্থাৎ ৫ জুলাই সকালে আম্মুর অপারেশন আর আমি ভোর ৫টা নাগাদ দেশে পৌঁছাব।। দেশে পৌঁছে এয়ারপোর্টে দুলাভাই রিসিভ করলেন আর বললেন আম্মুকে রাতেই চট্টগ্রাম নেওয়া হয়েছে কারণ ডাক্তার বলেছেন, ওষুধ দিয়ে একটু ইমপ্রুভ করুক, সপ্তাহ পর অপারেশন করবেন। একটু আশ্বস্ত হলাম। অ্যাম্বুলেন্সে থাকা ছোট ভাই, আপু আর মামার সঙ্গে ফোনে কথা বললাম। সবাই কান্না লুকিয়ে সাবলীল ভাষায় কথা বলছিলেন। আরও আশ্বস্ত হলাম। আমার গাড়ি চলছে চট্টগ্রামের দিকে মাকে দেখার আকুলতায়। মায়ের কথা শুনব এমন স্বপ্ন নিয়ে গাড়ি ছুটছিল নারায়ণগঞ্জ, কুমিল্লা, ফেনী হয়ে চট্টগ্রাম। বাসা থেকে আমি যখন এক ঘণ্টা দূরে এমন সময়ে সৌদি আরবপ্রবাসী আরেক দুলাভাই ফোন করে কেঁদে কেঁদে বললেন, দাফন কোথায় করবা। সঙ্গে সঙ্গে পৃথিবীর সকল নিস্তব্ধতা আর কালো মেঘ আমাকে গ্রাস করে নিল। অপারেশনের জন্য আম্মু অপেক্ষা করেননি, আম্মু অপেক্ষা করেননি আমার জন্যও; ১২টা ৪৮ মিনিটে আম্মু চলে গেলেন, তাঁকে কতটা মিস করব সেটা বোঝার সুযোগ দিয়ে।
অনেক দিন হয়ে গেল আম্মু আদর করেন না, অনেক দিন হলো আম্মু দুধের মগ হাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে দরজায় অপেক্ষা করেন না, অনেক দিন হলো কপালে হাত দিয়ে অযথা আম্মু বলেন না, ওর তো জ্বর আসছে মনে হয়, অনেক দিন ঘর থেকে বের হওয়ার সময়ে চুল টেনে দোয়া পড়ে ফুঁ দেন না, অনেক দিন ভিডিও কলে আম্মু বলেন না, কি রান্না করলি আজ, লবণ হয়েছে? বলেন না, তুই শুকিয়ে গেছিস, বলেন না টাকা পয়সা কামানোর চিন্তা করিস না, আগে পড়াশোনা করে আমার মুখ উজ্জ্বল কর। বলেন না, বাবা পড়াশোনা শেষ করে তাড়াতাড়ি দেশে আয়, মরার আগে তোদের সংসার দেখতে চাই।
একটু সময় পেলেই আম্মুকে নিয়ে লিখতে বসি আর প্রায় সময় অর্ধেকে কিবোর্ড থেমে যায়। প্রায় সময় বিধাতা প্রশ্ন করি, আমার মাকে নিয়ে যাওয়া কি খুব জরুরি ছিল? ক্যালেন্ডারের পাতা উল্টিয়ে তাঁকে কি আরেকটিবার ফিরিয়ে দেওয়া যায় না?