প্রবাসীর না-বলা কথা

এক প্রবাসী ছেলের জীবনের না–বলা গল্প বলব আজ। তার আগে কিছু কথা আমার। প্রবাসী আমি। দক্ষিণ আফ্রিকায় প্রায় আট বছর যাবৎ বাস করছি। বহু সুখ-দুঃখ ও হাসি-কান্নার প্রত্যক্ষ সাক্ষী হয়েছি জীবনের এই বেলায় পৃথিবীর এই প্রান্তরে। বহু মৃত্যু দেখেছি। শত যন্ত্রণার জাঁতাকলে পিষ্ট হতে দেখেছি পবিত্র কত স্বপ্নকে। হতাশা আর না পাওয়ার যন্ত্রণায় কত প্রাণের যে নিঃশব্দে পতন ঘটতে দেখেছি এই চোখে, তা বলে শেষ করা যাবে না। জীবনসংগ্রামের এই সময়টাতে প্রতিটা মুহূর্তে কতই না উচ্চাকাঙ্ক্ষা নিয়ে পথ চলে একজন প্রবাসী।
তারপরেও অনেকের জীবনখাতার পাতাগুলো শূন্যই থেকে যায় অথবা লেখা হয় না পাওয়ার যন্ত্রণার এক মহাকাব্য। সব আশা ভরসা হারিয়ে নিঃস্ব হয় কত তাগড়া যুবক। অসহায়ত্বের জাঁতাকলে দুমড়ে মুচড়ে যেতে দেখেছি মধ্যবিত্ত পরিবারে বেড়ে ওঠা সেই যুবককে, যার স্বপ্ন ছিল একদিন সে পরিবারকে টানাটানির সংসার থেকে মুক্তি দেবে। অবশেষে হয়নি স্বপ্ন পূরণ। নিঃশব্দে কত জল গড়িয়েছে গাঁয়ের সবচেয়ে চঞ্চল ছেলেটার চোখ বেয়ে, তার হিসাব জানে কয়জন। স্বপ্ন দেখা ও স্বপ্ন পূরণ হওয়া বা না হওয়ার মাঝখানের ইতিহাসটাও কেউ জানে না। ভয়াল ট্র্যাজেডি রচিত হয় প্রবাসীর ওই সময়টার পরতে পরতে। যা কোথাও প্রকাশিত হয় না। কেউ জানতেও চায় না কখনো। দেশ ও পরিবারের সমৃদ্ধির জন্য সুদূর বিদেশের মাটিতে উপার্জন করেও তাদের মনে প্রতিনিয়ত বয়ে চলে বেদনার নীল স্রোত। সবাইকে সুখী রাখার প্রতিজ্ঞা নিয়ে যে ছেলেটা পাড়ি দিচ্ছে নিষ্ঠুর পৃথিবীর করুণার রঙ্গমঞ্চে, সেই প্রবাসীর না বলা কথাগুলো কেউ জানতে চায় না। জানানোর কোনো প্রয়াসও পাওয়া যায় না কোথাও সহজে।

শুধু দুঃখ আর হতাশাই নয়। এই প্রবাসের মাটিতে অনেকেই বাস্তবের জীবন নদীতে ভাসিয়েছে স্বপ্নের নৌকা। সাজিয়ে গুছিয়ে নিয়েছে এলোমেলো থাকা নিজের জীবনটাকে। নিজে সমৃদ্ধিশালী হয়েছে। উন্নয়নের ছোঁয়া লাগিয়েছে পরিবারে। তাদের ঘিরেও আছে এক রোমাঞ্চকর ইতিহাস। হাজারো চড়াই-উতরাই পার হয়ে আসার এক কষ্টের কাহিনি। সেগুলোও অজানা রয়ে যায়, চাপা পড়ে কালের পরিক্রমায়।
আমরা প্রবাসীরা জীবনের বাঁকে বাঁকে সুখ দুঃখের রোজনামচা লিখি প্রতিটা দিন। স্বপ্ন সাজাই আবার স্বপ্ন হারাই কত শত বার। এ জীবন যেন আমাদের স্বস্তি দেবেই না বলে পণ করেছে মনে হয়। তবুও আমরাও হার মানি না কখনো জীবন যেভাবেই চলে আমরা সেভাবেই নিজেকে মানিয়ে নেই।
এই বিদেশের মাটিতে আমিসহ আমার আশপাশের আরও অজস্র প্রবাসীর সুখ-দুঃখ, হাসি-বেদনা, চাওয়া-পাওয়া আর না পাওয়ায় যত ব্যথা বেদনা, অভিযোগ অনুযোগ ও মনের গভীরে লুকিয়ে থাকা দীর্ঘশ্বাস কিংবা প্রাপ্তির তৃপ্তির বাহাদুরি আছে, তার প্রায় সবটাই থেকে যায় অজানার নিকষ কালো আঁধারের সীমানায়। মহাকালের স্রোতে হারিয়ে যায় প্রবাসীর না বলা ইতিহাস।
অনেক অপ্রতুলতার মাঝেও প্রথম আলো প্রবাসীর হৃদয় নিংড়ানো কথাগুলো প্রকাশ করার সুযোগ দিয়েছে। যার ফলে প্রবাসীরা নিজের কথা বলতে পারছেন। আমি এক প্রবাসী হয়েও আজ আরেকজন প্রবাসীর কথা বলব। নিজের কথা বলার চেয়ে সেই প্রবাসীর কথাটাই আমার কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। আজ তার কথাই বলব।
মাত্র ১৫ বছর বয়সে প্রবাসের প্রান্তর অতিক্রম করেছিল ছেলেটা। যাপিত জীবনের চাহিদা মেটানোর সামর্থ্য তার পরিবারের ছিল। সমাজের অন্য আট দশটা পরিবারের চেয়ে খারাপ ছিল না ছেলেটার পরিবারের অর্থনৈতিক অবস্থা। তবুও এত অল্প বয়সে কেন তাকে প্রবাস নামক ঘূর্ণিপাকে হারিয়ে যেতে হয়েছিল সেই প্রশ্ন উঠতেই পারে। তবে উত্তর আমার জানা আছে। আমি সব জানি। আমি সেই ছেলেটার জীবনের অনাকাঙ্ক্ষিত এই টার্নিংয়ের সকল কারণ জানি। যে বয়সে লেখাপড়া করে ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার স্বপ্নে বিভোর হওয়ার কথা ছিল, যে বয়সে নদীর জলে ডুবিয়ে চোখ লাল করে বাড়িতে এসে মায়ের বকুনি খাওয়ার কথা ছিল, সেই বয়সে ছেলেটা প্রবাসে কোনো শিল্প কারখানায় সুপারভাইজার হিসেবে কর্মরত ছিল। তার কারণ আমি জানি। আর কেউ জানে না। হয়তো কেউ জানবেও না কোনো দিন।
যে সমাজ সবকিছুর আগে টাকাকে প্রাধান্য দেয়, যেখানে নতুন টাকা হয়েছে বলে সমাজের অগ্রহণযোগ্য, অযোগ্য লোকেরা জনপ্রতিনিধি হতে পারে, যেখানে শিক্ষার চেয়ে টাকার মূল্য বেশি, তেমন একটি সমাজের এক কিশোরের কচি বয়সে টাকার জন্য লেখাপড়া বাদ দিয়ে মাতৃভূমি ত্যাগ করাটা অস্বাভাবিক ছিল না। সেই ছেলেটার জীবনেও তাই হয়েছে। সমাজের কুৎসিত নিয়মকে ছুড়ে ফেলে সঠিক পথ তৈরি করতে পারেনি ছেলেটা ও তার পরিবার।

আজ সেই ছেলেটার গল্প বলব।
আমি ছেলেটাকে চিনি জানি। হৃদয়ের গভীর থেকে ভালোবাসি। অকৃত্রিম ভালোবাসা আজীবন থাকবে তার জন্য।
আমার জীবনে দেখা সবচেয়ে নিষ্ঠাবান পরিশ্রমী একটা ছেলে সে। জীবন চলার আঁকাবাঁকা পথের মোড়গুলোতে তারে কখনো থমকে দাঁড়াতে দেখিনি। নির্বিকার চিত্তে সব বাধা মোকাবিলা করে সামলে নিয়েছে নিজেকে, আগলে রেখেছে পরিবারকে। সে আমার ইমিডিয়েট ছোট ভাই। রুহুল আমিন। সতেরো বছর হয়েছে, আমার সঙ্গে তার সরাসরি দেখা হয় না। সে যখন প্রবাসে ছিল তখন আমি দেশে। এখন আমি প্রবাসে আর সে দেশে। সেই ৯৯ সাল থেকে আমরা বিচ্ছিন্ন, কিন্তু মনের উঠানে প্রতিনিয়ত আমাদের সাক্ষাৎ হয়, দেখা হয়, কথা হয়। তার কথাই বলছিলাম।
মাত্র পনেরো বছর বয়সে শিশু হিসেবে দক্ষিণ কোরিয়ায় যায় সে। মহল্লার ঘরে ঘরে তখন কোরিয়াপ্রবাসী হচ্ছে। সব শ্রেণিপেশার মানুষ। যারা মাছ ধরে খায় তারাও, আবার যারা ব্যবসা বাণিজ্য করে তারাও। সকল শ্রেণির মানুষের প্রথম পছন্দ তখন ছিল দক্ষিণ কোরিয়া। সেই জোয়ারে ভেসেছে আমাদের পরিবারও। পরিবারের প্রতিটা সদস্য শিক্ষার উচ্চস্তরে গেলেও সমাজের ভুল নিয়মের শিকার হয়ে প্রবাসী হয়ে এই ছেলেটাকে শিক্ষার মাধ্যমিক লেবেলেই থামতে হয়েছে। এটাই আমাকে কষ্ট দেয়। আমি অনুতপ্ত হই প্রতিনিয়ত। তবে আমি এই ভেবে কিছুটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলি, সমাজ তাকে কিছু দেয়নি কিন্তু প্রকৃতি তাকে ঠকায়নি। অনেক বেশি দিয়েছে। আমার নিরপেক্ষ বিচারে আমাদের পাঁচ ভাইবোনের পরিবারে সবচেয়ে বুদ্ধিমান, বিচক্ষণ, সৎ, পরিশ্রমী ও স্মার্ট শুধুমাত্র রুহুল। আমরা আর কেউ তার সমকক্ষ হতে পারিনি। সে সবখানে আমাদের পেছনে রাখার যোগ্যতা অর্জন করেছে। যুগ যুগ ধরে বহু পরিবারে দেখেছি একাধিক পুরুষ সদস্য প্রবাসের ঘানি টেনেও সংসারে উন্নয়নের ছোঁয়া লাগাতে পারে না আর রুহুলের মেধা আর পরিশ্রমে আজ নারায়ণগঞ্জের মতো শহরে আমাদের নিজেদের বাড়ি এবং একটি মাঝারি আকারের তৈরি পোশাক কারখানা চালু করতে পেরেছি। সবই শুধুমাত্র রুহুলের কল্যাণে। যা হোক, এক কথায় বলা যায় সে একজন সফল মানুষ এবং তার বদৌলতে পরিবারের অবস্থানও সম্মানজনক অবস্থানে প্রতিষ্ঠিত। আমি তাকে অনুসরণ করি। তার মতো হতে চাই। তার প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসা অফুরান।
আমরা তিন ভাই। খুব আপন আর ইস্পাত কঠিন ঐক্য নিয়ে পথ চলি। একেবারে ছোটটা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজির ছাত্র। নাম মহসিন। দুই বোনের নাম জাকিয়া আর জিনিয়া। মায়ার সংসারে বোন দুটিকেও খুব ভালোবাসি। ভালোবাসব আমৃত্যু। সবকিছু যাবে আসবে কিন্তু ভাইবোনদের প্রতি ভালোবাসা কোনো দিন হারিয়ে যাবে না। এটাই সত্য।
রুহুলের কথা বলছিলাম...।

কার জীবনে সমস্যা আসে না! কোন জীবন বাধাহীন! অধিকাংশ মানুষই জীবনের কঠিন সময়গুলোতে ভেঙে পড়ে। আশাহত হয়ে করুণ আর্তনাদে নিজেই বিষিয়ে তোলে নিজের জীবনকে। কিন্তু রুহুলকে দেখেছি অন্য সবার চেয়ে পুরো বিপরীত। সমস্যায় সে বিন্দুমাত্র বিচলিত হয় না, ভেঙে পড়ে না। সমস্যায় সঠিক গ্রহণযোগ্য সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত নিতে চুল পরিমাণ ভুল করে না।
আমি প্রবাসী। মা-বাবা, ভাই-বোন নিয়ে আমাদের সংসারে কী আছে আর কী পেয়েছি জানি না, তবে শান্তি আছে, সুখের তৃপ্তি আছে। হাসি খুশিতেই আমাদের জীবন অতিবাহিত হচ্ছে এখন পর্যন্ত। ভবিষ্যতে কী হবে জানি না, কিন্তু আজ পর্যন্ত ভালো আছি সুখে আছি সেটাই বা কম কিসের!
অথচ বহু প্রবাসীকেই দেখেছি একটু সময় পেলেই নীরবে জীবনের হিসাব মেলাতে বসেন। তারা জীবনের যোগফল মেলাতে পারেন না। পরিবারের চাহিদা পূরণ করতে গিয়ে তিল তিল করে সব বিলিয়ে দেন অকাতরে। পরিবারের ওপর বিশ্বাস রেখে সবকিছু করে যান। জীবনের সব উপার্জন দিয়েও নিজের বা পরিবারের জন্য কোনো স্থায়ী সংস্থান করতে পারেন না ৯০ ভাগ প্রবাসী। তারপরই শুরু হয় ভাঙন। স্বার্থের কাছে হার মানে পরিবারের উপার্জনক্ষম প্রবাসী ছেলেটা। ভাঙনের খেলার নির্মমতা তছনছ করে দেয় সবকিছু। পরিবারের একতা বিলীন হয়ে প্রতিষ্ঠিত হয় স্বার্থের স্রোতোধারা। সেই স্রোতে ভেসে চলে ভেঙে টুকরো হওয়া এক সময়ের ভালোবাসার সংসারের অস্তিত্ব। খুলে যায় পুরোনো মায়ার বাঁধন। কী যে করুন সেই দৃশ্য। কী যে নির্মম সেই ভালোবাসার কান্না। তা প্রকাশযোগ্য নয়।
এদিকে আমাদের পরিবারে সেই ভাঙনের খেলা খেলতে দিইনি আমরা তিন ভাই। ভবিষ্যতেও যেন মিলেমিশে সংসার সমাজের কল্যাণ করতে পারি সেই আশা মনে আছে।