প্রবাসীর বোবা কান্না

সপরিবার সমরেন্দ্র নাথ পোদ্দার
সপরিবার সমরেন্দ্র নাথ পোদ্দার

সমরেন্দ্র নাথ পোদ্দার। আমাদের কাছে পরিচিত ছিলেন পোদ্দার স্যার নামে। আশি-নব্বই দশকের স্যারেরা শুধু শিক্ষকই ছিলেন না একইসঙ্গে তারা ছিলেন অভিভাবকও। অভিভাবকেরা আমাদের এই সকল শিক্ষকদের কাছে পড়তে পাঠিয়ে নিশ্চিন্ত হতেন যে, তার ছেলেমেয়ের জন্য স্যারেরাতো আছেনই। শিক্ষার্থীর সার্বিক ভালোমন্দ স্যারই দেখবেন। দরকার হলে এই স্যারই তার ছাত্রছাত্রীকে বকুনি দেবেন আবার ভালো করলে তিনিই সবার আগে বাহবা দেবেন। পোদ্দার স্যারের চরিত্রে এই দুই বিপরীতমুখী গুণের সর্বোচ্চ সমাবেশ ছিল। আমরা স্কুল পাস করে কুষ্টিয়ার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে কুষ্টিয়া সরকারি কলেজে ভর্তি হয়েছি। ভিসিআরে বাংলা সিনেমায় দেখেছিলাম কলেজের করিডরে এক সুন্দরী ছাত্রীর সঙ্গে ধাক্কা লেগে তার হাত থেকে বই পড়ে যায়। ছাত্র সেই বই তুলে দিতে গিয়ে তার প্রেমে পাগল হয়ে যায়। কিন্তু বাস্তবতা ছিল এর একেবারে এক শ আশি ডিগ্রি বিপরীত। আর সেই বাস্তবতার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতেন আমাদের স্যারেরা।

আতিয়ার স্যার, নওরোজ স্যার, সাত্তার স্যার, পোদ্দার স্যার, আকতার স্যার, সিরাজ স্যার, খালেক স্যার প্রত্যেকেই ছিলেন নিজ গুণে অনন্য। কিন্তু পোদ্দার স্যার আর সাত্তার স্যারকে আমরা ভয় পেতাম জমের মতো। অনেক সময় আমাদের বন্ধুদের অনেকেই স্যারেদের ধমক খেয়ে কাপড় নষ্ট করে ফেলার উপক্রম হয়েছে। তবে পোদ্দার স্যারের মধ্যে শাসনের ব্যাপারটা ছিল বাড়াবাড়ি রকমের বেশি। আমার মনে আছে, একবার স্যারের ক্লাসে কোনো এক ছাত্র বেয়াদবি করাতে স্যার তাকে ক্লাসের সকলের সামনে চড় মেরেছিলেন। আমার কাছে তখন ব্যাপারটা অনেক বাড়াবাড়ি মনে হয়েছিল। কিন্তু কলেজজীবন শেষ করার পর আমার ভুল ভেঙেছিল।

পোদ্দার স্যার ছিলেন অঙ্কের শিক্ষক। আমাদের কলেজে তেমন একটা ক্লাস হতো না। আর সব সময়ই কোনো না কোনো গন্ডগোল লেগেই থাকত। তাই সমস্ত বিষয় স্যারেদের কাছে প্রাইভেট পড়ে শেষ করতে হতো। আমি অন্য বিষয়গুলোর প্রাইভেট পড়লেও পোদ্দার স্যারের আচরণের ভয়ে তাঁর কাছে অঙ্ক পড়ার সাহস করিনি। অবশেষে টেস্ট পরীক্ষার পর একদিন বন্ধু সালাম বলল, তোকে পোদ্দার স্যার ডেকে পাঠিয়েছেন। শুনেই আমার হাত-পা ঠান্ডা হয়ে গেল। আমি কোনোমতে ঢোঁক গিলে বললাম আমাকে কেন? উত্তরে সালাম বলল, টেস্টে যারা ভালো ফলাফল করেছে শুধু তাদের নিয়ে স্যার একটা অঙ্কের ব্যাচ করেছেন। তোকে সেই ব্যাচে পড়তে যেতে বলেছেন। আমি বললাম, কিন্তু আমিতো বেতন দিতে পারব না তুই জানিস। সালাম বলল, আমি স্যারকে সবই বলেছি। স্যার তবুও তোকে যেতে বলেছেন। আমি এরপর একদিন দুরুদুরু বুকে স্যারের কাছে হাজির হলাম। চশমার ফাঁক দিয়ে স্যার আমার দিকে তাকিয়ে একটা অমায়িক হাসি দিলেন। যেটার সঙ্গে আমার পরিচয় ছিল না। এরপর আমি অনেক সহজ হয়ে গেলাম স্যারের সঙ্গে। উচ্চমাধ্যমিক ফাইনাল পরীক্ষার আগ পর্যন্ত স্যার অনেকগুলো পরীক্ষার নিলেন, অনেকটা টেস্ট পেপার সমাধান করার আঙ্গিকে। আমরা তখনো বুঝিনি আমাদের জন্য এক বিস্ময় অপেক্ষা করছে। এখানে বলে রাখা ভালো, স্যার একটা দিনের জন্যও আমাকে আমার পারিবারিক বা আর্থিক অবস্থার বিষয়ে জিজ্ঞেস করেননি।

উচ্চমাধ্যমিক ফাইনাল পরীক্ষা চলছে। অঙ্ক পরীক্ষার আগে অনেক বড় ছুটি। আর ছুটি থাকলেই যেটা হয় আমরা গা ছেড়ে দিই। এবারও তাই হলো। প্রথমপত্র পরীক্ষার হলে আশপাশের সবাইকে অঙ্কে পাস করানোর দায়িত্ব নিয়ে পরীক্ষা দিতে গিয়ে নিজে আর সম্পূর্ণ প্রশ্নপত্রের উত্তর করার সময় পেলাম না। দ্বিতীয়পত্রের পরীক্ষা চলছে। বলবিদ্যার মতো আজগুবি বিষয়গুলো আমরা অনেকটা না বুঝেই মুখস্থ বিদ্যার মতো করে মন থেকে উত্তর করে যাচ্ছি। হঠাৎ কানের কাছে একটা আওয়াজ শুনতে পারলাম। কী রে প্রশ্ন ঠিক আছে তো? আমি পরীক্ষার খাতা থেকে ঘাড় ঘুড়িয়ে দেখি পাশে পোদ্দার স্যার দাঁড়িয়ে আছেন। মুখে এক ধরনের ছেলেমানুষি হাসি। আমি তখনই বুঝে গেলাম, দ্বিতীয়পত্রের বলবিদ্যার প্রশ্ন স্যার করেছেন। তখনকার দিনে বিভিন্ন কলেজের স্যারেদের কাছ থেকে ফাইনালের জন্য প্রশ্ন আহ্বান করা হতো। তারপর সেখান থেকে যেকোনো একজনেরটা নির্বাচন করা হতো। আমি বুঝলাম এবার স্যারের প্রশ্নপত্র নির্বাচিত হয়েছে বলবিদ্যার জন্য। আমি বললাম সব ঠিক আছে স্যার। শুনে তিনি বললেন, ঠিক আছে তাহলে উত্তর কর। অঙ্কের দুই পত্রের মধ্যে সেসময় দ্বিতীয়পত্রে নম্বর ওঠানো অনেক কঠিন ছিল। কিন্তু আমার ক্ষেত্রে দ্বিতীয়পত্রেই বেশি নম্বর উঠল। ফাইনালের ফলাফল হাতে পাওয়ার পর দেখলাম অঙ্কে আমার লেটার মার্কস (আশি নম্বর) নেই তাই আর স্যারের সঙ্গে ভয়ে দেখা করিনি। শুনেছিলাম স্যার অনেক মুষড়ে পড়েছিলেন, আমাদের সারা ব্যাচে অঙ্কে মাত্র চারজন লেটার পাওয়ার কথা শুনে।

এরপর জীবন বয়ে চলল তার নিজস্ব নিয়মে। আর আমি পোদ্দার স্যারের কথা বেমালুম ভুলে গেলাম। পরবর্তীতে চাকরি জীবনে বাংলালিংকে এসে ওনার ছেলে শৌভিকের সঙ্গে আবার দেখা হয়ে গেল। আমি মোটামুটি নিয়মিতই স্যারের খোঁজ খবর নিতাম। এরপর একসময় শৌভিক অস্ট্রেলিয়াতে পাড়ি জমাল। এর কিছুদিন পর আমিও অস্ট্রেলিয়াতে চলে এলাম। তারপর বাংলালিংকে আমার আরেক সহকর্মী মিঠুদার মাধ্যমে শৌভিকের সঙ্গে আবারও যোগাযোগ হলো। শৌভিক জানাল, স্যার একবার অস্ট্রেলিয়ায় এসেছিলেন। আবার কিছুদিন পর আসবেন। আমি শৌভিককে বলে রাখলাম, এরপর স্যার আসলে আমাকে খবর দিয়ো, আমি এসে স্যারের সঙ্গে দেখা করে যাব।

এরপর বেশ কিছু সময় পার হয়ে গেছে। হঠাৎ দুই দিন আগে আমাদের আরেক শিক্ষক আকতার স্যারের ফেসবুক শেয়ার থেকে জানলাম পোদ্দার স্যার আর আমাদের মাঝে নেই। ঘটনাটা আত্মস্থ করতে বেশ কিছুটা সময় নিলাম। তারপর আকতার স্যারের শেয়ার করা লিংকে গিয়ে দেখলাম পোদ্দার স্যারের মেয়ে পোস্টটা দিয়েছেন। এরপর কলেজজীবনের সব ঘটনা একে একে চোখের সামনে ভেসে উঠতে শুরু করল। সেই কড়া শাসনের চোখ আবার একইসঙ্গে সেই আপন করে নেওয়া হাসি। ছাত্রের ফলাফল খারাপে সেই একই চোখে অশ্রু। অফিসের চেয়ারে বসে হঠাৎ যেন সময় আটকে গেল আমার। বারবার দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে। আহা আমাদের অভিভাবক, আমাদের শিক্ষকেরা সবাই একে একে হারিয়ে যাচ্ছেন। আমাদের প্রজন্ম আমরা সব সময়ই নিজেদের অনেক সৌভাগ্যবান মনে করি এমন ফেরেশতাতুল্য মানুষেরা আমাদের শিক্ষাগুরু ছিলেন। এরপর গত দুই দিন আর কোনো কাজে মনযোগ বসাতে পারিনি। বারবার মনে হচ্ছিল, যদি দেশে থাকতাম তাহলে নিশ্চয় এত দিনে স্যারের সঙ্গে একবারের জন্য হলেও দেখা হয়ে যেত। কিন্তু এই সাত সমুদ্র তেরো নদীর পাড়ে থেকে সেটা কখনোই সম্ভব না।

মিঠুদার কাছ থেকে আবার শৌভিকের ফোন নম্বর জোগাড় করে ফোন দেওয়ার কথা ভাবছিলাম। তখন জানতে পারলাম শৌভিক দেশে গেছে স্যারের মৃতদেহের সৎকার করতে। আমি নিশ্চিত ওকে আবার দ্রুতই অস্ট্রেলিয়ার এই যান্ত্রিক পরিবেশে ফিরে আসতে হবে। আবারও যন্ত্রের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ওকে কাজ করে যেতে হবে। কিন্তু হৃদয়ের রক্তক্ষরণটা আর থামবে না কখনোই। বোবা কান্না কেঁদে যাবে হৃদয়টা। হয়তোবা একদিন আমাদের সবারই ক্ষেত্রে এমন পরিস্থিতি তৈরি হবে। সামাজিক নিরাপত্তা, আর্থিক সচ্ছলতার দোহাই দিয়ে বিদেশে পাড়ি দেওয়া এই প্রথম প্রজন্মের বোবা কান্নাটা থামবে না কখনোই।
...

মো. ইয়াকুব আলী: মিন্টো, সিডনি, অস্ট্রেলিয়া। ইমেইল: <[email protected]>