প্রণোদনা যথাযথ ব্যবহার করতে হবে

মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন
মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন

করোনাভাইরাসের কারণে সৃষ্ট আর্থিক সমস্যা কাটাতে প্রধানমন্ত্রী যে আর্থিক প্রণোদনা দিয়েছেন, সেটা খুবই প্রয়োজন ছিল। যেসব শিল্প ও সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তাদের চলতি মূলধনের জন্য ৩০ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে। এতে সুদের হার হবে ৯ শতাংশ। সুদ সরকার অর্ধেক বহন করবে ও গ্রাহককে অর্ধেক দিতে হবে। আমার প্রস্তাব, এখানে দুই থেকে তিন মাসের একটি গ্রেস পিরিয়ড (ঋণ পরিশোধে বিরতি) দেওয়া হোক। যাতে ব্যবসায়ীরা ব্যবসাটি শুরু করার জন্য একটা সময় পান ও এরপর ঋণ পরিশোধ করেন। এতে পরবর্তী তিন মাসের মধ্যেই পুরো টাকা ফেরত আসবে এবং এটি পুনঃ অর্থায়ন করা গেলে বছরে ৬০ হাজার কোটি টাকায় গিয়ে পৌঁছাবে।

একইভাবে অতিক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র ও মাঝারি খাতের জন্য যে ২০ হাজার কোটি টাকা প্রণোদনা দেওয়া হয়েছে, সেখানেও ৯ শতাংশ সুদ নির্ধারণ করা হয়েছে। এতে সরকার দেবে ৫ শতাংশ ও বাকি ৪ শতাংশ গ্রাহককে দিতে হবে। এতেও ২ মাস গ্রেস পিরিয়ড দিতে হবে। ফলমূল, সবজি, অকৃষিসহ বিভিন্ন খাতকে এই প্যাকেজের মধ্যে আনতে হবে। এ জন্য এসএমই ফাউন্ডেশনকে সক্রিয় করতে হবে, যাতে সারা দেশের ছোট ছোট ব্যবসায়ীদের খুঁজে বের করে তাঁদের উন্নতির চেষ্টা তারা করতে পারে। 

রপ্তানি উন্নয়ন তহবিলের (ইডিএফ) আকার বাড়ানো হয়েছে, পাশাপাশি এর সুদ কমানো হয়েছে। এটা সবচেয়ে বেশি কার্যকরী হবে বলে আমার মনে হয়। প্রি-শিপমেন্টের জন্য ৫ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। ব্যবসায়ীরা যে ঋণপত্র খোলেন, এরপর অনেক সমস্যা হয়। অনেক সময় বাংলাদেশ ব্যাংকের গ্যারান্টি লাগে। এ ক্ষেত্রে এটা খুব কাজে লাগবে। আবার যেসব মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়েছে, তাদের জন্য বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। গ্রামের এখনো ৩ কোটি মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে আছে। তাদের জন্য বরাদ্দ বাড়ানো ও চালের দাম কমানো হয়েছে। এ সুবিধা কারা পাবেন, তার তালিকাটি এখনই চূড়ান্ত করতে হবে। যেহেতু সশস্ত্র বাহিনী মাঠে নেমেছে, তাই সমন্বয় করে দ্রুত তালিকাটি প্রণয়ন করতে হবে। যদি প্রশাসনের মাধ্যমে তালিকাটি করা হয় তাহলে দ্রুত ও ন্যায্য হবে বলে আমি মনে করি। এতে রাজনৈতিক নেতা–কর্মীদের সহায়তা লাগতে পারে। কিন্তু মূল কাজ করবে প্রশাসন। 

চলতি বাজেটে ৮৮ লাখ মানুষের জন্য ৭৪ হাজার কোটি টাকা সামাজিক ভাতা বরাদ্দ আছে। এটা জিডিপির ২ দশমিক ৭ শতাংশ। ব্যবসা-বাণিজ্য উন্নয়নে নানা প্রণোদনা দেওয়া হয়েছে, সেটা ভালো কথা। কিন্তু সামাজিক খাতকেই সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। এ জন্য সামাজিক ভাতাভোগীর সংখ্যা বাড়িয়ে ১ কোটি ২৬ লাখ ও দেড় লাখ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়ার প্রস্তাব করছি। আমি এই সুপারিশটুকু রাখলাম, ভবিষ্যতে এটাই সবচেয়ে বেশি কাজে আসবে। 

এখন যে বোরো ধান মাঠে আছে, এটাই কিন্তু চালের ৬০ ভাগ জোগান দেয়। কোনো কোনো জায়গায় এখনো সেচ দিতে হচ্ছে। আর কিছুদিন পরই এর ধান উঠে যাবে। আমি মনে করি, সরাসরি প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর থেকে এটা তদারকি করা প্রয়োজন। যেখানে যা প্রয়োজন সেখানে তা পাচ্ছে কি না, সময়মতো ধান কাটা হচ্ছে কি না, এসবের তদারকি প্রয়োজন আছে। এবার অনেক মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়েছে, তাই আশা করা যায় ধান কাটার জন্য শ্রমিকের অভাব হবে না। সরকারের কাছে এখন ১৪ লাখ টন ধান ও ৩ লাখ টন গম আছে। এ বছর যে ধান উদ্বৃত্ত হবে, তা সরকারকে মজুত করতে হবে। সরকারের মজুত করার মতো জায়গা নেই, প্রয়োজনে গুদাম ভাড়া নিয়ে করতে হবে। কারণ, অনেক দেশ খাদ্যসংকটের আশঙ্কা করছে। তাই কোনোভাবেই আমাদের রপ্তানি করা যাবে না। আর আমরা খাদ্য আমদানি করে চলতে পারব না। 

যে প্রণোদনা দেওয়া হলো, তা আর্থিক। এতে বাজারে অনেক টাকা চলে যাবে। এ জন্য কৃষির উৎপাদন বাড়াতে হবে, তাতে মূল্যস্ফীতি লাগাম টেনে যাবে। কারণ, যেভাবে টাকা দেওয়া হবে, তাতে মূল্যস্ফীতি ধরে রাখা কঠিন। অনেকে মনে করেন, মূল্যস্ফীতি বাড়বে না। আমি এর সঙ্গে পুরোপুরি দ্বিমত পোষণ করি। যত দ্রুত কৃষি, হস্ত, দুগ্ধশিল্পসহ বিভিন্ন দেশীয় উৎপাদন বাড়াতে পারব, ততই ভালো। এতে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে থাকবে। 

এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক বলেছে, বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি শূন্য দশমিক ৪ শতাংশ কমতে পারে। আমরা যদি জিডিপি ৭ থেকে সাড়ে ৭ শতাংশ অর্জন করতে পারি, তাহলেই আমরা ভারত–পাকিস্তানের থেকে এগিয়ে থাকব। এ জন্য দেশের পোলট্রি, দুগ্ধ, ফল, ফুল, মৎস্য খাতে যে অর্জন হয়েছে, তা বেগবান করতে হবে। আর প্রণোদনার টাকার যথাযথ ব্যবহার করতে হবে। 

অর্থনীতিবিদেরা কেউ কেউ বলছেন, এটা গ্রেট ডিপ্রেশন বা বড় মন্দা। তবে এর মধ্যে সংগ্রাম করছে শীতের দেশ ইউরোপ, সমৃদ্ধির দেশ যুক্তরাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্র ৩ লাখ ২০ হাজার কোটি টাকা আর্থিক প্রণোদনা দিয়েছে। আরও ৭০০ কোটি ডলারের প্রণোদনা আসছে বলে জানিয়েছে। এরপরও দেশটির প্রকৃত উৎপাদন ঘুরে দাঁড়াবে না বলে তারা মনে করছে। ডলারের দাম অর্ধেকে নেমে আসতে পারে। এসব পূর্বাভাস আছে। এসব দেশ থেকে আমাদের কিছু শিক্ষণীয় আছে। আর তৈরি পোশাক কারখানা খোলা রাখার সিদ্ধান্তটি যৌক্তিক। তবে এতে বড় সমন্বয়হীনতা রয়েছে। যানবাহন বন্ধের মধ্যে তাদের চলে আসতে বলা হয়েছে। আবার এখন বলা হচ্ছে, ১১ এপ্রিলের আগে খুলছে না। এসব সমন্বয়হীনতা যত দ্রুত দূর হবে, ততই মঙ্গল।

মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন
সাবেক গভর্নর, বাংলাদেশ ব্যাংক