প্রকৌশলী দেলোয়ার বাংলাদেশের ঘুণেধরা সমাজের বলি

প্রকৌশলী দেলোয়ার
প্রকৌশলী দেলোয়ার

একেবারে সাম্প্রতিক সময় থেকেই শুরু করি। সরকারি চাকরি ছেড়ে বিদেশে এসেছি শুনে সবাই কেমন জানি সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকায় আমাদের দিকে। তা–ও আবার একজন না, দুজনেরই সরকারি চাকরি ছিল। তখন সন্দেহটা আরও ঘনীভূত হয়। নিশ্চয়ই দেশে আমরা বড় ধরনের কোনো দুর্নীতি করে এ দেশে এসে লুকিয়েছি। মানুষের গলার স্বরের বিষয় আমি ঠিকই টের পাই আর চোখের চাহনিতে সেটা আরও পরিষ্কার হয়ে ওঠে। অনেকে আবার এতটাই বিস্মিত হন যে জিজ্ঞেস করেই ফেলেন, কেন আমরা সরকারি চাকরি ছেড়ে বিদেশে এসে কামলা দিচ্ছি। একবার একজন যখন জানতে পারলেন, আমরা সরকারি চাকরি ছেড়ে বিদেশে এসেছি, তখন বলেই বসলেন বিদেশের মাটিতে মানুষ যে কী মধু পায়, সরকারি চাকরি ফেলে বিদেশে পাড়ি জমায়। সরকারি চাকরি নিয়ে সাধারণের মনের ধারণাটা এমনই।

অন্য একদিন আড্ডায় একজন নেতাগোছের বড় ভাই দেশে তাঁর একজন সরকারি চাকরিজীবী বন্ধুকে নিয়ে অনেক গর্ব করে গল্প করছেন। একবার দেশে গিয়ে তিনি তাঁর সেই বন্ধুর কর্মক্ষেত্র সিলেটের একটা জায়গায় বেড়াতে গেছেন। সেখানে তাঁর বন্ধু তাঁকে সিলেটের সব রকমের ভালো ভালো খাবার দিয়ে আপ্যায়ন করেছেন। কথায় কথায় বলেই ফেললেন, বাংলাদেশে যে এত প্রজাতির মাছ পাওয়া যায়, তিনি এর আগে জানতেন না। কী সুন্দর দেখতে আর কী তার বাহারি স্বাদ। এখনো নাকি তাঁর ঠোঁটে লেগে আছে। এটা শুনে আমি নরমভাবে জিজ্ঞেস করলাম, আপনি কি একবারও আপনার বন্ধুর অতগুলো মাছ কেনার সামর্থ্য আছে কি না যাচাই করেছেন। আমার প্রশ্ন শুনে তিনি আমার দিকে তির্যক দৃষ্টি দিলেন। আমি বললাম, এই মাছ সরবরাহের জন্য আপনার বন্ধুকে হয়তোবা কারও একটা অন্যায় প্রস্তাব মেনে নিতে হয়েছে।

এমন আরও হাজারটা উদাহরণ দেওয়া যাবে সরকারি চাকরিজীবীদের নিয়ে। আমি এখানে শুধু প্রবাস জীবনের দুটো উদাহরণ দিলাম। বাংলাদেশের আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে আপনি যদি একটা মোটামুটি মানের জীবন নিশ্চিন্তে এবং নির্ভাবনায় পার করে দিতে চান, তাহলে সরকারি চাকরির বিকল্প নেই, তাই তো বিসিএস পরীক্ষার্থীর সংখ্যা দিনে দিনে বেড়েই যাচ্ছে। যে যে বিষয় নিয়েই পড়ুক না কেন, দিন শেষে সবাই বিসিএস দেওয়ার জন্য পড়াশোনা করছেন। দুঃখের বিষয় হচ্ছে, বাংলাদেশের টেকনিক্যাল ব্যাকগ্রাউন্ডের মানুষের দুর্দশা দিনে দিনে বেড়েই যাচ্ছে। তাই সবাই এখন বিসিএসে প্রশাসনকেই সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেয়। কারণ, সবাই জেনে গেছে দেশটা আদতে জনগণের বা রাজীনীতিবিদদের হলেও দিন শেষে শেষে প্রশাসনের আমলাদের দেশ। আর বিসিএস এমন একটা পরীক্ষা যে সেখানে কোনো একজন পরীক্ষার্থীর মেধাকে আলাদাভাবে যাচাই করার উপায় নেই। সবাইকেই একই রকম পরীক্ষা দিতে প্রিলিমিনারি পাস করতে হয় আর তার জন্য মুখস্থ বিদ্যার কোনো বিকল্প নেই, তাই দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের কোনো কলেজ থেকে অনার্স পাস করা পরীক্ষার্থীও প্রথম হয়ে যান। কারণ, নিজের পড়াশোনার বাইরে পুরোটা সময় বিসিএসের জন্য পড়েছেন।


এরপর আসে বিসিএস লিখিত পরীক্ষা। সেখানেও নয়টি বিষয় সবার জন্য নির্ধারিত আর টেকনিক্যাল ক্যাডারদের দিতে হয় নিজের বিষয়ের সঙ্গে সম্পর্কিত বাড়তি আরও দুটো পরীক্ষা। সবশেষে আসে মৌখিক পরীক্ষা। এর সব কটিতে উত্তীর্ণ হতে পারলেই যে একজন সরকারি চাকরি করতে পারবেন, ব্যাপারটা কিন্তু তা নয়। কারণ, পুলিশ ভেরিফিকেশনে বাদ পড়ার ঘটনাও ঘটে। প্রিলিমিনারি পরীক্ষা, লিখিত পরীক্ষা, মৌখিক পরীক্ষা নিয়ে বাংলাদেশে বহু গল্প প্রচলিত আছে, আমি সেদিকে যাচ্ছি না। আমি ধরে নিচ্ছি, একজন যোগ্য প্রার্থীই দিন শেষে সরকারি চাকরিতে যোগ দেন। একবার সরকারি চাকরিতে যোগদানের পর জীবন হয়ে যায় একেবারে স্থবির।


আমি ঠিক জানি না বাংলাদেশের সরকারি চাকরিতে দুর্নীতির সূত্রপাত কবে। কিন্তু দুর্নীতি যে আছে, সেটা সবাই একবাক্যে স্বীকার করবেন। তবে দুর্নীতির এই চর্চা বহু বছর ধরে চলার অন্যতম কারণগুলোর মধ্যে আমার কাছে প্রধান কারণ বলে মনে হয় সরকারি চাকরির স্থায়িত্ব। আপনি কোনো একটা দুর্নীতি করলে আপনাকে জবাবদিহি করতে হবে। এর চেয়ে বেশি কিছু হলে আপনাকে ওএসডি (অফিসার অন স্পেশাল ডিউটি) করা হবে। আর যদি প্রাথমিক তদন্তে দুর্নীতির প্রমাণ পাওয়া যায়, তাহলে বিভাগীয় নীতিমালা অনুযায়ী মামলা চলবে, কিন্তু চাকরি যাওয়া এগুলোর একেবারে শেষ ধাপ। বাংলাদেশের অভিজ্ঞতায় কাউকে দুর্নীতির দায়ে শেষ পর্যন্ত সরকারি চাকরি অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে বলে আমার জানা নেই। সরকারি চাকরিতে ঢোকার আগেই আপনার মানসিকতাকে তৈরি করতে হবে দুর্নীতি সহ্য করে নেওয়ার। যুগ যুগ ধরে সরকারি ব্যবস্থায় দুর্নীতি এমনভাবে ঢুকেছে যে এখন আর সেটাকে অস্বাভাবিক মনে হয় না, বরং কোথাও দুর্নীতি নেই জানলেই ব্যাপারটা কেমন জানি বেখাপ্পা মনে হয় এখন।

দিনে দিনে এসব দুর্নীতি বিভিন্ন রকমের খেতাবও পেয়েছে। এইবার সেদিকে একটু দৃষ্টি দেওয়া যাক। একটা কথা প্রায়শই শোনা যায়, সেটা হচ্ছে সহনীয় দুর্নীতি আর অসহনীয় দুর্নীতি। আমি অবশ্য নিজের সরকারি চাকরির অভিজ্ঞতা থেকে দুর্নীতিকে তিন ভাগে ভাগ করি—হালাল ঘুষ, জায়েজ ঘুষ এবং হারাম ঘুষ। হাল, জায়েজ এবং হারাম শব্দগুলো ব্যবহার করার জন্য ধর্মপ্রাণ মানুষের কাছ থেকে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি। কিন্তু এই টার্মগুলো ছাড়া আসলে দুর্নীতির প্রকটতা বোঝানো সম্ভব নয়।


হালাল দুর্নীতি হচ্ছে সেই সব দুর্নীতি, যেটা সবাই মেনে নিয়েছে। যেকোনো একটা প্রজেক্ট পাস হওয়ার প্রাক্কালে বা সামান্য পরেই এই দুর্নীতিগুলো হয়ে থাকে। প্রজেক্টের মূল্যমানের ওপর ভিত্তি করে সরকারি লোকজনের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ চলে যায় যার যার পদাধিকার অনুযায়ী। সেই প্রজেক্টের সঙ্গে যুক্ত প্রত্যেকেরই তাতে ভাগ থাকে। এই দুর্নীতি বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটি প্রজেক্টের ক্ষেত্রেই আছে। এই দুর্নীতি বাংলাদেশের মানুষের মানসিকতায় এমনভাবে ঢুকে গেছে যে সেটা সরকারি পরিধি ছাড়িয়ে বেসরকারি, বহুজাতিক কোম্পানি এমনকি বিশ্বময় ছড়িয়ে পড়েছে। এই দুর্নীতির একটা গালভরা নামও আছে ‘পার্সেন্টেজ’ যেটাকে সংক্ষিপ্ত করে বলা হয় পিসি। কোনো সরকারি কাজ কেউ পেয়েছেন, কিন্তু তাকে পিসি দিতে হয়নি—একথা কেউ হলফ করতে বলতে পারবেন না বলেই আমার বিশ্বাস।


এরপরের ক্যাটাগরির নাম দিয়েছি জায়েজ দুর্নীতি। এই দুর্নীতিটাও এখন মোটামুটি সহনীয় হয়ে গেছে। কোনো একটা প্রজেক্ট চলছে, তখন যারা এই প্রজেক্টের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট থেকে তত্ত্বাবধান করেন, তাদের নিয়মিত একটা টাকা দিতে হয়। একটু বিস্তারিত বলা যাক। প্রজেক্টের সঙ্গে সম্পর্কিত কোনো ব্যক্তি যদি মাঠপর্যায়ে পরিদর্শনে যান, তখন সেই ব্যক্তির খাওয়াদাওয়া চলাফেরা খরচ দেওয়া হয়। সেই ব্যক্তির সঙ্গে আগত ড্রাইভার, মাঠপর্যায়ের কর্মী—সবারই যত্ন নেওয়া হয় এবং দিন শেষে ফিরে যাবার সময় প্রত্যেকের পদাধিকার অনুযায়ী একটা অর্থ দেওয়া হয়। যদিও সেই সরকারি কর্মকর্তা বা কর্মচারী অফিস থেকে বা প্রজেক্টের অর্থ থেকেও দৈনিক ভাতা পাবেন মাঠপর্যায়ে পরিদর্শনের জন্য।

আর তৃতীয় প্রকারের দুর্নীতি হচ্ছে হারাম দুর্নীতি। প্রজেক্টের কাজ শেষ হয়ে গেছে এবং সেই মোতাবেক বিল সাবমিট করা হয়েছে অনুমোদনের জন্য; কিন্তু তখনো অনেকের মনে খিদে রয়ে গেছে। তখন এই হারাম দুর্নীতির অবতারণা হয়। বিল অনুমোদনের আগে তখন সরকারি কর্মকর্তা শর্ত জুড়ে দেন। এই শর্ত জুড়ে দেওয়াটাও এখন শিল্পের পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। বিল সাবমিট করার পর বলা হলো, আপনার ভাবি গতকাল অমুক মার্কেটের অমুক দোকানে একটা ভালো টেলিভিশন বা ফ্রিজার দেখে এসেছেন। পরের দিন সেই নির্দিষ্ট ব্র্যান্ডের পণ্য সেই কর্মকর্তার বাড়িতে শোভা বর্ধন করলেই কেবল বিল অনুমোদন দেওয়া হয়; অন্যথায় অহেতুক ঝামেলা তৈরি করে বিল আটকে রাখার অভিযোগ হরহামেশাই মেলে।

এমন আরও বহু দুর্নীতির প্রকার বলা যাবে। অফিসভেদে এগুলোর শুধু আকার ও প্রকার বদলে যায় কিন্তু দুর্নীতি বাংলাদেশের সব কটি খাতে বিদ্যমান। মৌলিক চাহিদাগুলোর ডিপার্টমেন্টে সবচেয়ে বেশি দুর্নীতি হয়; কারণ, সেখানে বাজেটের অনেক বড় অংশ ব্যয় হয়। আগেই বলেছি, দুর্নীতির এই চিত্র বাংলাদেশের সরকারি খাত ছাড়িয়ে বেসরকারি, বহুজাতিক এমনকি বিশ্বময় ছড়িয়ে গেছে। তবু কেন বাংলাদেশের সরকারি ব্যবস্থা ভেঙে পড়ে না এর অনেকগুলো কারণের একটি হলো, একেবারে হাতে গোনা কিছু সরকারি কর্মকর্তা এখনো সব বিভাগেই সততার সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছেন। তবে তাঁদের জীবনযাপন হয় একেবারে অনাড়ম্বর সোজা বাংলায় তথৈবচ। ঠিক তেমনই একজন কর্মকর্তা ছিলেন প্রকৌশলী দেলোয়ার হোসেন। তিনি সরকারি একটি দপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলীর পদে চাকরি করা সত্ত্বেও এখন পর্যন্ত একটা ৯০০ স্কয়ার ফুটের ভাড়া বাসায় থাকতেন। যেখানে আমি হলফ করে বলতে পারি, তাঁর সমান পদমর্যাদার ব্যক্তিদের ঢাকা শহরে একাধিক ফ্ল্যাট, বাড়ি ও গাড়ি আছে। বাসাতে আছে একটা ২০ বছরের পুরোনো ফ্রিজার। আসলে ২০১৫ সালে নতুন বেতনকাঠামোর আগ পর্যন্ত সরকারি বেতন এমন পর্যায়ের ছিল যে একজন সরকারি চাকরিজীবীর জন্য যেকোনো শহরে সৎভাবে জীবনযাপন মোটামুটি কষ্টকরই ছিল। এরপর বেতন বেড়েছে কিন্তু সরকারি লোকজন তাঁদের পুরোনো অভ্যাস রাতারাতি ত্যাগ করতে পারেননি।


সরকারি দপ্তরে আপনি হয়তোবা আপনার দর্শন নিয়ে থাকতে চাইলেন, কিন্তু সেখানেই বাদ সাধবে একটা পুরোপুরি আকণ্ঠ দুর্নীতিতে ডুবে থাকা সিস্টেম। আপনি দুর্নীতি না করলে আপনার অধীনস্থরাও বঞ্চিত হতে থাকবে তাদের এত দিনের পাওনা অংশ থেকে আর তারা সেটা কোনোভাবেই বরদাশত করবে না। আর একটা ব্যাপার হচ্ছে, আপনি হয়তোবা টাকাপয়সার দুর্নীতি করছেন না, কিন্তু আপনি কাজের গুণাগুণও রক্ষণাবেক্ষণ করতে পারবেন না। কারণ, আপনার একার পক্ষে শুধু এটা করা সম্ভব নয়। আর আপনি যদি পরে বিভিন্ন পরীক্ষা–নিরীক্ষার মাধ্যমে জানতেও পারেন যে কাজের গুণাগুণ খারাপ, তবুও আপনাকে বিল ছেড়ে দিতে হবে। কারণ, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায়, প্রায় সবাই আগে থেকেই ব্যাপারটা জানেন এবং ইতিমধ্যেই ম্যানেজ হয়ে গেছেন। দেলোয়ার হোসেন ভাইয়ের ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটেছে। আর তাঁর হত্যাকারী হিসেবে অভিযুক্ত সহকারী প্রকৌশলীকে ধরা হয়েছে। আমার বিশ্বাস, তিনি শুধু দাবার গুটি। কিন্তু তাঁকে পরিচালনা করেছে কোনো রাঘববোয়াল।

এবার আসি যারা দুর্নীতি করে, তাদের মানসিকতার বিষয়ে। সরকারি ট্যাক্স অফিসে টিন সার্টিফিকেট আনতে গেলে যে মহিলা কর্মকর্তা টিন সার্টিফিকেটে দস্তখত করেন, তাঁর একটা কথা এখনো মনে আছে। তিনি বলেছিলেন, তাঁর দুইটা মেয়ে দেশের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েন। আমরা যদি তাঁকে এই বাড়তি টাকাগুলো না দেই, তাহলে তাঁদের বেতন দেবেন কীভাবে। ব্যক্তিগত দুই বছর সরকারি চাকরি করতে গিয়ে দেখেছি, তাঁদেরও মাইন্ড সেট আছে দুর্নীতি করার ব্যাপারে।

বাংলাদেশের প্রতিটা খাতের দুর্নীতি এটাই প্রমাণ করে যে বাংলাদেশের সামগ্রিক সমাজব্যবস্থা পুরোপুরি দূষিত। তাই একটা একটা করে আলাদাভাবে দুর্নীতির বিচার করে আসলে লাভ নেই। পুরো সমাজব্যবস্থার পরিবর্তন দরকার; বিশেষ করে মানুষের মনোজগতে বিশাল পরিবর্তন আনা দরকার। দুর্নীতির টাকায় আলগা ফুটানি দেখিয়ে সমাজে চলাফেরা করলে যেখানে মানুষের সামাজিক অবস্থান বা স্ট্যাটাস উঁচুতে উঠে যায়, সেখানে রাতারাতি দুর্নীতি প্রতিরোধ সম্ভব নয়; তবে একেকজন দেলোয়ার হোসেন জীবন দিয়ে আমাদেরকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে যান আমাদের করণীয় কী। কিন্তু আমরা আমাদের গোল্ড ফিশ মেমোরিতে বেশিক্ষণ সেটা ধরে রাখি না। কয়েক দিন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম গরম করে আবারও আগের জীবনেই ফিরে ফিরে যায় আর দুর্নীতিও তার আগের অবস্থানে ফিরে যায়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আমরা সবাই দুর্নীতিমুক্ত সমাজ চেয়ে গলা ফাটাই, কিন্তু আমরা কেউই নিজের সামান্যতম স্বার্থটুকু হাসিল করার জন্য দুর্নীতির আশ্রয় নিতে পিছপা হই না।

আমাদের সমাজে আরও একটা ব্যাপার লক্ষণীয়, সেটা হলো আমরা ছোট মাস্তান বা সন্ত্রাসীকে খারাপ বলি, কিন্তু তাদেরকে লালন করা জনপ্রতিনিধিকে সকাল–বিকেল তেল মর্দন করি। আমরা যত দিন না এসব মানুষকে সামাজিকভাবে বয়কট না করব, তত দিন পর্যন্ত মানুষ দুর্নীতি করতে নিরুৎসাহিত হবে না। আরও একটা ব্যাপার হচ্ছে, সাধারণ মানুষকে বুঝতে হবে একজন সরকারি কর্মকর্তা বা কর্মচারীর ক্ষমতা কতটুকু। সরকারি চাকরি করে এলাকায় বড় বড় উপাসনালয় আর এতিমখানা বানালেই তাঁকে সমাজের মাথা ভাবার কোনো কারণ নেই। কিন্তু আমরা তাঁদেরকেই সম্মানের আসন দিই। অন্যদিকে একজন সৎ সরকারি কর্মকর্তা বা কর্মচারী নীরবে নিভৃতে থাকেন আর আমরা তাঁকে গোনার মধ্যেও রাখি না। অবশ্য তাঁরা এগুলোর ধার না ধেরেই সৎ জীবন যাপন করেন নিজের মানসিক শান্তির জন্য। সবচেয়ে দুঃখের বিষয়, তাঁদের এই সততাকে সাধারণ মানুষ দেখে দুর্বলতা হিসেবে।
এত এত দুর্নীতির পরও বাংলাদেশ যে টিকে আছে, আমার মতে তার ভিত হচ্ছে তিনটি। প্রথমত, বাংলাদেশের কৃষক। রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে, হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে বাংলাদেশের মানুষের মুখে অন্ন জুগিয়ে যাচ্ছেন কোনো প্রকার প্রতিদানের আশা না করেই। দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশের তৈরি পোশাকশিল্প যেটা টিকে আছে তাদের শ্রমিকের ঘামের ওপর। বছর বছর কারখানার মালিকের বাড়ি গাড়ির সংখ্যা বাড়তে থাকে কিন্তু শ্রমিকের ভাগ্যের চাকা আর ঘোরে না। তৃতীয়ত, প্রবাসী বাংলাদেশিরা যাঁরা বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে আছেন, মাথার ঘাম পায়ে ফেলে তাঁরা সারা দিন কাজ করে সেই টাকা জমিয়ে দেশে পাঠান। সেই টাকায় বাংলাদেশের সরকারি লোকজন নতুন নতুন প্রবৃদ্ধির অঙ্ক কষেন। দুঃখের বিষয়, এই তিন শ্রেণির মানুষেরই বাংলাদেশে সামাজিক অবস্থান খুবই ভঙ্গুর।

আমরা কথায় কথায় এক অপরকে খাটো করতে চাষা বলে গালি দিই, রাস্তায় হাঁটার সময় এমনভাবে গা বাঁচিয়ে চলি যেন পোশাককর্মীরা কোনো অচ্ছুত প্রাণিবিশেষ আর কথায় কথায় প্রবাসী মানুষগুলোকে আমরা ডিসি (ডিশ ক্লিনার), ওসি (অনিয়ন কাটার) বলে সম্বোধন করি। তবে সবচেয়ে বেশি ভোগান্তি পোহান প্রবাসীরা। কারণ, বাংলাদেশের বিমানবন্দরের ইমিগ্রেশনে তাঁদের সঙ্গে এমন ব্যবহার করা হয়, যেন তাদের গা দিয়ে বিষ্ঠার গন্ধ আসছে। বিভিন্ন অজুহাতে তাদের কাছ থেকে টাকা আদায় করার অভিযোগও আছে। আবার নিয়মের সামান্য এদিক–ওদিক হলেই কপালে জোটে কিল, ঘুষি। অতি সম্প্রতি এদের নাম দেওয়া হয়েছে নবাবজাদা।

প্রকৌশলী দেলোয়ার হোসেনের মতো দু–একজন যখন সততার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করার চেষ্টা করেন, তখন তাদেরকে মনে করা হয় পথের কাঁটা। পুরো সিস্টেম তখন সেই কাঁটা উপড়ে ফেলতে লেগে যায়, যদিও দেলোয়ার হোসেনরা তাতে পিছপা হন না। তাঁরা জীবন দিয়ে প্রমাণ করে যান যে বাংলাদেশের পুরো সমাজব্যবস্থা কতটা দূষিত আর আমরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে শুধু দুর্নীতি নিয়ে খিস্তি করেই দায়িত্ব শেষ করি।


সময় এসেছে সবাই মিলে একবারে রুখে দাঁড়ানোর। ছেলেমেয়েরা তাদের বিলাসিতাকে সীমাবদ্ধ রাখে এবং বাবা–মায়ের আয়ের উৎস অনুসন্ধান করে। স্ত্রীরা নিজেদের গয়না, শাড়ি, বাড়ি, গাড়ি দিয়ে অন্যের চেয়ে শ্রেয়তর হওয়ার প্রতিযোগিতা থেকে সরে আসেন। সর্বস্তরে শ্রমিকের ন্যায্য মজুরি ও সম্মান নিশ্চিত করেন। নিজের শিক্ষাটাকে পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যে ছড়িয়ে দেন, তাহলেই দেখবেন একদিন সত্যিকারের সোনার বাংলাদেশ গড়ে উঠবে।
[email protected]