প্রজেক্ট সিলভার লাইনিং-২

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

সুইডেন থেকে ঢাকাগামী এরোফ্লোট নামের রাশান প্লেনে উঠে বসল মহুয়া। ওর পরের প্রজেক্ট অধ্যাপক মেহেরের একান্ত পারিবারিক সমস্যা তাঁর এক সহৃদয় বান্ধবী সিলভার লাইনিংকে জানিয়েছেন। মাস ছয়েক হলো সব সময় হাসিখুশি অধ্যাপক মেহের একদম চুপচাপ হয়ে গেছেন। তুখোড় প্রফেসর, শুধু ক্লাস নেওয়া ছাড়া আর কিছুতেই সময় দেন না ইদানীং। মহুয়া জেনে নিল প্রফেসর মেহেরের বাসায় থাকবে ও, বাংলাদেশে বেড়াতে এসেছে আর ওর কেউ এখানে থাকে না এই কাভারে। ঢাকা নামল রাত ১২টায়। এত রাতে কাউকে বিরক্ত না করে হোটেলের রুম নিয়ে র‌্যাডিসনের গাড়িতে চলে গেল হোটেলে। সকালে উঠে উবার করে চলে এল বারিধারার ছোট্ট একটা বাগানঘেরা বাড়িতে। শীতের হালকা আমেজ এখনো আছে। বেল বাজাতেই দারোয়ান এসে বলল, ‘বিদেশি আপা? আসেন। গতকাল মেডাম অনেক চিন্তা করছেন আপনার জন্যি।’

ঘরে ঢুকতেই কবিতার মতো সুন্দর প্রফেসর এসে হাত ধরে বললেন, ‘মেয়ে এটা কি তোমার স্যানহোজে পেয়েছ? রাতে অবশ্যই আমাকে তোমার জানানো উচিত ছিল যখনই ঢাকা নেমেছ। তোমার কিছু হয়ে গেলে ছোটবেলার বান্ধবী রমাকে কীভাবে মুখ দেখাতাম?’ খুব গোছানো প্রফেসর হালকা গোলাপি একটা সালোয়ার কামিজ কিনে রেখেছেন ওর জন্য। বললেন, ‘চট করে রেডি হয়ে নাশতা খেয়ে চলো কলেজ দেখবে আমার। মানুষ গড়ার প্রতিষ্ঠান থেকে শুরু হোক নিজের দেশকে চেনা।’ নাশতা খাওয়ার মাঝেই নেমে এলেন প্রফেসর মেহেরের স্বামী হীরক সাহেব। টেবিলে বসতেই মেহের বললেন, ‘আজকে মহুয়া আর আমাকে একটু কলেজে নামিয়ে দিতে পারবে? পথে বাচ্চাদেরও নামাবে?’ হীরক সাহেব মুখ বাঁকা করে বলে বসলেন, ‘দেশ দেখতে এসে বিদেশের আরাম আয়েশ চাইলেই তো হবে না। এসব সোশ্যাল ওয়ার্ক ছাড়াও কাজ আছে অনেক আমার।’ গাড়ি নিয়ে চলে গেলেন উনি, একা।

হঠাৎ একরাশ আষাঢ়ের মেঘ নেমে এল প্রফেসরের মুখে। মহুয়া তখনই দেখল ১২ বছরের তাঁদের যমজ ছেলে-মেয়ে সায়র আর বর্ণা নেমে এল। পরিচয় হতে হতেই অভ্রা এল। প্রফেসর মেহের পরিচয় করিয়ে দিলেন সবার সঙ্গে। অভ্রা ওনার চাচাতো বোন, স্বামী মারা যাওয়াতে আশ্রয়হীন হয়ে গিয়েছিল। প্রফেসর থাকতে দিয়েছেন দুই বছর হলো। বাচ্চারা নাশতা শেষ করতেই মহুয়া বলল, ‘গাড়ি তো দুটো আছে না? চলুন যে কদিন থাকছি গাড়ি চালিয়ে কিছুটা হলেও দেনা শোধ করব।’ মেহের অনেক আপত্তি করলেও রাজি হলেন শেষমেশ। বললেন, ‘পরীক্ষামূলক চালাও। ঢাকা আর আমেরিকা এক কথা না কিন্তু।’

গাড়ি করে বাচ্চাদের নামিয়ে চলে গেল ওরা কলেজে। টিচার্স রুমে মহুয়াকে বসিয়ে মেহের চলে গেলেন ক্লাস নিতে। প্রফেসর নুরুন ওর পাশে বসে বললেন, ‘মেহের আগে যাবতীয় খেলাধুলা, সংস্কৃতি অনুষ্ঠানের প্রাণ ছিলেন, ছেলেমেয়েদের পিকনিকে নিয়ে যেতে কেউ রাজি না থাকলেও উনি ছিলেন। পরোপকারী হিসেবে উনি তো কিংবদন্তির কাছাকাছি। কিন্তু গত ছয় মাস কেমন যেন গুটিয়ে নিয়েছেন নিজেকে সবকিছু থেকে। কিছু ছাত্রছাত্রীর পড়ার খরচ দেওয়া আর নিয়মিত ক্লাস নেওয়া ছাড়া কেমন বিষণ্ন থাকেন উনি।’ বলতে বলতে প্রফেসর মেহের চলে এলেন। ছোট্ট একটা টুর দিলেন মহুয়াকে কলেজে আর তারপর বাচ্চাদের তুলে নিয়ে বাসার পথে রওনা হয়ে গেল ওরা। মেহের বললেন, গত ছয় মাসে বাচ্চাদের বাবার এত কাজের চাপ বেড়েছে যে বাসার কোনো কিছুতেই তিনি সময় দিতে পারেন না। বললেন, ‘গাড়ি তো বেশ ভালো চালাও মেয়ে।’ মহুয়া বলে বসল, ‘শিখবেন আমার কাছে?’ শুধু শুধু বসে বসে খেতে লজ্জা লাগবে ওর। প্রফেসর স্মিত হেসে বললেন, ‘কেন নয়?’

সেদিন হীরক সাহেব আর অভ্রা অনেক রাতে একসঙ্গে বাসায় ফিরল। নার্স হিসেবে কোথাও নাকি ইন্টারভিউ ছিল অভ্রার, হীরক সাহেব নিয়ে গিয়েছিলেন। মেহের গাড়ি চালানো শিখবেন শুনে তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলেছিলেন, ‘গাধা কখনো ঘোড়া হয় শুনেছ মহুয়া?’ মহুয়া বলেছে, ‘না, শুনেনি। তবে বানরের গলায় মুক্তাহার শোভা পায় কখনো কখনো, তা শুনেছে।’ এক মিনিট দুজন দুজনের দিকে তাকিয়ে হীরক সাহেব ঘুমাতে চলে গেলেন। মহুয়া তাকিয়ে দেখল, মেহেরের চোখ দুটোতে আষাঢ়ের ঘনঘটা। রাতে মহুয়া বাংলাদেশ নেটওয়ার্কের সোশ্যাল ওয়ার্কার জেনিকে হীরক সাহেব সম্পর্কে সব তথ্য জানাতে বলে দিল। সব কিন্তু হবে গোপনে।

মাসখানেকের মধ্যে মেহের দারুণ গাড়ি চালাতে শিখলেন। এর মাঝে বোটানিকাল গার্ডেন, রমনা পার্ক, বলধা গার্ডেন, গুলশান লেক পার্ক, রোজ গার্ডেন দেখা শেষ। সোনারগাঁ যাবেন সবাই সেদিন সকালে। অভ্রা বা হীরক সাহেব এক দিনও যাননি ওদের সঙ্গে। প্রতিটি ছোটখাটো ব্যাপারে প্রফেসর মেহেরকে ছোট করে, অপমানকর কথা বলা হীরকের অভ্যেস যেন। মেহের সেদিন এত দূরে যাবেন, ড্রাইভার নিয়ে যাবেন শুনে হীরক চিৎকার করে বলে বসলেন, ‘তোর বাচ্চা নিয়ে তুই বের হয়ে যা।’ এত দিনে এটা ছিল চরম অপমানসূচক ব্যবহার মহুয়ার সামনে।

এনক্রিপ্টেট মেসেজ এল মহুয়ার কাছে সে রাতে। হীরক সাহেব আসলে অভ্রাকে বিয়ে করে ফেলেছেন। এই বাড়ি মেহেরের বাবার। হীরক ছিলেন মেহেরের বোনের বন্ধু। বহু পিছে ঘুরে মেহেরকে পেয়েছিলেন তিনি। কিন্তু মেহেরের ভালো মানুষির সুযোগ নিয়ে সম্পদের অনেকটা গ্রাস করেছেন তিনি ইতিমধ্যে। এই প্রথম মহুয়া আকুল হয়ে কাঁদতে দেখল প্রফেসর মেহেরকে। দেখল বাচ্চা দুটো প্রফেসরের দুপাশে। মহুয়া হীরককে বলল, ‘চলে যাবি তুই। ইমোশনাল এবিউজের দিন শেষ। চলে যা তোর নতুন বউ নিয়ে।’ হীরক আর অভ্রা লাঠি নিয়ে এগিয়ে এল মেহের আর বাচ্চাদের দিকে। মহুয়া ফাঁস করে দিল ওদের গোপন সম্পর্কের কথা, সম্পত্তি গ্রাসের কথা প্রমাণসহ।

কিন্তু চৌকস কিক বক্সার মহুয়ার ঘুষি খেয়ে মাটিতে দুজন দুই মিনিটের মাথায়, আগে থেকে খবর দেওয়াতে পুলিশ এসে নিয়ে গেল দুজনকে। মহুয়া হাত বাড়িয়ে দিয়ে কাঁধটা ধরল প্রফেসর মেহেরের। বলল, ‘মানুষ গড়ার কারিগর উঠে দাঁড়ান, মাথা উঁচু করে বাঁচুন আর বাচ্চাদের বাঁচতে শেখান। কিছু খারাপ মানুষ আছে কিন্তু দুনিয়াতে। ভালো মানুষের সংখ্যা অনেক অনেক বেশি।’ কাউন্সেলিং আর কারাতে শেখার ইনফরমেশন দিয়ে মহুয়া এয়ারপোর্টের পথে রওনা হয়ে গেল, টেক্সট করে জানাল বসকে মিশন ডান। প্যারিসে চলে যাচ্ছে ও। চোখ দুটা ভেজা ভেজা। কত মাস পরে আবার আসতে পারবে প্রাণের দেশে ও জানে না। ভালো মানুষদের সঙ্গে এমন নীতিবিবর্জিত মানুষের পরিচয় কীভাবে হয়, পৃথিবীর আশ্চর্য রহস্য সেটা। চলবে...