প্রথম বিদেশ ভ্রমণে অম্ল মধুর অভিজ্ঞতা

নভেম্বর ২০০১, জীবনের প্রথম বিদেশ যাচ্ছি, তাও আবার আমেরিকা, ভাবতেই কেমন লাগছিল। এক ধরনের শিহরণ অনুভব করছিলাম মনে মনে। ইউনেসকোর পাঠানো আমন্ত্রণপত্র নিয়ে বাসায় ফিরলাম। বাসায় ফিরে মনটা যারপর নাই বেদনায় ভরে গেল, যখন টিভিতে টুইন টাওয়ারে বিমান হামলার খবরটি দেখলাম। কী আর করা। আশা নিরাশার দোলাচলে পরদিন আইসিডিডিআরবিতে পৌঁছে মেরিল্যান্ড ইউনিভার্সিটি থেকে ইমেইল পেলাম, যার বিষয়বস্তু হলো আপাতত ভিসার জন্য আবেদন করার দরকার নাই। মনটা আরও খারাপ হলো। ডিসেম্বরের শেষের দিকে ভিসার জন্য আবেদন করে জানুয়ারির ১৫ তারিখে ভিসা পেলাম। ভিসা পেয়ে আনন্দিত হওয়ার কথা থাকলেও তখনকার আমেরিকার সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় খুব একটা ভালো লাগছিল না। কি জানি কি হয়। টিকিট আগে থেকেই বুকিং দেওয়া ছিল। জানুয়ারির ১৭ তারিখে আমেরিকা রওনা হলাম। সঙ্গী আমার জুনিয়র কাম কলিগ। দুজন যাচ্ছি এ জন্যে ভালোই লাগছিল। এ ছাড়া আমার কলিগের আমেরিকা ভ্রমণের অভিজ্ঞতা আছে। ভিসা যখন হাতে পাই তখন এতটাই আনন্দিত ছিলাম যে আমরা যে জে১ ভিসার পরিবর্তে বি১ পেয়েছি সেটা বেমালুম ভুলে গেলাম। আসলে আমার কলিগ আমাকে বলল, ভাইয়া কোনো চিন্তা করেন না, ভালোই হয়েছে। জে১ ভিসায় কিছু সীমাবদ্ধতা থাকে বি১ ভিসায় কোনো সীমাবদ্ধতা নাই। তার কথায় আশ্বস্ত হলেও মনের মধ্যে সেটা খুঁতখুঁত করতে লাগল।
অনেক লম্বা একটা ভ্রমণ ও চড়াই-উতরাই পার হয়ে ক্লান্ত পরিশ্রান্ত হয়ে আমেরিকাতে জীবনের প্রথম পা রাখলাম ডেট্রয়েট বিমান বন্দরে। বিমান থেকে এসে ইমিগ্রেশনের জন্য অপেক্ষা করছিলাম। কিন্তু লক্ষ্য করলাম, একই প্লেন থেকে আসা অন্য সব যাত্রীরা আগে আগে চলে যাচ্ছে কিন্তু আমাদের ডাকার কোনো লক্ষণ নাই। মনে একটু সন্দেহ দানা বাঁধতে শুরু করল। এমনিতেই জে১ ভিসার পরিবর্তে বি১, আবার টুইন টাওয়ারের ঘটনার পরে সবখানেই কড়াকড়ি। কী আর করা। মনে মনে অনেক সাহস জোগাড় করে ইমিগ্রেশন অফিসারকে ফিসফিস করে বললাম, আমরা তো অনেকক্ষণ ধরে অপেক্ষা করছি, তোমরা তো আমাদের ডাকছ না। আমাদের কানেক্টিং ফ্লাইট তো চলে যাচ্ছে। আমার কথা শুনে সাত ফুটের মতো লম্বা সাদা লোকটি আমার দিকে যেভাবে চোখ কটমট করে তাকাল, তাতে আমি কিছুটা ভড়কেই গেলাম। লোকটি শুধু বলল সিট ডাউন। আর কী? বসেই পড়লাম। এবার আমার ধারণা কিছুটা সত্যি হতে শুরু করল। সেই সাথে এক ধরনের অজানা ভীতি কাজ করতে লাগল। আমার সহকর্মীর মুখের দিকে তাকাতে পারছি না। সেও ভয়ে জড়সড়। দুজনে কথা বলারও সাহস পাচ্ছি না। শেষে আবার কীসে কি হয়। অনেক অপেক্ষার পরে আমাদের ডাক পড়ল। অল্প বয়সী একজন সুদর্শন অফিসার আমাদের দুজনকে ইশারায় ডেকে একটা কক্ষের মধ্যে নিয়ে গেলেন। কক্ষে আমাদের ঢুকিয়ে দিয়ে উনি বাইরে থেকে দরজা লক করে চলে গেলেন। আমি মোটামুটি নিশ্চিত আমরা এক ধরনের জেলখানায় বন্দী হলাম। কিন্তু আমেরিকার মতো দেশে বিনা দোষে এভাবে জেলে ঢোকাবে মেলাতে পারছিলাম না। যাহোক, দুজনে মনে মনে দোয়া পড়া শুরু করলাম। অনেক পরে অফিসার আমাদের সবুজ রঙের পাসপোর্ট দুখানি হাতে নিয়ে আমাদের কক্ষে প্রবেশ করলেন। গম্ভীর মুখে আমাদের সামনে বসলেন।
প্রথমেই আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ওকে মিস্টার খান, নাউ টেল মি, তোমার পাওয়ার কথা জে১ ভিসা, সেখানে তুমি বি১ ভিসা কিভাবে পেলে? তোমার দেশে কি মার্কিন ভিসা মানিপুলেট হয়? ভেরি গুড। কিন্তু তুমি আমাকে বলো, এটা তুমি কীভাবে সম্ভব করলে? আমি নিজেকে খুব স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করলাম। যদিও হার্টবিট তখন এক শর ওপরে। আমি বললাম, দেখো, ব্যাপারটা আসলে তেমন কিছুই না। এখানে কিছুই মানিপুলেট করা হয়নি। আমরা জে১ ভিসার জন্য কাগজ জমা দেবার পরও তোমার দেশের অ্যাম্বেসি কেন আমাদের বি১ ভিসা দিয়েছে সেটা আমাদের বোধগম্য নয়। তবে আমাদের হাতে সময় না থাকার কারণে আমরা পুনরায় ভিসার জন্য আবেদন করতে পারিনি। আমাদের কাছে জে১ও যা বি১ও তা। আমরা একটা ট্রেনিংয়ে এসেছি, যত তাড়াতাড়ি ফিরতে পারব ততই ভালো। আমাদের দুই মাসের বেশি থাকার কোনো উপায়ও নেই, সম্ভব হলে আগেই চলে যাব। অফিসার আমাকে সাবধান করে দিয়ে বললেন, বলো আমি, আমরা না। আমি বুঝে নিলাম আমার সহকর্মীর কেসটা আরও একটু জটিল। কেন জটিল সেটা বুঝতে পারলাম না। অফিসার আমাকে বললেন, তোমাকে যদি এখন ডিপোর্ট করা হয় তাহলে কেমন হয়? ভেতরে ভেতরে আমি ভাবছি হয়তো সে আমাদের ডিপোর্টই করবে। কিন্তু বিনা যুদ্ধে এক চুল ধরণি কেন দেব? আমি বললাম, দেখ তুমি চাইলে আমাকে ডিপোর্ট করতে পারো। কিন্তু আমাকে তোমার বলতে হবে আমার কি দোষ? সে বলল, তোমার দোষ অনেক বড়। তুমি ভুল ভিসা নিয়ে এসেছ। আমি বললাম, না আমি কোনো দোষ করিনি। আমাকে ভুল ভিসা দেওয়া হয়েছে। তুমি আমাদের দেশের তোমার অ্যাম্বেসিতে ফোন করো। যদি কোনোভাবে প্রমাণ করতে পারো আমি দোষী, দেন আমাকে ডিপোর্ট করো। অফিসার আমার দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে নিয়ে আমার সহকর্মীর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ওকে মিস্টার মামুধ (তার নাম মাহমুদ), তুমি এই কাজটা কীভাবে করলে? তুমিতো একবার আমেরিকা এসেছ, কেনো তুমি পাসপোর্টের ভেতরে অ্যাম্বেসি থেকে দেওয়া এনভেলপটা খুলেছ? তোমাকে তো অ্যাম্বেসি থেকে বলা হয়েছিল এটা না খুলতে। এবার আমি বুঝতে পারলাম তার অপরাধ। অফিসার আরও বললেন, খুলেছ ভালো কথা সেটা আবার পুনরায় লাগানোর চেষ্টা করেছ। বলো, কেন এটা করতে গেলে? আমার সহকর্মী শুধু আস্তে করে বলল, সরি স্যার। অফিসার পাসপোর্ট দুটা হাতে নিয়ে বেরিয়ে গেলেন। আমি তখন সহকর্মীকে সান্ত্বনা দিতে চেয়েও তার মুখের দিকে তাকিয়ে আর পারলাম না। আহারে বেচারা।
আরও প্রায় ঘণ্টা খানেক পরে অফিসার আসলেন। এর মধ্যে হয়তো কিছু খবরাখবর তার নেওয়া হলো। এসে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, তুমি আমেরিকা থেকে যেতে পারো কিন্তু তোমার বন্ধুকে আমাদের ডিপোর্ট করতে হবে। আমি বললাম, দেখো সে তো একটা ভুল করে ফেলেছে এবং সরিও বলেছে, এবারের মতো ক্ষমা করে দাও। এই ট্রেনিংটা আমাদের জন্য খুবই জরুরি। অফিসার আবারও বাইরে গিয়ে অনেক পরে ফিরে আসলেন। এসে আবার আমকে জিজ্ঞেস করলেন, তোমরা মেরিল্যান্ডে গিয়ে কোথায় থাকবে? এতক্ষণে আমার বুক ধড়ফড়ানি একটু কমল। আমি সানন্দে আমার বুক পকেটে যত্ন করে রাখা ইউনিভার্সিটি অব মেরিল্যান্ডের বন্ধু বাদলের পাঠানো ইমেইলটা বের করে অফিসারকে দিয়ে দিলাম। অফিসার ইমেইলটা পড়লেন। ইমেইলের নিচের একটা অংশ বোল্ড করে লেখা ছিল। সেটা পড়ে অফিসার মনে হয় হাসতে হাসতে চেয়ার থেকে পড়েই যাচ্ছিলেন এমন অবস্থা। আমি এবার জিহ্বায় কামড় দিলাম। আসলে ইমেইলের নিচে লেখা ছিল যার অর্থ দাঁড়ায়, বন্ধু, আসার সময় আম্বালা থেকে দুই কেজি শুকনা মিষ্টি আনবা, কিন্তু ঘুণাক্ষরেও মিষ্টির কথা ইমিগ্রেশন অফিসারকে বলবে না। আমি ভাবলাম, এবার মনে হয় আম ছালা দুটাই গেল। কিন্তু ইমেইলটা পড়ে অফিসার একদম বদলে গেলেন। জোরে জোরে হাসতে লাগলেন। আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ওহ কাম অন, চিয়ার আপ ইয়াং ম্যান। লিসেন, ইউ আর গোয়িং টু বি বেনেফিটেড ফর টেলিং মি দ্য ট্রুথ। আমাদের দুজনের পাসপোর্টের বি১ ভিসা কলম দিয়ে খস করে কেটে সেখানে জে১ এর সিল লাগিয়ে দিলেন। আমাদের দুজনের দুটা লাগেজ নিজে হাতে এবং কাঁধে নিয়ে নিজে দৌড়াতে লাগলেন আর আমাদের বলতে লাগলেন রান রান। আমাদের একদম লাগেজ ক্লেইমের জায়গায় নিয়ে আমাদের বড় লাগেজগুলো ট্রলিতে উঠিয়ে ক্লিয়ারেন্স জোন (কোনো রকম চেকিং ছাড়া) পার করে দিয়ে হ্যান্ডশেক করে বললেন, সরি ফর ইউর ডিলে, এনজয় ইউর ট্রিপ ইন আমেরিকা। আমরাও ধন্যবাদ দিয়ে বাল্টিমোরের কানেক্টিং ফ্লাইট ধরার জন্য দৌড়াতে লাগলাম, যদিও আমাদের নির্ধারিত ফ্লাইট চলে গেছে অনেক আগেই। হঠাৎ দেখি আমার সহকর্মী নাই। নাই তো নাই। এদিক-ওদিক অনেক খুঁজেও পেলাম না। মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল। আমি বাল্টিমোরের বিমানে উঠে পড়লাম। উঠে দেখি বিমানেও নাই। ফ্লাইট অ্যাটেন্ডেন্টকে বললাম, দেখো আমি আমার ভ্রমণসঙ্গীকে হারিয়ে ফেলেছি। সে বলল, ডোন্ট অরি, আই গেস হি গট ইনটু আ রং ফ্লাইট। যা হোক মন খারাপ নিয়ে বাল্টিমোর পৌঁছে শুনলাম আমার সহকর্মী তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে পিট্সবার্গের বিমানে উঠে পরেছিল। এই ঘটনা থেকে আমি যা শিখেছি তা হলো ইমিগ্রেশনে কখনোই কোনো মিথ্যা বলতে নাই।