প্রত্যাশার ওপারে

পৌর পার্ক বা লাল পার্ক জমে ওঠে সন্ধ্যা নামার পরপর। শহরের ব্যস্ত মানুষগুলো বেলা গড়াতেই ছুটে আসে এখানে। কর্মদিবস শেষে পরিশ্রান্ত মানুষের দল কৃত্রিমভাবে সাজানো পার্কে প্রকৃতির ছোঁয়া খোঁজে। হাসান সাধারণত এদিকে খুব একটা আসে না। আজ ওর মন খারাপ। মনের ভেতর কিছু চাপা ব্যথা থেকে থেকে জানান দেয় আমি আছি। মাঝে মাঝে এমন হয়। মন জুড়ে কী এক বিষণ্নতা! আফরোজের সঙ্গে পরিচয় প্রায় এক যুগ আগে। ক্লাস এইটের ছাত্রী। হাসান ক্লাস টেন, একই স্কুল, একই এলাকা। ভালো ছাত্র হওয়ার কারণে আফরোজের মা মেয়েকে পড়ানোর জন্য হাসানকে পছন্দ করেন। টাকা পয়সার যে খুব একটা অভাব ছিল এমন নয়। বাবা সরকারি কর্মকর্তা। বাড়িতে বিষয়টা উত্থাপন করতেই ক্ষেপে ওঠেন হাসানের মা, সালেহা বেগম। সোজাসাপ্টা বলে দেন, নিজের পড়াশোনায় মন দাও। বাবারও একই কথা, এখন এসব নিয়ে ভেবো না। বাদ দাও। মাথা থেকে ঝেড়ে ফেল। হাসান শান্ত ছেলের মতো ঘাড় নাড়ে। প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে।

বিকেলের দিকে কৃষ্ণ মন্দিরের ছোট খেলার মাঠে বন্ধুরা শ্যাডো ক্রিকেট খেলত। সারা এলাকায় খেলাধুলা করার মতো জায়গা ছিল না। প্রায় ১৫০ বছরের পুরোনো মন্দির, তার সামনে ছোট্ট ফাঁকা জায়গা। মাঠের উত্তর প্রান্তে বড় পুকুর। পুকুরের চারপাশ সবুজ শ্যামল গাছপালায় ভরা। গাছগুলো বহু পুরোনো। এক প্রকার জঙ্গল। বড় বড় কিছু গাছ যেন মাথা উঁচিয়ে জানান দেয়, আমরা স্বাধীনতা যুদ্ধের সাক্ষী। নির্মম, নিষ্ঠুর নির্যাতনের সাক্ষী। আমরা বিজয়েরও সাক্ষী। পুকুরের পাশ দিয়ে জঙ্গল ঘেরা চিকন গলির মাথায় আফরোজদের দোতলা বাড়ি। সম্ভবত ব্রিটিশ আমলে নির্মিত। সৌন্দর্য বলে দেয়, এটা বহুযুগ আগের কোনো ধনী মানুষের স্বপ্নে সাজানো প্রত্যাশার বাড়ি। সুরকি বিছানো রাস্তা একেবারে বাঁধাই করা পুকুর ঘাটের সঙ্গে মিশেছে। ৪৭-এ দেশ ভাগের পর কোনো এক সময় ভালোবাসায় লালিত ভূখণ্ড। প্রত্যাশা আর স্বপ্নে সাজানো বাড়ি। ছেড়েছেন সবকিছু, হয়তো নিরাপদ মনে করেননি। তারা দেশ বদল করলেও বাড়ি, পুকুর, মন্দির কালের সাক্ষী হয়ে আছে।

বিকেলে খেলার সময় ওপারে আফরোজ আর তার বান্ধবীদের দেখা যেত। পুকুরের শানবাঁধানো ঘাটে উঁকি দিয়ে গাছপালা ঘেরা বাড়ির দিকে হারিয়ে যাওয়া, আবার আসা। হাসানকে দেখেই মোস্তাফিজ প্রশ্ন করে, কবে থেকে শুরু?

—না করে দিয়েছি।

—কেন কেন! পাগল নাকি?

— বাবা-মা নিষেধ করেছে।

—দেখ হাসান, ভুল করিস না।

হাসান বেশ অবাক হয়, কিসের ভুল?

—আফরোজের মতো নম্র, ভদ্র, মার্জিত, সুন্দরী মেয়েকে আপন করার সুযোগ হাতছাড়া করিস না।

মোস্তাফিজের কথায় জীবনে প্রথম মেয়েদের বিষয়ে কিছুটা দুর্বলতা অনুভব করে বুকের ভেতর।

—না করে দিয়েছি যে!

—এ জন্যই চাচি তোকে দেখা করতে বলেছে।

সেদিন রাতে আফরোজের মায়ের সঙ্গে অনেক কথা। ইঞ্জিনিয়ার রাহাত সাহেবের একমাত্র সুন্দরী মেয়ে আফরোজ চুপচাপ বসেছিল। অনেকটা দূর আকাশে ওঠা জ্বলজ্বলে পূর্ণিমার মতো আলো ছড়িয়ে।

‘তোমরা ভাই বোনের মতো। এটাকে তুমি প্রাইভেট টিউশনি মনে করো না’—বলেন আফরোজের মা রাশিদা বেগম।

—চাচি আমার বাবা-মা চাইছেন না...

—আচ্ছা ওনারা জানবেন না। তুমি যখন মন চায়, এসে একটুখানি দেখিয়ে দিও।

সেই থেকে শুরু। প্রথম সপ্তাহে রাশিদা বেগম প্রথম অভিযোগ দেন—‘ও পাড়ার জাহিদ কি বলেছে জানো?’

—না। জানি না।

—সে নাকি আফরোজকে ভালোবাসে। আমি ডেকে আচ্ছা মতো বলেছি। আমার মেয়ের দিকে ফের চোখ তুলে তাকালে চোখ উপড়ে ফেলব।

হাসানের বুকের ভেতর ধক করে ওঠে। জাহিদ ছেলেটা মন্দ না। তার চোখ তুলে ফেলবে! সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এমন ঘটনার সাক্ষী হতে থাকে হাসান। সবশেষে তার বন্ধু জসিম একই কাজ করে বসে। প্রথমে হাসানকে বলেছিল, তুই বলে দে। তোর তো ছাত্রী।

হাসানের গলা মুখ শুকিয়ে আসে। ‘মাফ চাই। ও মেয়ের সামনে কিছু বললে সে তার মায়ের কাছে বলে দেয়।’

—আমারটা বলবে না।

—তোরটা তুই বলিস।

—আচ্ছা, আমিই বলব।

তার পরদিন একই ব্যাপার। রাশিদা বেগম এসে বলেন, ‘তোমার বন্ধু এমন কথা বলবে ভাবিনি।’

হাসান নিচু গলায় বলে, ‘আমিও ভাবিনি।’

—যাকগে আমি ওকে কিছু বলতে যাব না। তুমিই বলে দিও। আফরোজের প্রতিটি প্রত্যাখ্যান হাসানকে যেমন ভিতু করে তোলে, আবার কিছুটা আগ্রহ সৃষ্টি হয় বুকের ভেতর। সেদিন একপশলা বৃষ্টির পর আকাশে সূর্য হেসেছিল। পুরোনো আমলের বড় বাড়ির সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় ওঠে হাসান। মানুষের কোনো সাড়া শব্দ নেই। বাড়িটা এখন তার চেনাজানা। কয়েকবার ডাকার পর, আফরোজ চোখ ডলতে ডলতে রুম থেকে বেরিয়ে আসে।

—কী ব্যাপার, ঘুমিয়েছিলে?

—হ্যাঁ। বাড়িতে তো কেউ নেই।

—ও, আচ্ছা। জানতাম না। ঠিক আছে ঘুমাও।

আফরোজ হাসানের দিকে তাকায়। বাইরের দিকে পা বাড়াতেই পেছন থেকে কথা বলে, কোথায় যাচ্ছেন?

—চলে যাই।

—কেন! পড়াবেন না?

—না। বাড়িতে কেউ নেই।

—তাতে কী!

হাসান অবাক হয়। কেউ নেই। আমি এসেছি। আশপাশের মানুষ দেখলে কী মনে করবে?

—যা খুশি তাই মনে করুক। আপনি ভেতরে গিয়ে বসুন, আমি হাত-মুখ ধুয়ে আসছি।

আফরোজের কথা ফেলতে পারে না, ফেলা যায় না। হাসান ভেতরে গিয়ে বসে। মনের ভেতর একটা কথা ঘুরপাক খায়, আফরোজ কী তাকে ভালোবাসে! অল্প সময়ের ভেতর মেয়েটা হাজির হয়। সামনা-সামনি বসে। দুজনের চোখে মুখে জড়তা। বাইরে রিমঝিম বৃষ্টি।

—একটা কথা বলব?

আফরোজ ঘাড় নাড়ে। ‘বলুন।’

—না থাক।

—প্লিজ বলুন।

হাসানের মনে হয়, তার না বলা কথা যেন জানে আফরোজ। অনেক দিন আগে থেকেই জানে। সবকিছুর পর চোখের সামনে রাশিদা বেগমের চেহারা ভেসে ওঠে। মেয়েটা সব কথা তার মাকে বলে দেয়।

—একটা শর্তে বলতে পারি।

—বলুন, শর্ত মেনে নিলাম।

—না শুনেই?

—হ্যাঁ।

—কথাটা কাউকে বলা যাবে না।

—কেন বলতে যাব? আমার ক্ষতি নিশ্চয়ই আমি করতে যাব না।

সেদিন হাসান বলতে পারেনি। বইয়ের ভেতর লিখে দিয়েছিল, আমি তোমাকে ভালোবাসি। না, আফরোজ বলেনি কাউকে। ভালোবাসার দিনগুলো দ্রুত পেরিয়ে যায়। দিনরাত। হাসানের পড়াশোনা লাটে ওঠে। সারাক্ষণ মাথার ভেতর আফরোজ কিলবিল করে। ঘটনা চাপা থাকে না। রাশিদা বেগমের আপত্তি না থাকলেও তাঁর স্বামী ইঞ্জিনিয়ার রাহাত সাহেব মেয়ের উচ্ছৃঙ্খলতা মেনে নিতে পারেন না। হাসানের জন্য আফরোজদের বাড়ির প্রবেশদ্বার বন্ধ হয়ে যায়। তারপরও স্কুল ফাঁকি দিয়ে পার্কে যাওয়া। বিকেলে পুকুর ঘাটের এপাশে হাসান ওপাশে আফরোজ। ঘটনা দিনকে দিন জটিল হয়। রাহাত সাহেব চেষ্টা, প্রচেষ্টায় ব্যর্থ হয়ে পরিবার নিয়ে চলে যান। শুনেছিল, বদলি হয়ে পাহাড়ের দেশে চলে গেছেন। আফরোজের মোবাইল বন্ধ দিনের পর দিন। বুকে ব্যথার পাহাড় নিয়ে ঘোরাঘুরি। কোথায় আফরোজ? এভাবেই সময় গড়াতে থাকে। দীর্ঘ পাঁচ বছর একটু একটু করে দূরে ঠেলে দেয় আফরোজকে। স্মৃতিগুলো যখন কিছুটা ফ্যাকাশে হয়ে আসে, ঠিক তখন তার সঙ্গে দেখা। যখন দেখা হলো, তখন দুজনের ব্যবধান আকাশ- পাতাল। দুদিকের যাত্রী দুজন। তাতে কী, পেছনের অতীত সহাস্যে জানান দেয়, আমি আছি। কষ্টের হাত-পা, মাথা, নাক-কান, গলা চোরাবালি থেকে এক লাফে ওঠে। জুলাই মাসের তিন তারিখ সাগর পাড়ের আকাশে চোখ হাসানের। আজ আফরোজ চলে যাবে। আকাশটা দূর বহুদূরের পানিতে গিয়ে মিশেছে! ওপারে কী! মানুষের দৃষ্টিসীমা ৬৬ কিলোমিটার। সাগর তার চেয়ে বহু প্রশস্ত! তবু দেখতে ইচ্ছা করে। ইচ্ছাগুলো সাধ্যের সঙ্গে না মিললে পূর্ণ হয় কই! সময় ও জীবনের সঙ্গে সব তো পালটে যায়। হাসানের বুক ভরা কষ্ট, চোখ মোছে বারবার। ইচ্ছা করে চিৎকার করে কাঁদতে। আফরোজ শুনতে পাবে কি! সে কোথায়! আকাশে না এই বিশাল জলরাশি পেরিয়ে আরও অনেক দূরে! ক্ষণিকের জন্য ছোটবেলা, ছোট মানুষের কথা মনে হয়।

হাসান সাহেব। আলতো হাতের পরশ, মায়াবী কণ্ঠের ডাক রিয়া চক্রবর্তীর। এখানে বদলি হয়ে আসার পর তিন মাসের ব্যবধানে যাদের সঙ্গে পরিচয়, সম্পর্ক গড়ে উঠেছে তাঁদের মধ্য রিয়া অন্যতম। ২৪-২৫ বছরের সুন্দরী মেয়ে। অফিসে কাজের ফাঁকে ফুসরত পেলেই হাসানের ডেস্কের সামনে হাজির হন। কেউ কেউ দু-এক কথা বলা শুরু করেছে। অবশ্য হাসানের এগুলো নিয়ে মাথাব্যথা নেই। হাসান হাসে, ‘জি, কেমন আছেন?’

—ভালো। হাওয়া খাচ্ছেন নাকি?

—মানুষ হাওয়া খায় না ম্যাডাম। টায়ার-টিউবের সঙ্গে হাওয়া খাওয়ার যত সম্পর্ক।

রিয়া চক্রবর্তী হেসে ওঠেন। দারুণ হাসে মেয়েটা। ‘একা একা পার্কে বসে আছেন যে?’

—একা একাই ভালো লাগে।

—সামনে দেখেন জোড়া জোড়া। কী সুন্দর খাওয়া-দাওয়া চলছে।

—হ্যাঁ। ঘাড় নাড়ে হাসান।

চোখের পাতায় ভেসে ওঠে কিছু স্মৃতি। ঢাকা থেকে চট্টগ্রামের রাতের গাড়ি। হাসানের পাশের সিট ফাঁকা। গাড়ি ছেড়ে দেবে ঠিক সে সময় অতি ব্যস্ত এক মেয়ে তার পাশের সিটে এসে বসে। হাসান তাকায়। তাকিয়ে থাকে। আফরোজ! ঠিক কত বছর পর তার সঙ্গে দেখা মনে করতে পারে না। হাসান ঘুরে ঘুরে বহু বছর যে আফরোজকে খুঁজেছে। সে মেয়েটা তার সামনে। মুখ দিয়ে ব্যথাতুর একটা শব্দ বেরোয়, আফরোজ। মেয়েটা তাকায়।

—ওহ হাসান। কেমন আছ?

—এইতো। কোথায় ছিলে এত দিন!

—আমার তো বিয়ে হয়ে গেছে। এখন কানাডার নাগরিক। দেশে এসেছিলাম। পরশু ফ্লাইট। চলে যাব।

হাসান একেবারে নিশ্চুপ হয়ে যায়। পাথরের মতো।

—এই যে কী হলো। রিয়া হাত ধরে নাড়া দেয়।

—কই, কিছু হয়নি। পেছনে ফেলা অতীত থেকে বেরিয়ে আসে হাসান। কিছুটা অবাক হয়ে বলে, হাত ধরলেন!

—হ্যাঁ ধরেছি। এক শ বার ধরব।

—আপনি ভুল পথে...

—থামবেন।

কিছুক্ষণ নীরবতা। রিয়া চক্রবর্তী অনেকক্ষণ হাসানের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে।

—হাসান।

—বলুন।

—অনেক দিন একটা কথা বলব বলব করেও বলা হয়নি। রিয়ার কথায় মায়া, স্নিগ্ধতা।

—বলে ফেলুন।

—আমি আপনাকে ভালোবাসি হাসান।

হাসান চিৎকার করে ওঠে। ‘ভালোবাসা! ভালোবাসা! কিরে?’ তারপর অট্টহাসি। রিয়াকে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বলে, ‘প্লিজ চলে যান রিয়া।’

কেন যেন রিয়ার চোখ বেয়ে বেয়ে গড়িয়ে পড়ে অশ্রুবিন্দু। হাত দিয়ে চোখ মোছে।

—হাসান।

—প্লিজ চলে যান রিয়া।

রিয়া দাঁড়ায় না। হনহন করে হেঁটে যায়। অদৃশ্য হয়। মেয়েটা চলে যেতেই হাসানের বুকের ভেতর কেমন ব্যথা জেগে ওঠে। সত্যিই চলে গেল মেয়টা! কোথায় গেল? রাত বাড়ে। রাতের পার্কে পোশাকহীন একটা ছোট বাচ্চা ঘুরঘুর করছে। তিন-চার বছর বয়স হতে পারে। মানুষ খেয়ে যে উচ্ছিষ্ট ফেলছে সেসব খুঁটে খাচ্ছে বাচ্চা ছেলেটা। কাছাকাছি আসতেই হাসান ডাকে—বাবা মা নেই?

তোতা পাখির মতো কাটাকাটা শব্দে বলে, মা আতে।

—দুপুরে খাওনি?

—চখালে খাইতি মা আতলে রাতে কাব। কুব কিদে লাগিদেছো তাই..... ।

সকালে খেয়েছে মা আসলে রাতে খাবে। এটা একটা প্রত্যাশা। দীর্ঘ প্রতীক্ষায় ক্লান্ত ক্ষুধাতুর শিশুর খাবার খুঁজে বেড়ানো, কষ্ট মেটানোর প্রচেষ্টা। ছোটবড় সবার হয়তো প্রত্যাশা থাকে। মানুষ ভেদে প্রত্যাশা ভিন্নতর। হাসানের ভাবনায় দোলা দেয়, প্রত্যাশার কি শেষ আছে! নাকি আকাশের মতো। প্রত্যাশার ওপারে কী? ভেতর থেকেই যেন উত্তরটা পেয়ে যায়। মৃত্যু...