
এক বেদানার্ত কৃষ্ণকলি
বসন্ত এখন তার পূর্ণ রূপ মাধুরী নিয়ে টরন্টো শহরের প্রকৃতিতে উপস্থিত। সকালগুলো কী উজ্জ্বল আলোতে মাখানো থাকে। কিন্তু বসন্ত বাতাসের সকালের সোনা রোদ গায়ে লাগাতে না লাগাতে আমাদের সনোগ্রাফারদের ছুটতে হয় আলো-আঁধার রুমের অন্য এক জগতে। রোগীদের সঙ্গে কাটানো দিনগুলো যেন মেঘ রোদ্দুর খেলা আমাদের জীবনে। অভিবাসী অধ্যুষিত টরন্টো শহরে কাজ করতে এসে কত শত লোকের সঙ্গে রোজ পরিচয় হয়। নানা রং, নানা ভাষা, নানা ধর্ম আর নানা জাতির ভিন্ন ভিন্ন মানুষ কানাডায় এসে যেন এক স্রোতে মিশেছে। স্ক্যান পরীক্ষার নানা ধাপের সঙ্গে সঙ্গে চিরকালের আলাপ প্রিয় আমার কাছে যেন নতুন পরিচয়ের নতুন এক পৃথিবীর দরজা খুলে যায় প্রতিদিন। কিন্তু করোনা মহামারি জীবনে সে আলাপচারিতা অনেকটাই সংকুচিত হয়ে পড়েছে। আশঙ্কা আর অনিশ্চয়তার এক অন্য জীবনে সবার সঙ্গেই একটা দূরত্বের ঘোর টোপ। পিপিইর ধরাচূড়া পরা অবস্থায় রোগীর সঙ্গে দৃষ্টি বিনিময় আর আলাপের সুযোগ সীমিত প্রায়। তবু সমমর্মিতা আর সহানুভূতি নিয়ে তাদের ব্যথার জায়গাগুলোকে আমাদের সময় দিতে হয়।
সেদিন সকালেও কাজে গেছি ভীষণ বিক্ষিপ্ত মন নিয়ে। দু/তিনজন রোগী পরীক্ষার পরেই এলেন ডরোথি গিলবার্ট নামের (ছদ্ম নাম) ৮০ বছর বয়সের এক বিষাদ ক্লান্ত মায়াবী মুখের কৃষ্ণাঙ্গ মহিলা। তিনি একজন অবসরপ্রাপ্ত নার্স। পরীক্ষার জন্য তাঁকে টেবিলে রেডি করতে করতে দেখি, কৃষ্ণকলি মেয়ের দুই হরিণ চোখের পানিতে মাস্ক ভেসে যাচ্ছে। খুব বেশি ব্যথা হচ্ছে কিনা জানতে চাইলাম। তিনি বললেন, আজকে আমার মনের ব্যথাই বেশি, আমি এই শোক সামলাতে পারছি না, আমার রাতভর কোন ঘুম হয়নি। তুমি তো বুঝবে আমার কষ্ট। জর্জ ফ্লয়েড হয়তো আমার নাতি হতে পারত অথবা আমার ছেলে। যথেষ্ট এবং যথেষ্ট হয়েছে। আমিও পথে নামতে চাই, বলতে চাই সাদাদের এই নিষ্ঠুরতার অবসান কবে হবে। আর কতবার এ রকম নিষ্ঠুরতা আমাকে দেখতে হবে!!
ডরোথির এই আর্তনাদে আমিও বিষাদে মুহ্যমান হয়ে পড়লাম। এমনিতেই মনটা ভীষণ রকমভাবে খারাপ হয়ে আছে। আমার নিজের জন্মভূমির দেশে চেনা–অচেনা অমূল্য মানুষের কোভিড-১৯–এ আক্রান্ত হয়ে জীবনাবসানের খবরে শোকে কাতর হয়ে আছি। টরন্টোতেও কোভিড–১৯ রোগীর সংখ্যা কমছে বলা যায় না। চারদিকে যেন অক্সিজেনের খুব অভাব। ভেবেছিলাম, তৃতীয় এই বিশ্বযুদ্ধের কারণে মানুষ বুঝি পারস্পরিক মানবিকতা ও মানসিক নৈকট্যের এক নতুন ইতিহাস তৈরি করতে চলেছে। কিন্তু জর্জ ফ্লয়েডের নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ড প্রমাণ করল, সাদাদের অস্থি-মজ্জায় চিরন্তন বয়ে চলা কালোদের শোষণ, নিপীড়ন করার সেই অহমিকা, দম্ভ, হিংসা আর ইচ্ছে হলেই তাদের হাঁটু দিয়ে পিষে ফেলার নিষ্ঠুরতা এখনো বিপুল বিক্রমে প্রবহমান। সে আমেরিকাসহ পৃথিবীর সব দেশ যত বড় মহামারি বিপর্যয়ের মধ্যে থাকুক না কেন। বর্ণ বিদ্বেষ রয়েছে প্রবলভাবে।
রাতভর আমেরিকার বিভিন্ন শহরের মানুষের বিক্ষোভ প্রতিবাদ মিছিলের সঙ্গে নিজেকেও যেন সেই মিছিলে পাচ্ছিলাম। কানে বাজছিল জর্জ ফ্লয়েডের সেই মৃত্যু আর্তনাদ। ঘাড়ের ওপর সাদা পুলিশের হাঁটুর চাপে ফ্লয়েডের যখন দম শেষ হয়ে যাচ্ছিল তখন সে বারবার ক্ষমা চেয়েছে, তার অসুস্থ মায়ের কথা বলেছে, ‘আমি নিশ্বাস নিতে পারছি না’ বলে চিৎকার করতে চেয়েছে। কিন্তু, সাদা পুলিশটি তার হাঁটু সরায়নি এই হতভাগ্য কৃষ্ণাঙ্গ ছেলেটির দম পুরো বন্ধ না হওয়া পর্যন্ত—ভয়ংকর সেই ৮ মিনিট ৪৬ সেকেন্ড!
ডরোথি আমাকে জানালেন, তার পূর্ব পুরুষ এসেছে আফ্রিকা থেকে। প্রতিটি কালো মানুষের দুঃখ যন্ত্রণা আর বৈষম্যের ইতিহাস তার জীবনেরই অঙ্গ। ডরোথির কান্নাভেজা কিন্তু বলিষ্ঠ প্রতিবাদী স্বর আমাকে আড়াই শ বছর আগের কুনতা কিনতের সেই দাস জীবনের প্রতিবাদের কথা মনে করিয়ে দিল। ডরোথি যেন কুন্তা কিনতের এক উত্তরসূরি। মনে হচ্ছে পৃথিবী একটুও এগোয়নি। আড়াই শ বছর আগে জাহাজের খোলের মধ্যে পুরে পশুর চেয়েও নির্মমতায় কালো মানুষদের আমেরিকার সাদারা নিয়ে এসেছিল শুধু তাদের দাস করার জন্য। তাদের নিজের কোন সত্তা থাকবে না, তারা হবে মূক ও বধির এবং নতজানু এক অদ্ভুত প্রাণী, যারা শুধু শোষিত হবে। কালো এই মানুষেরা এসেছিল শূন্য হাতে। কিন্তু তাদের মেধা, বুদ্ধিমত্তা, ধর্মানুরাগ ও সৃজনশীলতা ছিল তাদের মন ও মননে। তাই স্বাধীনতা ও অধিকার আদায়ের জন্য তারা বারবার প্রতিবাদে মুখর হয়েছে আর নির্যাতনের চাবুকে ক্ষতবিক্ষত হয়েছে।
আমার একটা স্বপ্ন আছে
ষাটের দশকে মার্টিন লুথার কিং কৃষ্ণাঙ্গ মানুষের পক্ষের নাগরিক অধিকার আন্দোলনের একজন বলিষ্ঠ নেতা। তিনি কালো মানুষদের নিয়ে সব ধরনের বৈষম্য আর শোষণের বিরুদ্ধে আন্দোলনে নামেন। তার ১৩ মাসের মন্টেগোমারি বাস বয়কট এবং ভোটাধিকার আদায় আন্দোলনের লং মার্চ যদিও ছিল অহিংস কিন্তু হাজার হাজার কালো মানুষ সাদা পুলিশের হাতে নিষ্ঠুর নির্যাতনের শিকার হন। তাদের ঘরবাড়ি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান পুড়িয়ে দেওয়া হয়, হত্যা, লুণ্ঠন কিছুই বাদ ছিল না। তার পরেও সুপ্রিম কোর্ট সব পাবলিক স্থান থেকে বৈষম্যমূলক আচরণ নিষিদ্ধ করেন এবং সরকার ভোটের অধিকার দিতে বাধ্য হয়। সেটা একটা বিজয় ছিল।
মার্টিন লুথার কিং তাঁর বিখ্যাত বক্তৃতায় বলেছিলেন, ‘আমার একটি স্বপ্ন আছে—আমেরিকার মানুষ সাদা–কালোয় বিভক্ত থাকবে না, তারা সব নাগরিকের জন্য সমান অধিকার ও সমান সুযোগ নিশ্চিত করে বিশ্ব মানচিত্রে অন্যতম শক্তিশালী আমেরিকা হবে। রং আর বৈষম্য আমেরিকার মাটিতে থাকবে না। সেই স্বপ্নের ধারাবাহিকতায় আমেরিকা পেয়েছিল একজন কৃষ্ণাঙ্গ প্রেসিডেন্ট। কিন্তু বর্ণ বৈষম্যর আগ্রাসন আজও বিরাজমান এবং একুশ শতকের বাস্তবতা হল, কালো প্রাণোচ্ছল এক যুবকের শ্বেতাঙ্গ পুলিশের হাতে নিষ্ঠুরভাবে খুন।
মিসিসিপি থেকে মিনিয়াপোলিস
সাদা পুলিশের কৃষ্ণাঙ্গদের প্রতি এই নিষ্ঠুরতা আর তাদেরকে দাস হিসেবে দাবিয়ে রাখার ইতিহাস ৪০০ বছর পুরোনো। দশকের পর দশক চলেছে এই নিপীড়ন। ১৯৬৪ সালের জুনে কালোদের ভোটার রেজিস্ট্রেশন অধিকার আন্দোলন দমনের জন্য মিসিসিপিতে সাদা শ্রেষ্ঠত্ববাদের সংগঠন কে কে কে সদস্যরা একের পর এক কালোদের চার্চ ও বাড়িঘর জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দিয়েছিল, তাদের মেরে ফেলা হচ্ছিল, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান তছনছ করা হচ্ছিল। ১৯৬৪ সালের ২১ জুন কে কে কে’র ষড়যন্ত্রে ও সাদা পুলিশের সহায়তায় তিনজন নাগরিক অধিকার কর্মী, দুজন ইহুদি ও একজন কালো, রাতের আঁধারে মেরে লাশ গুম করে ফেলেছিল। অনেক দিন পর ২০১৬ সালে আবার তাদের সাদা শ্রেষ্ঠত্ববাদের আকাঙ্ক্ষার জানান দেয়। এই নিও নাজি ২০১৭ সালের ১২ আগস্ট ভার্জিনিয়ার সার্লোটসভিলে একটি শান্তিপূর্ণ সমাবেশের ওপর দিয়ে গাড়ি চালিয়ে ৩২ বছরের শ্বেতাঙ্গ তরুণী হিদার হেইয়ারকে হত্যা ও আটাশ জনকে আহত করে। তখন প্রশাসনের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে সাধারণ মানুষের প্রত্যাশামতো প্রতিক্রিয়া দেখানো যায়নি। এবার মিনিয়াপোলিসে ফ্লয়েডের এই হত্যার মাধ্যমে সাদা পুলিশদের নিষ্ঠুরতা বিশ্ব আরেকবার প্রত্যক্ষ করল সিস্টেমের মধ্যে লুকিয়ে থাকা বর্ণবাদ।
কালোদের জীবন মূল্যহীন নয়
আজকে বিশ্বব্যাপী আপাময় জনসাধারণ কালো এবং বিবেকবান সাদা মানুষ প্রতিবাদে ফুঁসে উঠছে। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে বর্ণবাদের যে কালো অধ্যায় চলে আসছে, তা এখনো আমেরিকাসহ পৃথিবীর অনেক দেশের মানুষই মানসিক ও আচরণগতভাবে বহন করে চলছে। তাই বিজ্ঞান ও সভ্যতার এই চরম উৎকর্ষের দিনেও কালো মানুষের আত্মপক্ষ সমর্থনের কোন সুযোগ দেওয়ার কথা ভাবে না ডেরিক চাওভিন নামের সাদা পুলিশরা। তাই আজ বিশ্বব্যাপী ঝড় উঠেছে, কালোদের জীবনকে আর মূল্যহীন ভাবা যাবে না। রাস্তায় নেমে এসেছে লাখ লাখ মানুষ। সবার কণ্ঠেই এক সুর, এই জীবনকে অপমানিত লাঞ্ছিত এবং ইচ্ছেমতো কেড়ে নেওয়ার অধিকার কারও নেই।
পরিবর্তন সময়ের দাবি
পৃথিবী থেকে বর্ণবাদের এই কালো থাবা সম্পূর্ণ বিলুপ্ত করা এখন সময়ের দাবি। মানুষকে মানুষ হিসেবেই দেখতে হবে। কালো সাদা বাদামি কোন রং তো তার পরিচয় নয়। আমেরিকা অলিম্পিকে অগণিত সোনা জিতে এসেছে তার কৃষ্ণাঙ্গ খেলোয়াড়দের মেধা আর পরিশ্রমে। আমেরিকার মিউজিক ইন্ডাস্ট্রি দাঁড়িয়ে আছে কৃষ্ণাঙ্গ শিল্পীদের হাতে। প্রতিটি মানুষ পৃথিবীতে আসে তার নিজস্ব সৃজনশীলতা নিয়ে। বিশ্বায়নের এই যুগে তাকে রং, জাতি, ধর্ম ও দেশের নামে আলাদা করার দিনের ইতি টানতে হবে। তাকে মানুষ হিসেবেই দিতে হবে পূর্ণ অধিকার। প্রত্যেকটি জীবন মূল্যবান—এই শান্তির বাণী ছাড়িয়ে পড়ুক পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে। কবির কথার সুর ধরে বলতে চাই, ‘কালো আর ধলো বাইরে কেবল, ভেতরে সবারই সমান রাঙা।’