প্রতিদিন হোক বাবা দিবস

শৈশবের ভোরে প্রতিদিন আমার প্রয়াত বাবা এ সাত্তার মিয়া বিছানা থেকে তুলে ঘরের মেঝেয় দাঁড় করিয়ে দিয়ে বলতেন, মসজিদে যা। পৌষ-মাঘের শীতে চাদর জড়িয়ে মসজিদের বারান্দায় বসে সমস্বরে সবার সঙ্গে আরবি পড়তে হতো। সেই শব্দের ঢেউ মসজিদের দেয়ালের বাইরে রাস্তা ও আশপাশের বাড়ির উঠানে গিয়ে আছড়ে পড়ত। ২৫ মার্চ ও ১৬ ডিসেম্বরে তিনি লাল-সবুজ পতাকার জন্য ডাকতেন।

শীতকাতর রমজান মাসের ভোররাতে সাহ্‌রি খাবার জন্য ডেকে তুলতেন। রমজান মাসের শেষ দিন সন্ধ্যায় ডেকে বলতেন, আয় চাঁদ দেখি। দোনলা বন্দুক থেকে দুটি ও পিস্তল থেকে একটা গুলি ছুড়তেন আকাশে। মোটরবাইকে তাঁর পেছনে বসে ছুটতাম মাছ শিকারে। শেখাতেন মাছ ধরার কৌশল। সন্ধ্যার পর মোটরবাইকে চড়ে তাঁর পেছনে বসে ডাক্তারের চেম্বার থেকে ফেরার পথে একটু পরপর বলতেন, অই, তুই ঘুমাস নাই তো। দুহাতে আমাকে শক্ত করে ধর।

মানুষকে আপন করে নেওয়ার ক্ষমতা ছিল তাঁর। বাড়িওয়ালা মারা যাওয়ার মুহূর্তে তাঁর স্ত্রী ভোররাতে জানালা দিয়ে রেখে যায় স্বর্ণালংকারের পুঁটলি। মসজিদের ইমাম সাহেব প্রতি মাসে এসে টাকা জমা রাখতেন তাঁর কাছে। মা মেথির খিচুড়ি ও শীতের পিঠা বানালে তিনি তাঁর বন্ধুদের ফোনে ডেকে আনতেন। শৈশব-কৈশোর থেকেই তিনি পবিত্র কোরআন পড়তে পারতেন, তারপরও আমার জীবনে তিনবার দেখেছি, ১০ বছর পরপর মসজিদের হুজুরকে বাসায় এনে পবিত্র কোরআন শুদ্ধ করে পড়ার প্রতি তাঁর এক আকুতি।

ছুটির দিনে সারা দিনের জন্য নিয়ে গিয়েছেন টঙ্গী চেরাগ আলী মার্কেটে চাচার বাসায়, ভাওয়াল রাজার বাড়ি, জাদুঘর, নিউমার্কেট অথবা কৃষি মেলায়। ঢাকা নারায়ণগঞ্জ বাসভাড়া ছিল ৬৫ পয়সা, কাউন্টার থেকে টিকিট কিনলে ৬২ পয়সা। আমাকে টাকা দিয়ে বলতেন, যা, টিকিট কিনে আন। চারটা টিকিট কত টাকা, কত টাকা দিয়ে টিকিট কিনলি, কত টাকা ফেরত পেলি। মুখে মুখে হিসাব কর। নতুন বাংলা ছবি মুক্তি পেলে সিনেমা হলে ফোন করে বলে রেখেছেন। অফিস থেকে ফোন করে বলতেন, হলে ম্যানেজারের কাছে গিয়ে চাইলেই টিকিট পেয়ে যাবি। তখন দেখেছি, ‘গাজী কালু চম্পাবতী’ ও ‘কুঁচবরণ কন্যা’।

মুক্তিযুদ্ধকালে গ্রামে যোদ্ধারা বাড়ি এসে বললেন, ‘অস্ত্র চাই।’ গ্রাম থেকে ফিরে এলাম শহরে। দোতলায় তাঁর অফিস, আমরা থাকি তিনতলায়। আমাদের সঙ্গে চাচাও থাকেন সপরিবারে।

স্বাধীনতার পর তাঁর বইয়ের ট্রাংক থেকে একটা একটা করে বই দেওয়া শুরু করলেন। আদম (আ.), সোলায়মান (আ.), লুত (আ.), ঈসা (আ.), ইউসুফ (আ.) ও নবীজি (সা.)–এর জীবনী বলতেন। রামায়ণ, মহাভারত থেকেও গল্প শোনাতেন। কখন, কেন দেবী দুর্গা তুলসীগাছকে অভিশাপ ও দূর্বা ঘাসকে দিয়েছিলেন বর। পুরাণ থেকে এ গল্পটাও বলেছেন।

আমাকে একটি চিঠি দিয়ে বললেন, ব্যাংকের জিএমকে দিয়ে আসবি। পরিচয় দিয়ে জিএমের চেম্বারে প্রবেশ করে তাঁকে চিঠিটি হস্তান্তর করতেই তিনি তাঁর চেয়ার থেকে দাঁড়িয়ে গেলেন। আমি চিঠির বাহকমাত্র। পত্রপ্রেরককে সম্মান জানানোর জন্য জিএমের বিনয় দেখে আমি বিস্মিত। তাঁকে অপছন্দ করে—এমন লোকের সঙ্গেও তিনি কথা বলেছেন হাসিমুখে। তাঁকে চা ও পান কিনে দিয়ে আপ্যায়িত করেছেন।

বাংলার লোক–ঐতিহ্যের প্রতি ছিল তাঁর প্রগাঢ় টান। ভাইবোনদের সন্তান জন্মগ্রহণ করলে তিনি সবাইকে একটি করে কাঠের ঢেঁকি নিজে তৈরি করে উপহার দিতেন। তাঁর নিজের তৈরি কাঠের একটি ছোট্ট আলমারি ছিল বাসায়, সেটি তিনি হয়তো আমার জন্মে আগেই তৈরি করেছিলেন। পৌরসভার পানির ট্যাপে পানি আসছে না, মাটি খুঁড়ে কাদামাটিতে মাখামাখি হলেন। বৈদ্যুতিক সমস্যা, মেইন সুইচ বন্ধ করে কাজ শুরু করলেন। কাপড় কিনে এনে সেলাই মেশিন নিয়ে বসে মশারি বানালেন। লুঙ্গি কিনে সেলাই শুরু করলেন। কাঠের কাজের করাত, হাতুড়ি-বাটাল, প্লাম্বিং কাজের যন্ত্রপাতি ও বৈদ্যুতিক কাজের সামগ্রীর যন্ত্রপাতি রাখার জন্য তাঁর ছিল একটি বড় বাক্স। মোটরবাইকটি পরিষ্কার করছেন নিজেই, আমাকে ডেকে বলতেন, আয় কাদা পরিষ্কার কর। বন্দুক, পিস্তল নিয়ে বসে গেলেন। আয়, দেখ, কীভাবে পরিষ্কার করি। বাজার থেকে বাঁশের চালুনি ও ঝাড়ু ক্রয় করার পর তার দিয়ে বাঁধেন, তাহলে এসবের আয়ু দীর্ঘ হবে।

মা স্ট্রোকে প্যারালাইজড হলে দিনমান তাঁর সেবায় ব্যস্ত ছিলেন। কয়েকবার মায়ের স্ট্রোক হলে মা কোমায় ছিলেন, তখন তাঁর বেড-সোর হলে মাকে তিনি রাইসটিউবে খাবার, ওষুধ, ব্লাড প্রেশার দেখা, ইউরিনে ব্লাড সুগার পরীক্ষা করা, বিছানা পরিষ্কার করা, কাপড় পাল্টে দেওয়া, বেড-সোরের ক্ষতে অয়েন্টমেন্ট দেওয়া—এসবই নিজে করেছেন দ্বিধাহীন চিত্তে ক্লান্তিহীন ও নিরলসভাবে।

বৃক্ষপ্রেমিক পিতাকে শৈশব থেকে দেখেছি, প্রতিদিনই তিনি গাছ রোপণ করছেন, ‘সৃষ্টি সুখের উল্লাসে’। ফলদ বৃক্ষ যা আছে, যত ফলের নাম বলা যাবে, তার সব তিনি লাগিয়েছেন। একমাত্র তালগাছ ব্যতীত। আনারাস ক্রয়ের পর কাঁটাযুক্ত আনারসের ওপরের অংশ মাটিতে রেখে প্রাণ সঞ্চারের কী এক প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা তাঁর। প্রথম দিকে অসফল হলে পরামর্শ সংগ্রহে সচেষ্ট হলেন, কেন আনারসগাছ হলো না? এরপর ফল প্রাপ্তি! গাবগাছের বিচি অঙ্কুরোদ্‌গম নিয়েও ছিল দীর্ঘদিনের প্রচেষ্টা তাঁর। গাবের বিচি অঙ্কুরোদ্‌গমের সময় বিচি যথাস্থানে থাকে না। ডাব, গাব ও আনারস রোপণে তিনি কৌশল অবলম্বন করেছিলেন। তেজপাতা ও বড় এলাচিও ছিল তাঁর তালিকায়।
টব, মাটি তো আছেই, মিষ্টির পাতিল, দইয়ের পাতিল, ফিউজ বাল্ব, ফিউজ টিউব লাইট, ফিনাইলের খালি কৌটা—এগুলো কেউ তাঁর চশমার মোটা গ্লাসের ফাঁক দিয়ে দৃষ্টি ফাঁকি দিয়ে খালে, পুকুরে, ড্রেনে বা ফেরিওয়ালার চাঙ্গারিতে কোনোক্রমেই যেতে পারত না।

রুমন রেজা ও দর্পণ কবীর ফ্রেঞ্চ মার্কেটের দোতলায় নাফিজ আশরাফ ভাইয়ের টেইলারিং দোকানে নিয়ে গেলেন একদিন। নাফিজ ভাইয়ের দোকানটি ছিল প্রগতি সাহিত্য পরিষদের লেখকদের মিলনকেন্দ্র। নাফিজ ভাইয়ের সঙ্গে পরিচয়ের পর জানলাম, আব্বার তাঁর পূর্বপরিচিত। আব্বা তাঁর কাছ থেকে প্যান্ট তৈরি করাতেন। তিনি সব সময় প্যান্টের ডান দিকে পিস্তল লুকিয়ে রাখার জন্য একটি পকেট তৈরি করিয়ে নিতেন। আশির দশকে বস টেইলার্স থেকে প্যান্ট তৈরি করার সময় আমিও প্যান্টে ওই রকম একটি পকেট রাখতাম। তখন ৫০০ টাকার নোটের দুইটা বান্ডিল রাখতাম। এবার দেখেছি এক হাজার টাকার নোটের একটি বান্ডিল অনায়াসে রাখা যায়।
পিতৃভক্তি ছিল তাঁর আকাশসম। সূর্যাস্তের পর গ্রামে পিতার মৃতদেহের ওপর বাবা উপুড় হয়ে আছড়ে পড়লেন। সন্তানের ব্যাকুল ডাক শোনার জন্যই হয়তো পিতা সাঁঝের আকাশে অপেক্ষায় ছিলেন। জানাজার পর অনেকের হাতেই ছিল হ্যাজাক লাইট। অন্ধকার বিদীর্ণ করে আলোর বাহকেরা এগিয়ে যায় পূর্বপুরুষকে অন্ধকার মাটির প্রকোষ্ঠে শায়িত করার জন্য। পিতাকে অনুসরণ করে প্রাণবন্ত এ বিশাল হৃদয়ের মানুষটিও একদিন পৃথিবী ও আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন নীরবে। তাঁর মতো অত বড় হৃদয়ের অধিকারী আমি তো নই।

আমার পিতা
দিনের আলো বিদায়ের মুহূর্তে আব্বাকে বললাম—
আমি বিদেশ চলে যাচ্ছি,
আব্বা আমাকে বুকে টেনে নিয়ে বললেন
আমি মরে গেলে তুই তো
আমাকে মাটি দিতে পারবি না,
তাঁর তপ্ত এক ফোঁটা অশ্রু
আমার বাঁ হাতের ওপর উপুড় হয়ে পড়ল
পিতা কখন কেন সন্তানকে নিজের বুকে টেনে নেন
সে বোধ কি আমার হয়েছে আজও
তাঁর প্রথম নাতিকে তিনি তাঁর পাশে নিয়ে ঘুমাতেন
শিশুটি মাঝ রাতে হিসি করে ভিজিয়ে দিলে
তিনি উঠে গোসল করে তাহাজ্জুদ পড়তেন
ভোররাতে পানি গরম করে দুধ বানিয়ে দিতেন,
আমাকে বলেছিলেন—
আমার বাবার জ্বর অইলে আমি সারা রাত
হের মাথার সামনে খাড়াইয়া রইছি
আব্বার জ্বর হলে আমি তো কখনো
তাঁর সামনে বসে থাকিনি
ফোন করে বললাম, আব্বা আপনার নাতি হইছে
আটলান্টিকের ওই পাড় থেকে বললেন—
আমি নাতি দেখুম না?
ভোরে ঘুমে থেকে টের পেলাম
আমার শরীর থেকে কে যেন আমার কাঁথাটা
অতি সন্তর্পণে টেনে নিয়ে যাচ্ছে,
ফোন করতেই বলল
আব্বারে কবরে দিছি, মোনাজাত ধর
কবরে মাটি দিতাছে
কী এক আকাশসমান অপারগতা নিয়ে
নিজের ব্যর্থতা আমি মাটিচাপা দিই।