প্রতিষ্ঠা করতে হবে আইনের শাসন
জরিপে এসেছে, রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে বেশির ভাগ তরুণ সন্তুষ্ট। তবে এর সঙ্গে আমি একমত হতে পারলাম না। কারণ, মানুষ এখন মুখ খুলতে ভয় পায়। বাক্স্বাধীনতা নেই। কিছু বললে গুম বা হেনস্তার শিকার হতে হয়। ফলে মানুষ চুপ করে থাকে। এই চুপ করে থাকাটা স্থিতিশীলতা নয়। তরুণদের বেশির ভাগও নিজের ব্যক্তিগত নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগের কথা জানিয়েছেন সম্ভবত এসব কারণেই। প্রতিনিয়ত পত্রিকা খুললে গুম, খুন, ধর্ষণের খবর দেখা যায়।
এটা ঠিক, মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বেড়েছে। এতে অর্থনৈতিক উন্নতিতে সন্তুষ্টি থাকতে পারে। কিন্তু অর্থনৈতিক উন্নয়ন কোথায় হয়েছে, সেটাও দেখতে হবে। ফ্লাইওভার হলেই তা অর্থনৈতিক উন্নয়ন নয়। প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মৌলিক চাহিদা কি পূরণ হচ্ছে? আমরা কি দারিদ্র্যসীমার ওপরে যেতে পেরেছি? জীবনযাত্রার উন্নতি ঘটেছে? ঘরে ঘরে কি বিদ্যুৎ পৌঁছে গেছে? সব জায়গায় কি রাস্তাঘাট হয়ে গেছে? সব ছেলেমেয়ে কি স্কুলে যাচ্ছে?
আমার মনে হয়, কিছু ক্ষেত্রে তরুণেরা ‘গা ছাড়া’ জবাব দিয়েছেন বা প্রশ্নটা ভালো করে বুঝতে পারেননি। এমনও হতে পারে, তাঁরা ঝামেলা এড়াতে চেয়েছেন। আমি মনে করি না বাংলাদেশে একেবারে সর্বস্তরের মানুষ খুব সুখে–শান্তিতে, নিরাপত্তার মধ্যে আছেন, স্বাধীনভাবে তাঁদের মত প্রকাশ করতে পারছেন। ডাকসু কার্যালয়ে হামলার ঘটনাও বাহুবল চর্চার একটি উদাহরণ। প্রশাসনও এখানে মদদ দিচ্ছে।
সামগ্রিকভাবে রাজনীতিতে একধরনের দুর্বৃত্তায়ন ঢুকে গেছে। আইনের শাসন নেই। বল প্রয়োগ করে সবকিছু করা হচ্ছে। জনকল্যাণের কথা মুখে বলা হলেও রাজনীতিতে তেমন কিছু আসলে নেই। লোভে পড়ে বেশির ভাগ রাজনীতিতে জড়াচ্ছে। অনেকে মনে করছেন, রাজনীতি একটা ব্যবসা, ওপরে ওঠার সিঁড়ি। শর্টকাট রাস্তায় অনৈতিকভাবে বড় লোক হওয়ার একটা পথ রাজনীতি। মনে হয়, এসব কারণে তরুণদের মধ্যে রাজনীতি নিয়ে আগ্রহ কম।
তরুণেরা প্রচলিত রাজনীতিতে ভরসা পাচ্ছেন না। তাঁরা হয়তো মনে করেন যে সমাজে যত অনাচার–অসংগতি আছে, সেগুলো তাঁরা যদি প্রচার করেন বা আন্দোলনের মাধ্যমে দূর করতে পারেন, তাহলে সমাজে একটা স্থিতিশীল অবস্থা বিরাজ করবে। সে কারণে তাঁরা সামাজিক আন্দোলনের দিকে ঝুঁকছেন।
সমস্যা হলো, দেশে সব ধরনের আইন আছে। কিন্তু আইনের প্রয়োগ নেই। প্রয়োগ নেই বলে যারা দুর্নীতি করে, অন্যায় করে, দস্যুবৃত্তি করে, তারা পার পেয়ে যায়। মনে করে যে কিছুই হবে না। এমন বাস্তবতায় রাজনীতিতে শুদ্ধতা আনতে হবে। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে হবে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত করতে হবে। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হলে অনেক সমস্যার সমাধান হবে। এ ছাড়া শিক্ষার প্রসার ঘটাতে হবে। স্কুল–কলেজ–বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু করে সব জায়গায় মূল্যবোধের চর্চা বাড়াতে হবে।
লেখক: অধ্যাপক, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়