প্রবাসে আমাদের রোজা ও ঈদ
যখন প্রথম যুক্তরাষ্ট্রে এলাম, তখন ঘোর পবিত্র রমজান। শ্বশুর আর তাঁর নালায়েক ছেলে আমাকে ইফতার শেষে আলাদাভাবেই আনতে গেছেন বিমানবন্দরে। শ্বশুর ছেলে বউয়ের গৃহপ্রবেশ করাবেন বলে আমাকে তাঁর সম্মান রাখতে ওনার সঙ্গেই এক গাড়িতে যেতে হলো। মাঝখানে তার নালায়েক ছেলে মনে হয় মনের দুঃখে রাস্তা ভুলে দেরি করে বাসায় ফিরেছে। সময়টা ছিল তীব্র শীত। রাস্তায় তুষার জমে আছে। আবার শ্বশুর আমার হাতেই ফোন তুলে দিয়ে তাঁর ছেলে কোথায় হারাল জানার জন্য কল দিতে বললেন। অবশ্য ফোন দিতেই শুনি, তখন উনি শ্বশুরের ড্রাইভওয়েতে ঢুকছেন। আমাকে বের হতে বললেন। বের হয়ে দেখি, কী সুন্দর স্নো! হাঁটতে নিয়ে গেলেন আশপাশে। ফিরতে ফিরতেই আমার অন্য সব শ্বশুর–শাশুড়ি দেখতে চলে এসেছেন। শ্বশুর রান্না করেই রেখেছিলেন। সবার সঙ্গে ডিনারের পর রাত ১২টায় আমাকে তিনি আমার বাসায় নিয়ে ফিরলেন।
কয়দিন পর ঘুরতে গেলাম ক্যালিফোর্নিয়া। মামা, খালা, শ্বশুর, শাশুড়িদের সঙ্গে দেখা করে দুজনে টো টো করে চষে বেড়িয়েছি ক্যালিফোর্নিয়া, লাসভেগাস!
যুক্তরাষ্ট্রে প্রথম ঈদ। মিশিগানে আমার শ্বশুর আর কয়েক বাঙালি পরিবার প্রথম দিককার। আমি সবার জন্য ঈদ উপহার নিয়ে এসেছি। এখানে ঈদে তখন প্রতিটা বাঙালি পরিবার হাউজ হপিং করে বেড়ায়। মানে, তারা ঠিক করে নিতো কার বাসায় নাশতা, লাঞ্চ আর ডিনার হবে। সবাই মিলে সেসব বাসাতে ঈদ করার মজাই আলাদা ছিল। অন্যদের বাসায় রান্নার ঝামেলা নেই। ঈদের নামাজ শেষে হাউজ হপিং করে সবার সঙ্গে সারা দিন একেক বাড়িতে হইচই আর মজার মজার খাবার খাওয়ার মজাই ছিল অন্য রকম।
তখন হ্যামট্রামাকে বাঙালিপাড়া হলেও কয়েকটা ইন্ডিয়ান কাপড়ের দোকান ছাড়া সারা মিশিগানে কোনো বাঙালি খাবারের দোকান ছিল না। আন্টিরা সব রকমের খাবার, মিষ্টি নিজের হাতেই বানাতেন।
ঈদ শপিংয়েরও তেমন প্রচলন ছিল না। আমার স্বামীর ঈদের বাজার করার কোনো ধারণাই ছিল না। ঈদে শপিং করতে হয়, সবাইকে উপহার দিতে হয়, সেটাও তার জানা ছিল না। তবে আমাকে আমার সব শ্বশুরের বাসা থেকে উপহার দিয়েছে।
আসলে এখানে যখন দরকার, তখনই শপিং করা হয়। ঈদ বলে আলাদা করে শপিং কেউ তেমন করত না। আর প্রতিবছর কেউ না কেউ, দেশ থেকে শপিং করেই নিত। পাওয়াও যেত না এখানে তেমন—একটা বা দুটি দোকানই ছিল।
প্রথম প্রথম অবাকই লাগত ভিন্ন ধরনের ঈদ দেখে। সপ্তাহের মাঝে ঈদ হলে পার্টি হতো সপ্তাহান্তে।
শ্বশুর আমাকে অবাক হতে দেখে বলেছিলেন, ঈদের ধারণাই বদলে গেছে এত দিন বাইরে থেকে। ঈদে কেনাকাটা করতে হবে, সেটা নেসেসারি না। আর তাদের দুই নালায়েক নাবালক ছেলে, তাদের কোনো চাহিদাও নেই।
এত বছর পর নিজেকে দিয়েই দেখি, ঈদের শপিং বলে যে কিছু আছে, সেটা নিজেও ভুলে গেছি। চিপাচাপায় কোনো না কোনো নতুন কাপড় পড়েই থাকে। আবার ব্যস্ততায় সপ্তাহের দিনগুলোতে ছুটি নেওয়ার ব্যবস্থা নেই বলে (লুনার ক্যালেন্ডার আর সব সময়ই এক–দুই দিন এদিক–ওদিক হয়) কাজেই দিন কাটে। বাচ্চাদেরও স্কুলেই পাঠাই। তিনি পুরোনো কোনো পাঞ্জাবি পরে ঈদের জামাত করতে একবারও ভাবেন না। আমরা যে যার মতো কাজ, স্কুল শেষ করে দিন শেষ করি। আগে হয়তো কোনো আত্মীয়ের বাসায় দাওয়াত বা রেস্টুরেন্টে খেতে চলে যেতাম নিজে রান্নার সময় না পেলে। এখন মা–বাবা থাকায় কমপক্ষে রাতের খাবার তাঁদের বাসায়। আর ছুটির দিন হলে মূলত সবই সেখানে।
বাচ্চারা একটা বিভ্রান্ত ধারণার মধ্যে ঈদ করে। ছুটি হলে বাবার সঙ্গে নামাজ শেষে নানুর বাসা, বান্ধবী এখানে থাকলে তার বাসা বা কালেভদ্রে আমার ছুটি হলে আমার বাসায় ঈদের রান্না হয়। সুযোগ পেলে এখনো একবার রেস্টুরেন্টে ঢুঁ মারা হয়। ঈদ বলে বিশেষ আর কিছু করা হয় না। ঈদ তো চলেই যায়।
মেহেদি হাতে দেওয়া হয় না—অনেক রোগীই হেনা চেনেন না, তাঁদের কথাও মাথায় রাখতে হয়। আসলে আমার আগ্রহ বা উৎসাহ হয়তো কমে গেছে। ভিন্ন লাইফস্টাইলের ফিউশন চলেই আসে। আটলান্টাতে বাঙালি কিছু খাবারের দোকান নতুন হয়েছে বেশ কয় বছর। এর আগে দূরদূরান্তে হয়তো একটা বা দুটো দোকান ছিল।
মসজিদে ইফতার আর ঈদের দিন নাশতা সার্ভ করে, সবাই একেক দিনের খাবার ডোনেট করে। সেটাও ভালো, নিজের বাসায় ইফতার বা ডিনারের ঝামেলা কম। অবশ্য গত কয় বছর যাওয়াও হয় না। কোভিডের পর থেকে আমার আইসোলেশন কমে না। তারাবি পড়তে তিনি যান বাসাতেই ইফতার করে। সম্প্রতি ইফতারের পর আর ডিনার করার অবস্থা থাকে না। ভারী খাওয়া হয়ে গেলে, সাহ্রিও বাদ যায়।
তবে, ওজনের তারতম্য তাতে ঘটে না!
লেখক: শারমীন বানু আনাম, চিকিৎসক