প্রবাসীর বোবা কান্না-দুই

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

সিডনির সেন্ট ভিনসেন্ট হাসপাতালে বসে আছি। ভিনসেন্ট হাসপাতাল হৃদ্‌যন্ত্রের জন্য অস্ট্রেলিয়ার সবচেয়ে ভালো হাসপাতালগুলোর একটি। আমার বাড়িওয়ালা নাজমুল ভাই এখানে ভর্তি হয়েছেন। তাঁকেই দেখতে এসেছি। আসার পর থেকেই আমার মনের মধ্যে ভয় কাজ করছে। যান্ত্রিক জীবনে মৃত্যুর ভাবনা মনে ঠাঁই দেওয়ার ফুরসত মেলা ভার। কিন্তু দুটো জায়গায় গেলে মনের মধ্যে এক ধরনের অজানা আশঙ্কা এসে ভর করে। একটা হচ্ছে হাসপাতাল আর অন্যটা হচ্ছে কবরস্থান। হাসপাতালে প্রতিদিনই নতুন প্রাণের আগমন হচ্ছে পৃথিবীর বুকে। আবার সেই হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে কত মানুষ জীবনের শেষ দিন গুনছেন। এ যেন জীবন-মৃত্যুর এক অপূর্ব মেলবন্ধন। তাই হাসপাতালকে আমার কাছে জীবন নামের রেলগাড়ির স্টেশনের প্ল্যাটফর্ম মনে হয়। রেলগাড়িতে করে প্রতিদিনই নতুন প্রাণের আগমনের পাশাপাশি একই রেলগাড়িতে চড়ে বহু প্রাণের প্রস্থান হচ্ছে।

হাসপাতালে এলে তাই আমার মনে ভয় কাজ করা শুরু করে, এই বুঝি আমার যাওয়ার সময়ও হয়ে এল। মানুষ কতভাবেই না মৃত্যুবরণ করছে। একজন মানুষ পৃথিবীতে আসার পর তার কাছে সবচেয়ে বড় সত্য হচ্ছে তার জীবনে অবশ্যই একদিন মৃত্যু এসে কড়া নাড়বে। কিন্তু আমরা সবাই সেটা ভুলে কত ধরনের প্রতিযোগিতায় লিপ্ত থাকি। কত রকমের অহংকার আর বড়াই মানুষের মনে বাসা বাঁধে। মৃত্যুর পর কিন্তু সবারই একই অবস্থা। কারওই আর কোনো বস্তুগত অস্তিত্ব থাকে না। আর সারা জীবনের কোনো অর্জনই তখন আর কোনো কাজে আসে না। শুধুমাত্র জীবনে যদি কোনোরকমে অবদান রেখে যাওয়া যায়, তাহলেই কিছুদিনের জন্য মনে রাখে। আবার সেটাও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ফিকে হয়ে আসে।

হাসপাতালের প্রত্যেক কক্ষেই চারটি করে বিছানা। নাজমুল ভাইয়ের বিছানাটা কক্ষে ঢোকার মুখেই ডান পাশে। বাঁ পাশের বিছানার ভদ্রলোক খুবই শান্ত ভঙ্গিতে খাবার খাচ্ছেন। দেখে মনে হতে পারে তিনি যেন নিজের বাড়ির খাবার টেবিলে বসে খাবার খাচ্ছেন। বাঁ পাশেই তারপরের বিছানায় ভদ্রলোকের সারা শরীরে অনেক ধরনের নল লাগানো। তাঁর চেতনা নেই। শুধুমাত্র মনিটরের স্ক্রিনে আঁকাবাঁকা রেখার ওঠানামাতে বোঝা যাচ্ছে প্রাণের অস্তিত্ব আছে তাঁর শরীরে। নাজমুল ভাইয়ের ঠিক পরের বিছানায় একজন মধ্যবয়সী ভদ্রলোক। তিনি হাসপাতালের গাউন পরে বসে আছেন। আমার সঙ্গে চোখাচোখি হতেই তিনি মৃদু হেসে হাত নাড়লেন। নাজমুল ভাই শোয়া অবস্থা থেকে উঠে বসলেন। আমাকে পাশে রাখা চেয়ারে বসতে বলেই গল্প শুরু করলেন।

শুরুতেই তিনি তাঁর কক্ষের সবার বর্ণনা দিলেন। জানালেন, তাঁর সামনের বিছানার স্বাভাবিকভাবে খাবার খাওয়া লোকটার হৃৎপিণ্ডের মাত্র পঁচিশ শতাংশেরও কম সচল আছে। শুনে আমি প্রশ্ন করলাম, তাঁকে দেখে তো বোঝার উপায় নেই উনি এতটা অসুস্থ। শুনে হাসান ভাই বললেন, আসলে কিছু মানুষ মনের জোরে সবকিছুকে অতিক্রম করে। এই মানুষটাও মনে হয় তাই। শরীরের অসুখ মনের ওপর চেপে বসেনি। হাসান ভাই আরও বললেন, তার পাশের অচেতন মানুষটাকে ডাক্তারেরা শেষ কথা বলে দিয়েছেন। তাঁর আয়ু আর বেশি হলে দু-এক দিন। কিন্তু তাঁর ছেলেমেয়েরা সবাই দেশের বাইরে থাকে। তাই শেষ সময়েও তাঁর কাছে কেউ নেই। শুনে আমার মন খুবই খারাপ হয়ে গেল।

আমি নিজেও আমার বাবা-মাকে বাংলাদেশে ফেলে জীবনের উচ্চাভিলাষ চরিতার্থ করতে সাত সমুদ্র তেরো নদীর এই পাড়ের দেশ অস্ট্রেলিয়াতে পড়ে আছে। আমার বাবা-মা গ্রামের বাড়িতে থাকেন। বাড়িতে শুধু তাঁরা দুজন মানুষ। অবশ্য তাঁদের বয়স এখনো তেমন কিছু একটা হয়নি, আর শরীরটাও ভালো আছে। কিন্তু হঠাৎ যদি কিছু একটা হয়ে যায় তাহলে গ্রামের মানুষজন ছাড়া পাশে দাঁড়াবার কেউ নেই। আমার মেজো ভাই চাকরি সূত্রে থাকে নড়াইল। আর ছোট ভাই থাকে ময়মনসিংহে। তাদেরও হঠাৎ কুষ্টিয়া আসতে গেলে কয়েক ঘণ্টার ধাক্কা। আর আমাকে যেতে হলে লেগে যাবে পুরো একদিন তো বটেই, বেশিও লাগতে পারে। তাই আমার মাঝে মাঝে মনে হয়, যদি আমাদের একটা বোন থাকত তাহলে তাকে বিয়ে দিয়ে তার স্বামীকে যদি ঘরজামাই রেখে দিতাম তাহলে বোনটা বাবা-মায়ের কাছে থেকে তাদের যত্নআত্তি করতে পারত। অথবা আমরা তিন ভাই যদি একটু কম উচ্চাভিলাষী হতাম তাহলেও হয়তোবা কুষ্টিয়াতেই একটা মাঝারি মানের চাকরি জোগাড় করে থেকে যেতে পারতাম। তাহলে অন্ততপক্ষে বাবা-মায়ের কাছাকাছি থাকতে পারতাম। কিন্তু তিনজনই মাত্রাতিরিক্ত শিক্ষিত হয়ে যাওয়ায় স্বাভাবিকভাবেই নিজেদের অনেক উচ্চতায় কল্পনা করেছি এবং সেই মোতাবেক আমরা সেখানে পৌঁছেও গিয়েছি।

আমাদের এই চলার পথে বাবা-মাই অবশ্য সারাক্ষণ উৎসাহ জুগিয়ে গেছেন। তারা একবারও ভাবেননি, এই ছেলেরা একদিন বড় হয়ে তাদের কাছ থেকে দূরে সরে যাবে। তারা সব সময়ই চেয়েছেন, তাদের ছেলেরা আরও বড় হোক। সমাজে মাথা উঁচু করে দাঁড়াক। পরবর্তীতে আমি বিয়ে করার পর যখন আমাদের মেয়ে হলো তখন আমার বাবা-মায়ের সমস্ত স্নেহ তার জন্য বরাদ্দ হয়ে গেল। কারণ তাদের নিজেদের কোনো মেয়ে ছিল না। কখনো ফোন দিলে সবার আগে তাই আমার মেয়ে তাহিয়ার খোঁজ নেন তারা। আমি ঢাকায় থাকাকালে বিভিন্ন অজুহাতে ঈদের দিনগুলোতেও অনেকবার কুষ্টিয়া যেতে পারিনি। তখন মনে মনে অনেক খারাপ লাগত আর এখানে আসার পর তো গত তিন বছরেও একবারও দেশে যেতে পারিনি।

নাজমুল ভাইয়েরও আমার বাবা-মায়ের মতোই দুই ছেলে। তাদের বিয়ে হয়ে গেছে। বড় ছেলেটা আলাদা থাকে। আর ছোটটা থাকে তাঁদের সঙ্গে। সব মিলিয়ে তাঁর চার নাতিপুতি। আমি ভেবেছিলাম, যেহেতু অস্ট্রেলিয়াতে জীবনের নিরাপত্তা আছে তাই হয়তো এখানে সবাই কর্মজীবনে বাবা মায়ের কাছাকাছিই থাকেন। কিন্তু বাস্তবতা সারা পৃথিবীতেই একই। পরবর্তী প্রজন্ম নিজের জীবিকার তাগিদে বা অন্য যেকোনো কারণেই হোক পূর্ববর্তী প্রজন্মের অনুভূতির মূল্যায়ন না করে নিজেদের ক্যারিয়ার নিয়েই বেশি চিন্তিত। এমন না যে, এতে করে পূর্ব প্রজন্ম খুব বেশি একটা অসুখী। বরং উল্টোটাই বেশি সত্যি। ছেলেমেয়েরা সুখে আছেন এটা চিন্তা করেই বাবা-মায়েরাও সুখে থাকেন।

নাজমুল ভাই বলে চললেন, তাঁর পাশের বিছানার ভদ্রলোকেরও হৃৎপিণ্ডের অবস্থা বেশি ভালো না। তাঁর ছেলেমেয়েরাও ওনার থেকে দূরে থাকেন। উনি এই কয়েক দিন হাসপাতালের এই কক্ষে থাকায় তাঁদের সঙ্গে আলাপ করে এগুলো জেনেছেন। আলাপের এক পর্যায়ে হাসান ভাই টয়লেটে গেলে পাশের বিছানার ভদ্রলোক আমার কাছে এসে কুশল বিনিময় করে জিজ্ঞেস করলেন, উনি কি তোমার বাবা? আমি বললাম, বাবার মতোই। শুনে তিনি বললেন, তুমি আমার সঙ্গে আসো। তারপর আমি তাঁকে অনুসরণ করে হাসপাতালের করিডরে গেলাম। সেখানে থেমে তিনি প্রথম যে কথাটা বললেন, সেটা হচ্ছে, তোমরা তো তাকে মেরে ফেলেছ। শুনে আমি হতবাক হয়ে তাঁর মুখের দিকে চেয়ে আছি দেখে, তিনি বুঝলেন আমি ওনার কথা বুঝতে পারিনি।

তখন ভদ্রলোক দম নিয়ে বলা শুরু করলেন। বললেন, শোনো তোমাদের উচিত ছিল ওনার (নাজমুল ভাই) প্রথমবারের হার্ট অ্যাটাকের সময়ই তাঁকে এখানে নিয়ে আসা। তাহলে ওনার অবস্থা এতটা খারাপ হতো না। তা না করে তোমরা তাঁকে এদিকে সেদিকে নিয়ে গেছ। এতে করে সময়ের অপচয় হয়েছে আর ওনার হৃৎপিণ্ডের কর্মক্ষমতা কমে গেছে। এই হাসপাতালটা হচ্ছে অস্ট্রেলিয়ার সবচেয়ে ভালো হার্টের হাসপাতাল। এক দমে কথাগুলো বলে তিনি একটু দম নেওয়ার জন্য থামলেন। কারণ তাঁর নিজের হৃৎপিণ্ডের অবস্থাও ভালো না, নাজমুল ভাই বলেছিলেন। আমি তখন তাঁকে বললাম, এখানকার ব্যবস্থাটা ভালো না। কেউ অসুস্থ হলে তাকে প্রথমে তার বাসার কাছাকাছি কোনো একটা হাসপাতালে নিতে হয়। তারপর তারা দেখে যেখানে নিয়ে যেতে বলেন, সেখানে নিতে হয়। শুনে তিনি বললেন সবই ঠিক আছে। কিন্তু আমি ভাবছি ওনার প্রথম অ্যাটাকের পরই কেন ডাক্তার তাঁকে এখানে রেফার করেননি। কারণ তখন যদি তাঁকে এখানে নিয়ে আসা হতো তাহলে উনি এত দিনে পুরোপুরি ভালো হয়ে যেতেন। বলেই তিনি বারবার একই কথা বলতে থাকলেন। এটা অস্ট্রেলিয়ার সবচেয়ে ভালো হার্টের হাসপাতাল। আমি তাঁর কথা মনযোগ দিয়ে শুনলাম।

একজন প্রায় সম্পূর্ণ অপরিচিত ও ভিনদেশি মানুষের জন্য ওই মানুষটার মমতা মাখানো কথাগুলো শুনে আমার চোখ ভিজে গেল। মানুষের প্রতি আবারও নতুন করে আমার মনে শ্রদ্ধা ভাব তৈরি হলো। করিডর ধরে হাঁটতে হাঁটতে আমি আবার নাজমুল ভাইয়ের বিছানার কাছে ফিরে এলাম। এসে দেখে তিনি ততক্ষণে টয়লেট থেকে ফিরে এসেছেন। আমি তাঁকে বললাম, পাশের বিছানার ভদ্রলোকের সঙ্গে করিডরে একটু গল্প করছিলাম। শুনে হাসান ভাই বললেন, ওই লোকটা একটা পাগল টাইপের, কিন্তু মনটা একদম জলের মতো পরিষ্কার। শুনে আমি হ্যাঁ-না উত্তর দিয়ে গেলাম। নাজমুল ভাইয়ের কথা শুনে কে বলবেন, এই মানুষটার হৃৎপিণ্ডের মাত্র পঁচিশ শতাংশ কাজ করছে। প্রাণচাঞ্চল্যে ভরা একজন মানুষ। এই শরীর নিয়েও নিজের বাগানের একগাদা কাজ নিজ হাতে করেন। তাই তাঁকে দেখলেই নিজের মধ্যে এক ধরনের শক্তি অনুভব করতে শুরু করে। এই মানুষটার কাছ থেকেই আমি শিখেছি কীভাবে একজন মানুষকে তার গায়ের রং, পেশা ও ধনসম্পদের বাইরে গিয়ে শুধু মানুষ হিসেবে সম্মান করতে হয়। সেই মানুষটার হৃৎপিণ্ডের এমন খবর আমাকে খুবই অবাক করল। ভেতরে ভেতরে আমি ভেঙে পড়লেও বাইরে সেটা আমি প্রকাশ করলাম না।

আমি হাসপাতাল ছেড়ে একসময় বেরিয়ে এলাম। হাসপাতাল থেকে ডার্লিংহার্স্ট স্টেশন মিনিট দশেকের হাঁটা পথ। কিন্তু মনে হচ্ছিল রাস্তা যেন আর শেষ হচ্ছে না। হঠাৎ রাস্তার চার পাশের দৃশ্যপট পাল্টে যেতে থাকে। সামনের মোড়ের চায়ের দোকানে বেশি ভলিউমে বাংলা ছায়াছবি চলছে। দোকানের বেঞ্চগুলোতে সবাই পা তুলে বসে আছে। তাদের হাতের আঙুলের ফাঁকে জ্বলন্ত সিগারেট ধরা। আমাকে যেতে দেখে ঔৎসুক্য কিছু চোখ টিভি পর্দার থেকে সরিয়ে আমার দিকে তাকাল। তারপর জিজ্ঞেস করল কবে ফিরেছে অস্ট্রেলিয়া থেকে। এই মানুষগুলোকেই ছোটবেলা থেকে আমি দেখে এসেছি। তাদের কারও সঙ্গেই যে আমার রক্তের কোনো সম্পর্ক নেই সেটা বাইরে থেকে দেখলে কেউই বুঝতে পারবেন না। হঠাৎ গাড়ির হর্নের শব্দে আমার সংবিৎ ফিরে এল। অস্ট্রেলিয়ায় কোনো রাস্তা পার হতে গেলে সিগন্যালের বাতির খুঁটির গায়ের বোতাম চাপতে হয়। স্মৃতিকাতরতায় আমি বুঝতে পারিনি, বোতাম না চেপেই রাস্তায় পা দিয়ে ফেলেছি। তাই রাস্তার গাড়ি হর্ন দিয়ে আমাকে সতর্ক করেছে।

ট্রেনে উঠে আমি শুধু একটা কথায় ভাবছিলাম, যদি হঠাৎ আমার বাবা–মা কোনো কারণে অসুস্থ হয়ে পড়েন তাহলে তাঁদেরও একই অবস্থা হবে। তাঁদের কাছাকাছি আপনজন বলতে তো কেউ নেই। পাড়ার মানুষেরা অনেক আন্তরিক, তবুও প্রিয়জনের অভাব কোনোভাবেই পূরণ হওয়ার নয়। এটা ভাবতে ভাবতেই আমার কান্না পেয়ে যায়। কিন্তু আমি কাঁদতে পারি না। কারণ এখানে ট্রেনে বসে শব্দ করাটাকে অভদ্রতা হিসেবেই দেখা হয়। বোবা কান্না গলার কাছে এসে আটকে যায়। শুধু দুই চোখ থেকে অশ্রু গড়াতে থাকে। আমি তখন মনে মনে শপথ করি নাজমুল ভাইয়ের অসুখ না সেরে যাওয়া পর্যন্ত আর বাসা বদলাব না। প্রবাসে বাবা–মায়ের অভাবটা পূরণ করেছেন নাজমুল ভাই আর সন্ধ্যা ভাবি। দেশে বাবা–মাকে ফেলে এসে এই দুজন মানুষের সান্নিধ্যে আমি সেটাকে ভুলে আছি। তাই তাদের কোনোভাবেই আমি আর হারাতে চাই না।
...লেখকের ইমেইল: <[email protected]>