
নিউইয়র্কে এক আড্ডায় কবি শহীদ কাদরীকে প্রশ্নটা করেছিলাম। ৩০ বছরের বেশি সময় ধরে আপনি বাংলাদেশ থেকে বাইরে আছেন। দেশের জন্যে কেমন লাগে? প্রশ্নটা শুনে তিনি কেমন যেন উদাস হয়ে গিয়েছিলেন। তারপর ধীরে ধীরে বললেন, ‘যেদিন থেকে দেশ ছেড়েছি সেদিন থেকেই দেশকে খুব গভীরভাবে উপলব্ধি করি। আমার একজন ভারতীয় ডাক্তার বন্ধু বলতেন টাকা-পয়সা অনেক করেছি কিন্তু রাত হলেই দেশের জন্যে কেঁদে কেঁদে বালিস ভিজাই। জানি দেশে অভাব-অনটন আছে, দুঃখ আছে তারপরও দেশ তো দেশই। নিজ দেশের চেয়ে আর কি কোনো দেশ হতে পারে? এই আমেরিকাতেও বাংলাদেশের মতো অবিরাম বৃষ্টি ঝরে কিন্তু বাংলাদেশের বৃষ্টির মতো এত সুন্দর বৃষ্টি পৃথিবীর আর কোন দেশে দেখতে পাব? বাংলাদেশের বৃষ্টি মানেই ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা কাগজের নৌকা পানিতে ভাসাচ্ছে, প্যান্ট গুটিয়ে মানুষজন রাস্তা পার হচ্ছেন। এই দৃশ্যগুলো কল্পনা করলে আমার কাছে উৎসবের মতো মনে হয়। বাংলাদেশের আকাশ অনেক সুন্দর। আমি নিত্য স্বপ্ন দেখি কবে আবার সেই সবুজ দেশটাকে দেখব। দেখব তো?’
জ্যাকসন হাইটসে বইয়ের দোকান অনন্যা ছিল একসময় আমাদের আড্ডার তীর্থস্থান। বলার অপেক্ষা রাখে না যে অনন্যার সেই অনন্য আড্ডার মূল কেন্দ্রীয় আকর্ষণ ছিল সৈয়দ শহীদ অর্থাৎ আমাদের শহীদ ভাই। প্রতিদিন সন্ধ্যার পর সেই ছোট্ট অনন্যাকে ঘিরে শুরু হতো কত রকমের আড্ডার আয়োজন। সে আড্ডার মূল বিষয়বস্তু থাকত বাংলাদেশ, সেই পেছনে ফেলে আশা সোনালি স্মৃতি। সেই আড্ডায় একদিনের কথা বেশ মনে আছে। আমাদের সঙ্গে আড্ডায় মাহফুজ নামের এক ভদ্রলোক সব সময় যোগ দিতেন। তিনি সেই সময় বাংলাদেশ থেকে সদ্য আগত। আর সে কারণেই তাঁর কাছ থেকে বাংলাদেশ-সংক্রান্ত তাজা খবর শুনতে আমরা আগ্রহের সঙ্গে বসে থাকতাম। একদিন হঠাৎ করে ঝনঝনিয়ে তাঁর মুঠোফোন বেজে উঠল। তিনি কলটা ধরলেন। সেই সময় অনন্যার বইয়ের দোকানটা ছিল একটা বেসমেন্টে। তিনি কথা বলার জন্য বাইরে চলে গেলেন। আর কিছুক্ষণ পর চোখটা রক্তজবার মতো লাল করে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে আমাদের কাছে চলে এলেন। খুব স্বাভাবিকভাবেই তাঁর কান্না দেখে আমাদের আড্ডায় ছেদ পড়ল। তিনি একটা চেয়ারে ধপ করে বসে মাথা নিচু করে অঝোরে কেঁদেই চলেছেন। আমরা সবাই তাঁকে বুকে জড়িয়ে ধরলাম। সান্ত্বনা দেওয়ার নিষ্ফল চেষ্টা করতে লাগলাম। অনেকক্ষণ পর তাঁর কাছ থেকে জানা গেল এই কিছুক্ষণ আগে বাংলাদেশে ওনার মা মারা গিয়েছেন। আরও জানতে পারলাম তিনি বাংলাদেশে যেতে পারবেন না, কারণ তাঁর বৈধ কাগজপত্র নেই। মাহফুজকে দেখে আমাদের বুকের ভেতরটা অজানা এক ভয়ে সঙ্গে সঙ্গেই যেন হু হু করে উঠল। আমরা সবাই বাংলাদেশে আমাদের বৃদ্ধ মা-বাবাদের রেখে আসি সম্পূর্ণভাবে সৃষ্টিকর্তার ওপর ছেড়ে দিয়ে। বাংলাদেশ থেকে যখন আমরা অজানা ঠিকানার উদ্দেশ্যে বের হই তখন আমাদের প্রবাসীদের চোখ শেষবারের মতো আটকে থাকে আমাদের বৃদ্ধ মা-বাবার দিকে। তাঁদের চরণ যখন কাঁপা কাঁপা হাত দিয়ে ছুঁয়ে দিই তখন বুকের ভেতর কিসের যেন ভয়ের শব্দ শুনতে পাই। আবার দেখা হবে তো? নাকি এই আমাদের শেষ দেখা? তখন মনে হয় কিসের বিদেশ আর কিসের কী? দেশ ছেড়ে কোথাও যাব না। কিন্তু প্রবাসী বলে কথা! প্রবাসীদের মনটা পাষাণ বানাতে হয় বাস্তবতার তাগিদেই। মনটা পাষাণ করেই আমরা সবাই ঘর ছেড়ে বের হয়ে পড়ি। এক অজানা ঠিকানায় আমাদের জীবনতরি ভাসাই।
আমার যুক্তরাষ্ট্রে চলে আসার আগের রাত। আম্মা আড়ালে নীরবে চোখ মুছছেন আর আমার ব্যাগ গোছাতে ব্যস্ত। আর আমি তখন আমার প্রিয় পিতার মুখোমুখি হয়ে ‘লাস্ট মিনিট ফাদারলি অ্যাডভাইস’ শুনছি। হঠাৎ করে আব্বা আমার হাত দুটো ধরে বললেন, ‘আচ্ছা, তোর সাথে আমার আবার দেখা হবে তো? তুই সত্যি সত্যি পড়াশোনাটা শেষ করে লক্ষ্মীছেলের মতো চলে আসবি তো?’
আমি আমার প্রাণপ্রিয় বন্ধু, শিক্ষক আর পরম পূজনীয় পিতাকে আশ্বস্ত করে বললাম, ‘কী যা তা বলছ? এই তো মাত্র চারটি বছর। তারপর দেশের ছেলে আবার দেশেই ফিরে আসব।’
না, আমিও তাঁকে দেওয়া কথা রাখতে পারিনি। সেই চার বছর এখন তির তির করে অনেকগুলো বছরে পেরোল। এই জগৎ-সংসারের বাস্তবতা, জীবনের এই কঠিন চেহারা, আর প্রতিষ্ঠার ইঁদুর দৌড়ে আমিও আটকে গেছি। আমি তাঁকে মিথ্যা আশ্বাস দিয়েছিলাম। তাঁর সঙ্গে আমার আর কখনো দেখা হয়নি। একদিন নিউইয়র্কে বন্ধুদের সঙ্গে যখন আমি আমার জন্মদিন পালনে ব্যস্ত ঠিক সেদিনটাতেই খবরটা পেয়েছিলাম। বাংলাদেশ থেকে একটা কল এল। কলের ওপার থেকে কয়েকটা শব্দ ভেসে এল। ‘তোর বাবা আর নেই।’ আমি তখন শোকে পাথর, চোখে অশ্রুধারা। বারবার মনে হচ্ছিল সেই বাবার চেহারাটা। শেষবারের মতো সেই কথাগুলো। মনে হলো, আমার পিতা যেন আমার ওপর অভিমান করেই চলে গেলেন। আমার জন্মদিনেই তাঁকে চলে যেতে হলো? আমিও আমার বাবার মৃত্যুর খবরে দেশে যেতে পারিনি। আরও অন্য সবার মতো এই বেদনাকে বুকের ভেতর স্থান দিয়ে কষ্টে নীল হয়ে এই কঠিন পরবাসকে আগলে ধরে পড়ে রইলাম।
আমি জানি, একজন প্রবাসী হওয়ার চরম খেসারত হলো ঘনিষ্ঠ আপনজনদের থেকে দূরে থাকা। আর সে কারণেই দেশে রেখে আসা বৃদ্ধ মা-বাবাদের চিন্তায় একজন প্রবাসী ঠিকমতো ঘুমাতে পারেন না। প্রতিদিন অজানা এক উৎকণ্ঠায় তাঁদের সময় কাটে। যদি কোনো অঘটন ঘটে? যদি কোনো খারাপ খবর পেয়ে যাই? তারপরও আমাদের জীবন চলে। সব দুঃখকে হজম করার নামই তো প্রবাসজীবন? প্রবাসীর সেই কান্নার দাগ কি কখনো শুকায়? শুকাতে পারে? একজন প্রবাসী ছাড়া প্রবাসীর এই কান্না আর কে এত গভীরভাবে শুনতে পায়?