প্রকৃতি মায়ের এক রূপসী কন্যা
পিরোজপুর শহরের মেরুদণ্ড বরাবর বয়ে চলা দামোদার খালের পাড়ে বেড়ে উঠতে উঠতে কখন যে পাঠ্যপুস্তকে পড়েছিলাম, বিশ্বের বৃহত্তম জলপ্রপাত নায়াগ্রা। তা ভুলে গিয়েছি। তবে দামোদার খালের জোয়ার ভাটায় মন থেকে ভেসে যায়নি নায়াগ্রা নামটি।
একদিন জীবনস্রোতে ভেসে আমি দামোদার খাল থেকে কালিগঙ্গা হয়ে কীর্তনখোলার পাড়ে; অতঃপর পদ্মা, মেঘনা পাড়ি দিয়ে বুড়িগঙ্গার তীরে। তারপর আবার পাখির মতো উড়ে এসে পৌঁছে যাই স্ট্যাচু অব লিবার্টির শহর নিউইয়র্কে। উজ্জ্বল আলো আর ইট পাথরে গাঁথা মনকাড়া কৃত্রিম সৌন্দর্যের শহরে কঠিন ব্যস্ততার মধ্যেও ২০০২ সালের গ্রীষ্মের ছুটিতে প্রথম দেখার সুযোগ হয়েছিল প্রাকৃতিক সৌন্দর্য নায়াগ্রা জলপ্রপাত।
যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডার সীমান্তে নায়াগ্রা নদীর ওপরে ছোট বড় মোট তিনটি জলপ্রপাত। এদের সব থেকে ক্ষুদ্র ব্রাইডাল ভিল জলপ্রপাত চওড়া মাত্র ৫৬ ফুট (১৭ মিটার)। মাঝারি আমেরিকান জলপ্রপাত ১১০ ফুট (৩৪ মিটার) উঁচু ও ৯৫০ ফুট (২৯০ মিটার) প্রশস্ত। আর সর্ববৃহৎ হর্সশু জলপ্রপাত প্রায় ১৬৭ ফুট (৫১ মিটার) উঁচু ও ২ হাজার ৭০০ ফুট (৮২০ মিটার) প্রশস্ত। আর এই তিনটি জলপ্রপাতকে একত্রে বলা হয় নায়াগ্রা জলপ্রপাত।
প্রথম দর্শনেই আমি তার প্রেমে পড়ে গিয়েছিলাম। দুই নয়ন ভরে এমনভাবে দেখেছিলাম তাকে, যেন হৃদয়ও পূর্ণ থাকে আজীবন তাকে দেখার আনন্দে। তার অকৃত্রিমতা দেখতে প্রায় এক ক্রোশ কাচা-পাকা পথ পায়ে হেঁটেছিলাম সেদিন। তার শরীর ঘেঁষে নানান আকারের পাথর ও গাছ-গাছালির বিচরণ আর তার ক্ষতবিক্ষত শাখা প্রশাখা দেখে, মনের অজান্তে একবার বলেছিলাম, ‘এ যে তোমার কান্না ছাড়া আর কিছুই নয়। তবুও মানুষ তোমার কান্নায় সৌন্দর্য খুঁজে পায়। আনন্দ কুড়ায়।’ পরক্ষণেই সবার সঙ্গে আমিও নিজের আনন্দে উচ্ছ্বসিত হয়ে গিয়েছিলাম তার ত্যাগের অপরূপ রূপের খুব কাছাকাছি। এক ঝলক হাসিতে আমায় ভুলিয়ে, সে স্নান করিয়ে দিয়েছিল আমাকে তার আঁখিজলে। আমি নির্বাক হয়েছিলাম তার রূপ, শক্তি, ত্যাগ ও ব্যথা মাথা জলে ভিজে।
তারপর ২০০৩ সালে লেক এরই পার হয়ে কানাডাতে শুরু করি জীবনযাপন। সেই থেকে প্রতি বছর একাধিকবার আমি তাকে দেখতে যাই নিজের প্রয়োজনে। হ্যাঁ, নিজের প্রয়োজনেই যাই আমি সেখানে। প্রয়োজনটা আসলে আমার মনের। প্রথমত আমি তার রূপ ও গুণে মুগ্ধ হয়ে প্রেমে পড়েছি তার। দ্বিতীয়ত তার বৃহত্তরতার কাছে গেলেই আমি আমার ক্ষুদ্রতাকে পরিমাপ করতে সক্ষম হই। শুধু তাই নয়, নায়াগ্রাতে দৃষ্টি পড়ার সঙ্গে সঙ্গে আমি ভুলে যাই আমার কোনো কিছু হারানো কিংবা না পাওয়ার বেদনা।
আশ্চর্যজনক হলেও সত্যি, প্রতিবারই আমি কিছু না কিছু নতুনত্ব খুঁজে পাই নায়াগ্রায়। সকাল, দুপুর, বিকেল, সন্ধ্যা, রাত; এমনকি, বাংলার গ্রীষ্ম, বর্ষা, শরৎ, হেমন্ত, শীত, বসন্ত সব ঋতুতেই আমি তাকে দেখেছি। প্রতিটি ঋতুতে এবং দিনের বিভিন্ন পর্বে বিভিন্নভাবে সে তার নিজস্ব রূপে বিকশিত হয়। এরপরও কখনো কখনো রংধনু তার মাথার মুকুট হয়ে থাকে। আর কিছু না হলেও, দৃষ্টি খুলে নতুন নতুন পর্যটকদের আনন্দ দেখি। দেখি নায়াগ্রার অসংখ্য প্রেমিকদের, যারা তার হৃদয়ের কাছাকাছি দাঁড়িয়ে নিজের সর্বশ্রেষ্ঠ একটা ছবি তুলে রাখতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। দেখি প্রকৃতির এই সৌন্দর্যকে পুঁজি করে বাণিজ্যিকদের নতুন নতুন বাণিজ্য কৌশল। কখনোই ভুল হয় না আমার, কান পেতে তার শব্দ শুনতে। হ্যাঁ, নিবেদিত প্রাণে তার পতিত হওয়ার শব্দ। শব্দও তার সৌন্দর্যের মতো বদলে যায় প্রতিবার। ঠিক যেন আমার মনের অবস্থার মতো। কখনো সে শব্দ সুর হয়ে কানে লাগে, কখনো বা ছন্দ হয়ে। আবার কখনো মনে হয় ওটা তার বিরামহীন কান্নার শব্দ।
শীত ঋতুতে নায়াগ্রাকে ঘিরে থাকে এক নৈসর্গিক বরফ-তুষার শোভা। তার চারপাশে তুষার জমে সাদা বরফের শহরে পরিণত হয় যেন। এর মধ্যেও সে বয়ে চলে ক্রমাগত। অতি ঠান্ডায় জমাটবাঁধা বরফগুলোকে ভেঙে নিজের বুকে বয়ে নিয়ে চলে সে। তারপরও কার্পণ্য করে না আনন্দ ছড়িয়ে দিতে পর্যটকদের মনে।
নায়াগ্রার সব থেকে বড় বাণিজ্য হচ্ছে তার স্রোতকে কেন্দ্র করে সৃষ্টি বিদ্যুৎ প্রকল্প। যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক প্রদেশ এবং কানাডার অন্টারিও প্রদেশের অধিকাংশ বিদ্যুৎ উৎপাদন হয় এখানে। অনেক কল কারখানাও সম্পূর্ণভাবে নির্ভরশীল এই বিদ্যুতের ওপর।
এক কথায়, নায়াগ্রা হচ্ছে প্রকৃতি মায়ের এক রূপসী মহতী কন্যা। কেবল তার রূপেই আকৃষ্ট হয় না মানুষ। তার রূপকে ব্যবহার করেও জীবিকা করে তারা। সে দিতে ভালোবাসে। সে জানে ত্যাগেই আনন্দ। সে তার হৃদয় চিরে বিলিয়ে দেয় স্রোত, যা তার অশ্রু হয়ে পতিত হয়, কিন্তু তা ছড়িয়ে দেয় বিস্ময়কর এক অবর্ণনীয় আনন্দ। তাইতো সেখানে চিত্রকরেরা ছবি আঁকে, পরিচালকেরা নাটক-সিনেমার শুটিং করে, লেখক লেখার পট খুঁজে বের করে, আলোকচিত্রকরেরা ছবি তুলে বিক্রি করে কিংবা প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে।
নায়াগ্রা মানুষকে স্বপ্ন দেখায়। বেঁচে থাকতে অনুপ্রাণিত করে। নিজের সৌন্দর্যকে ফুটিয়ে তুলে বিশ্বকে স্বর্গরাজ্য করে উপভোগ করতে শেখায়।
(১১ জানুয়ারি ২০১৮)
খুরশীদ শাম্মী: টরন্টো, অন্টারিও, কানাডা।