প্রবাসীদের নির্বাচনের অভিজ্ঞতা
সম্প্রতি হয়ে গেল যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। এই নির্বাচন শুধু যুক্তরাষ্ট্রেই নয়, সারা বিশ্বের বুকে তুমুল আলোড়ন তৈরি করেছে। যুক্তরাষ্ট্র পৃথিবীর অন্যতম শক্তিশালী দেশ। তাই এ দেশের নির্বাচনের ওপর বিশ্ববাসীর নজর থাকে খুব স্বাভাবিক কারণেই। কিন্তু এবারের নির্বাচন আরও একটি কারণে বিশেষ গুরুত্ব পেয়েছে, সেটি হলো পৃথিবীজুড়ে দীর্ঘ আট মাসব্যাপী চলমান মহামারি, যা বিশ্বের সব দেশের জীবনযাত্রা, অর্থনীতি—সবকিছু প্রায় অচল করে দিয়েছে।
মহামারির শুরুতে যদিও যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বিষয়টিকে তেমন গুরুত্ব দেননি, কিন্তু প্রকৃতি তার নিয়মে তাঁকে কাঁচকলা দেখিয়ে মহামারি দিয়ে ধরাশায়ী করে দিয়েছে। আমাদের সাধারণ জনগণের তত দিনে অনেক ক্ষতি হয়ে গিয়েছে। হু হু করে বাড়ছে আক্রান্তের হার, মরছে মানুষ। প্রথম প্রথম রোগ নির্ধারণের ব্যবস্থাও অপ্রতুল ছিল, হাসপাতালগুলো প্রস্তুত ছিল না। এই ঝড়ের ধাক্কা সামলাতে গিয়ে মাথায়ই ছিল না সামনে নির্বাচন। মহামারি যেমন করে আমাদের জীবনযাপনকে আমূলে পরিবর্তন করে দিয়েছে, সত্যি বলতে নির্বাচনের নমিনেশন ঘোষণা পর্যন্ত ঠিকঠাক বিশ্বাসই হচ্ছিল না যে এ অবস্থায় নির্বাচন হতে পারে। চারদিকে লকডাউন।
সেটা শিথিল হলেও জনসমাগম তো সম্ভব নয়। দ্বারে দ্বারে ভোট চাইতে আসবে না, মিটিংয়ের পর মিটিং হবে না, র্যালি হবে না, এ কেমন নির্বাচন। কিন্তু আমেরিকা বলে কথা। এ দেশের নিয়মকানুন এতোই কঠোরভাবে মানা হয় যে যত দেখি ততই অবাক হই। যত যা–ই ঘটুক, নির্বাচন হবে যথাসময়ে। প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প নানা রকম ভিত্তিহীন আশ্বাস দিচ্ছেন, শিগগিরই ভ্যাকসিন আসছে। নানাভাবে সান্ত্বনা দিচ্ছেন, এই ভাইরাস তেমন বিশেষ কিছু নয়। তিনি নিজেও মাস্ক পরেন না, যেন অনেকটাই প্রমাণ করার জন্য যে এটাকে আসলে পাত্তা দেওয়ার কোনো কারণ নেই। নির্বাচনের আগে অর্থনীতিকে চাঙা রাখতে হবে। তাই জনগণের স্বাস্থ্যের ঝুঁকি নিয়েও তিনি সবকিছু খোলা রাখার স্বপক্ষে। তাঁর এই গোঁয়ার্তুমির কারণে কিন্তু সাধারণ মানুষ অনেকেই তাঁর বিপক্ষে চলে গেছে। আর যা–ই হোক, জীবনের ঝুঁকি তো নেওয়া যায় না। স্বাস্থ্যবিধি না মেনে, জনসমাবেশ করে তিনি নিজেও করোনায় আক্রান্ত হলেন। আবার সবাইকে অবাক করে দিয়ে দ্রুত সুস্থও হয়ে গেলেন।
এদিকে ডেমোক্রেটিক দল অনেক তরুণ ও প্রগতিশীলকে হতাশ করে দিয়ে বার্নি স্যান্ডারসকে মনোনয়ন দিল না। তারা মনোনয়ন দিল সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনকে। এবং আরও ঝুঁকি নিয়ে তাঁর সঙ্গে ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে মনোনয়ন পেলেন আফ্রিকান–আমেরিকান এবং ভারতীয় বংশোদ্ভূত নারী সিনেটর কমলা হ্যারিস। এই মনোনয়ন অনেকেরই মনঃপুত হয়নি। যুক্তরাষ্ট্রের জনগণের কাছে মহিলা প্রার্থীর গ্রহণযোগ্যতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে বারবার। প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার সঙ্গে ভাইস প্রেসিডেন্ট থাকাকালে জো বাইডেন তেমনভাবে ঝলসে ওঠেননি। প্রচণ্ড ব্যক্তিত্বশালী ওবামার ছায়াতলে তাঁর নেতৃত্বের শক্তিমত্তা, দৃঢ়তা যেন কিছুটা মিইয়ে ছিল। মুখরা ট্রাম্পের প্রাণশক্তির পাশে সজ্জন, মিষ্টভাষী, সুশীল বাইডেনকে দেখে অনেক সময়ই তাঁর নেতৃত্ব নিয়ে সংশয় জাগে। এসব কিছু মিলিয়ে ডেমক্র্যাটরাও যে খুব শক্ত অবস্থানে ছিলেন, তা নয়। উপরন্ত বাইডেন-হ্যারিস প্রথম থেকেই মহামারির ব্যাপারে খুবই সতর্ক। তাঁরা জনসমাবেশ করেননি। যা করেছেন সবই ভার্চ্যুয়াল খুব বুঝে–শুনে।
একটা কথা বেশ বোঝা যাচ্ছিল যে ডোনাল্ড ট্রাম্পকে ব্যক্তি হিসেবে কেউ পছন্দ করে না। কোভিডে তাঁর নীতি, ইমিগ্র্যান্ট বিষয়ে তাঁর নীতি, বর্ণবাদী আচরণ, মহিলাদের অবমাননা, এলোমেলো কথাবার্তা—এসব কারণে অনেকেই তাঁর উপর রুষ্ট ছিল। এবং এই প্রথম যুক্তরাষ্ট্রে কোনো প্রেসিডেন্ট, যিনি নির্বাচনের আগে থেকেই ধুয়া তোলা শুরু করলেন যে নির্বাচনে কারচুপি হবে। যেটা যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে অবিশ্বাস্য। কোভিডের কারণে এবার নির্বাচনে প্রচুর মানুষ মেইল করে ভোট দিয়েছেন। তবে গত নির্বাচন থেকে মানুষ আর কিছু না হোক একটা কঠিন শিক্ষা পেয়েছে যে ভোট দেওয়া অত্যন্ত জরুরি। ট্রাম্পের শাসন পরিবর্তন করতে হলে ভোট দেওয়াই একমাত্র পথ।
ভোটের দিনে শুরুর দিকের কিছু ফলাফল যখন আসছিল, প্রথম দিকে ট্রাম্পকে বেশ কিছু ভোট পেতে দেখে আমি অবাক হয়েছি। আমরা যারা ইমিগ্র্যান্ট, বিশেষ করে বাংলাদেশি, আমাদের মধ্যে প্রায় কেউকেই দেখা যায়নি ট্রাম্পের অনুসারী। এমনকি আমি আমার অন্যান্য দেশি বা আমেরিকান বন্ধুদের মধ্যেও খুব বেশি ট্রাম্পভক্ত দেখিনি। তাই ভাবছিলাম, এঁরা কারা, যাঁরা ট্রাম্পকে ভোট দেন? টানা চার দিন তুমুল উত্তেজনা আর দুশ্চিন্তায় সময় গেছে। একবার ট্রাম্প বক্তব্য রাখেন, আরেকবার বাইডেন। ট্রাম্পের যথারীতি উদ্ধত রূপ। সে ভোটের কারচুপির অভিযোগ তুলেছে।
এমনকি নিজেকে বিজয়ীও ঘোষণা করে দিল। এক স্টেটে ভোট গণনা বন্ধ করতে বলে যে স্টেটে তিনি এগিয়ে যাচ্ছেন, সেখানে তাড়াতাড়ি গুনতে বলেন। তাঁর সমর্থকেরা ভোটকেন্দ্রের সামনে বিক্ষোভ করছেন। এসব দেখে যারপরনাই অবাক হয়েছি। আরও অবাক হয়েছি বাইডেনকে দেখে। সৌম্য মূর্তি। ক্ষমতাসীন নয়, তারপরও আইনে তাঁর আস্থা আছে। সব ভোট গণনা পর্যন্ত জনগণকে ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করতে বলছেন। আরেকবার যুক্তরাষ্ট্রের আইনের শাসন আমাকে মুগ্ধ করেছে। স্বয়ং প্রেসিডেন্ট নানা ফন্দিফিকির, অভিযোগ করেও নির্বাচনব্যবস্থাকে টলাতে পারেননি। সর্বশেষ স্টেট পেনসিলভানিয়ায় ন্যূনতম ব্যবধানে জিতে গিয়ে বাইডেন ও হ্যারিস যথাক্রমে প্রেসিডেন্ট ও ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন শুক্রবার সকালে (স্থানীয় সময়)।