পোয়েট্রি সাময়িকী, হ্যারিয়েট মনরো ও রবীন্দ্রনাথ

যুক্তরাষ্ট্রে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তখনো অপরিচিত। গীতাঞ্জলির ছয়টি পদ্য ছাপা হলো শিকাগো থেকে সদ্য প্রকাশিত হ্যারিয়েট মনরো সম্পাদিত পোয়েট্রি পত্রিকায়। আর তা হয়ে রইল একটি ‘গাথা’। সেই থেকে কবির সঙ্গে হ্যারিয়েট মনরোর বিশেষ সম্পর্ক সৃষ্টি হলো।

পোয়েট্রি সাময়িকীর লন্ডন প্রতিনিধি কবি এজরা পাউন্ড রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে সেখানে পরিচিত হন এবং কবিতাগুলো সংগ্রহ করে মনরোকে লেখেন—তিনি পোয়েট্রির পরের সংখ্যার জন্য রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কয়েকটি কবিতা পেয়েছেন। অনুভব করছেন ভারতীয় কবির কবিতা ইংল্যান্ড ও যুক্তরাষ্ট্রে আলোড়ন সৃষ্টি করতে যাচ্ছে।

তিনি লিখলেন—‘এটি স্কুপ। ঠাকুরের জন্য পরবর্তী সংখ্যায় স্থান সংরক্ষণ করুন…।’ পোয়েট্রি পত্রিকার ১৯১২ সালের ডিসেম্বর সংখ্যায় কবিতাগুলো প্রকাশিত হয়।

১৯৩১ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ৭০তম জন্মদিনে শ্রদ্ধা নিবেদন করে বিখ্যাত ফরাসি লেখক রোমেন রোল্যান্ডের পরামর্শে ‘দ্য গোল্ডেন বুক অব ঠাকুর’ প্রকাশিত হয়েছিল। সেখানে আলবার্ট আইনস্টাইন, কোস্টেস পালামাস ও রোল্যান্ড নিজে বইটিতে ভারতবর্ষ এবং বিশ্বজুড়ে ঠাকুর কতটা সম্মানিত তা দেখিয়েছিলেন। ওই বইয়ে ঠাকুর সম্পর্কে মিস মনরো লেখেন—‘আমার মনে আছে, কবিতাগুলো যখন পৌঁছাল তখন আমরা কেমন উত্তেজিত ছিলাম। ভক্তিমূলক কবিতা খুব কমই কবিতা হিসেবে বিবেচিত হয়। তবে এগুলো ছিল সুন্দর ভক্তিমূলক কবিতা। যেখানে এমন ধর্মীয় অনুভূতি প্রকাশ করা হয়েছিল, যাতে সব জাতি ও ধর্মের সর্বজনীন ঈশ্বরের প্রতি শ্রদ্ধা প্রকাশ পেয়েছিল।’

মনরো আরও লেখেন, কিছুদিন পর দ্য শিকাগো ট্রিবিউন পত্রিকায় আন্তর্জাতিক কবিতা প্রকাশে পোয়েট্রি পত্রিকার উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়ে একটি সম্পাদকীয় ছাপে। কিছুদিনের মধ্যেই ইউনিভার্সিটি অব ইলিনয় থেকে যুবক ঠাকুরের (রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর) স্বাক্ষরিত পত্র পেলাম, ‘আমার বাবা আমার এখানে বেড়াতে এসেছেন, আমরা সাময়িকীর কয়েকটা কপি পেতে চাই, যেখানে তাঁর কয়েকটি কবিতা আছে।’ বিশিষ্ট প্রাচ্য কবি, ভারতে যার বাড়িতে আমারই থাকার কথা, তা না হলে লন্ডনে, আর তিনিই কিনা এখন আমার নিজের রাজ্যে আমার প্রতিবেশী! আমি তৎক্ষণাৎ তাঁকে আমন্ত্রণ জানিয়ে পত্র লিখলাম। নববর্ষের পরপরই ঠাকুর তাঁর পুত্র ও পুত্রবধূকে নিয়ে বেড়াতে এলেন। সেই শীতে মনে হয় তাঁরা তিন বা চারবার এসেছিলেন। এটি ছিল নোবেল পুরস্কার পাওয়ার এক বছর আগে আর তাই এসবই ছিল প্রচারণার বাইরে। সুতরাং আমরা আন্তরিকভাবে বিশ্বের কৌতূহল আর হস্তক্ষেপ ছাড়াই কবির সঙ্গে পরিচিত হওয়ার সুযোগ পেয়েছিলাম। মিস মুডির (মিস মনরোর বান্ধবী, পোয়েট্রি পত্রিকার পৃষ্ঠপোষক এবং শিকাগোতে যার বাসায় ঠাকুর পরিবার অবস্থান করেছিলেন। তিনি পরবর্তীতে রবি ঠাকুরে খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু হয়েছিলেন) ফায়ার প্লেসের পাশে উচ্চ স্বরে বাংলা অথবা ইংরেজি ভাবানুবাদ পাঠ করা হতো, আর আমরা পাশ্চাত্য থেকে আসা কোনো এক সাধুর উদার সৌন্দর্যে বিমুগ্ধ হয়ে সেই পাঠ শুনতাম। আমি তাঁকে আমার বন্ধু হিসেবে ভেবেছি; তাঁকে সর্বশেষ যখন দেখেছি তখন থেকে অনেক দিন পেরিয়ে গেলেও আমি এখনো তাঁর বন্ধুত্বের উত্তাপ ও আন্তরিকতা অনুভব করি।

হ্যারিয়েট মনরো (২৩ ডিসেম্বর ১৮৬০-২৬ সেপ্টেম্বর ১৯৩৬) একজন আমেরিকান সম্পাদক, পণ্ডিত, সাহিত্য সমালোচক, কবি এবং চারুকলার পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। ছোটবেলা থেকেই মিস মনরোর সাহিত্যের প্রতি ভালোবাসার জন্ম নেয়। তাঁর আইনজীবী বাবার পারিবারিক লাইব্রেরিই ছিল ভাই বোনে পরিপূর্ণ পরিবারে তাঁর আশ্রয় স্থল। তিনি ১৯১২ সালের প্রথম দিকে প্রকাশিত কবিতা ম্যাগাজিন, পোয়েট্রি: অ্যা ম্যাগাজিন অব ভার্সের প্রতিষ্ঠাতা প্রকাশক ও দীর্ঘ দিন সম্পাদক ছিলেন। মনরো এই সাময়িকীর মাধ্যমে বিংশ শতাব্দীর গোরার দিকে যুক্তরাষ্ট্রে কবিতার প্রচারের একটি মঞ্চ পরিচালনার মাধ্যমে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। সেই সময় মার্কিন পত্রিকাগুলো কবিতাকে তেমন গুরুত্ব দিত না। কবি হিসেবে তিনি তখন কিছুটা পরিচিতি লাভ করার পর একটি কবিতা বিষয়ক সাময়িকী বের করার উদ্যোগ নেন, অবশ্য সেই সময় গুরুত্বপূর্ণ পত্রিকা আটলান্টিক মান্থলিতে বারবার কবিতা পাঠিয়ে ছাপা না হওয়ার অভিমানও একটি কারণ। বিখ্যাত আমেরিকান কবি ওয়াল্ট হুইটম্যানের নীতিবাক্য ‘ভালো কবি পেতে হলে চাই ভালো শ্রোতা’—তাঁকে উৎসাহ জোগায়। কলম্বাসের আমেরিকা আবিষ্কারের ৪০০ বছর পূর্তিতে তাঁর রচিত একটি কবিতা নিউইয়র্ক ওয়ার্ল্ড কপিরাইট ভঙ্গ করে ছাপালে মনরো মামলা করেন এবং ক্ষতিপূরণ বাবদ ৫ হাজার ডলার পান। এই অর্থের একটি অংশ তিনি কবিতার ম্যাগাজিনের জন্য ব্যয়ের সিদ্ধান্ত নেন। তাঁকে সাহায্য করতে শিকাগোর বুদ্ধিজীবী এবং ধনাঢ্য ব্যক্তিরা এগিয়ে আসেন। মনরো তাঁর পত্রিকার জন্য প্রতি বছর ৫০ ডলার চাঁদা নিয়ে ৫ বছরের জন্য ১০০ জন গ্রাহক করেন। তিনি কবিতার জন্য একটি সম্পাদকীয় নীতিমালা ঠিক করেন যা পোয়েট্রির দ্বিতীয় সংখ্যায় ছাপা হয়—ম্যাগাজিনের নীতি হবে সবার জন্য উন্মুক্ত দরজা। আমরা যে মহান প্রতিভাবান কবিকে সন্ধান করতে চাইছি, তাঁরা কখনোই এই সাময়িকীর দরজা বন্ধ বা আধখোলা পাবেন না! এ লক্ষ্যে সম্পাদকেরা কবিতাটি আজ কোথায় লেখা হয়েছে, কে লিখেছে, বা কোন শিল্পের তত্ত্বের অধীনে রচনা করা হয়েছে তা বিবেচনা না করেই সবচেয়ে ভালো ইংরেজি কবিতাটি ছাপানোর জন্য মনোনীত করবে।

সে সময় কবি ওয়ালেস স্টিভেন্স, এজরা পাউন্ড, এইচডি, টিএস এলিয়ট, উইলিয়াম কার্লোস উইলিয়ামস, কার্ল স্যান্ডবুর্গ, ম্যাক্স মাইকেলসন প্রমুখ কবির আধুনিক কবিতা বিকাশে মনরো এবং পোয়েট্রি ভূমিকা রেখেছিল।

১৯১২ সাল থেকে এখন পর্যন্ত পোয়েট্রি শিকাগো থেকে নিয়মিত ছাপা হচ্ছে এবং যুক্ত হয়েছে অনলাইন সংস্করণ। হ্যারিয়েট মনরো ১৯৩৭ সালে তাঁর মৃত্যুর আগ পর্যন্ত এই পত্রিকার সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। এখন এর প্রচার সংখ্যা প্রায় ৩০ হাজার কপি। ২০০১ সালে পত্রিকাটি ‘লিলি’ নামের ওষুধ কোম্পানির কাছ থেকে ১০ কোটি ডলার অনুদান পায়। বর্তমানে ‘পোয়েট্রি ফাউন্ডেশন’ পত্রিকাটি পরিচালনা করে। প্রতি বছর ছাপানোর জন্য পত্রিকাটির কাছে লাখ লাখ কবিতা আসে, সেখান থেকে ৩০০ টির মতো কবিতা ছাপা হয়। পোয়েট্রিতে ছাপা কবিতার প্রতি লাইনের জন্য দেওয়া হতো দুই ডলার যা অনুদান পাওয়ার পর ১০ ডলারে উন্নীত করা হয়েছে। প্রতি বছর পত্রিকাটি লেখালেখির জন্য একাধিক পুরস্কার দিয়ে থাকে।

হ্যারিয়েট মনরো তাঁর আত্মজীবনী A Poet’s Life: Seventy Years in a Changing World-এ বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকের কবিদের সঙ্গে তাঁর চিঠিগুলো তাঁদের চিন্তাভাবনা এবং উদ্দেশ্য সম্পর্কে প্রচুর তথ্য সরবরাহ করেছেন। তাঁর মৃত্যুর দুই বছর পর বইটি প্রকাশিত হয়। সেখানে রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে হ্যারিয়েট লেখেন—ছাইরঙা-বাঙালি কুর্তা, মুখ ভরা কাঁচাপাকা দাঁড়িতে রবীন্দ্রনাথ ছিলেন প্রাচ্যের এক প্রবীণ প্রাজ্ঞজন। তাঁর চেহারার গড়ন ছিল আর্যদের মতো, গায়ের রং হিস্পানিকদের চেয়ে সামান্য কালো। মিসেস মুডির বাসার ফায়ার প্লেসের সামনে আমরা জড়ো হতাম তাঁর (রবীন্দ্রনাথের) কথা শুনতে। তিনি নিজের কবিতা পড়ে শোনাতেন, অথবা প্রাচ্যের নিয়ম-নীতির কথা শোনাতেন। মনে হতো আমরা যেন বুদ্ধের পায়ের নিচে বসে আছি। তাঁর ইংরেজি আমাদের মুখের ভাষার চেয়েও অধিক শুদ্ধ ছিল, কিন্তু আমরা সবচেয়ে বেশি ভালোবাসতাম তাঁর চড়া সুরে গাওয়া বাংলা কবিতা ও গান শুনতে। পশ্চিমা সভ্যতা বিষয়ক তাঁর কৌতুক মন্তব্য শুনতে আমাদের খুব ভালো লাগত। পশ্চিমে ধর্মকে যেভাবে জীবন থেকে বিযুক্ত করা হয়েছে, তা তাঁকে বিস্মিত করেছিল। ইংরেজদের হাতে তাঁর স্বদেশের পরাধীনতায় তিনি খুবই ক্রুদ্ধ ও বিরক্ত ছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ভারত এর আগে আরও অনেকবার বিদেশির হাতে পদাবনত হয়েছে, কিন্তু তাদের বিজয় শেষ হতে না হতেই জীবন পুনরায় পূর্বের ন্যায় স্বাভাবিক হয়ে এসেছে। কিন্তু ইংরেজের ভারত জয় ভিন্ন ব্যাপার। এটা যেন মস্ত এক লোহার হাতুড়ি, তা বারবার মানুষের চৈতন্যের ওপর আঘাত হানছে। (হ্যারিয়েট মনরো, এ পোয়েটস লাইফ, নিউইয়র্ক, ১৯৩৮, পৃষ্ঠা ৩২০-৩২১। অনুবাদ: হাসান ফেরদৌসের রবীন্দ্রনাথ, গীতাঞ্জলি ও দুই হ্যারিয়েট থেকে নেওয়া, পৃষ্ঠা ১৭০)

রবীন্দ্রনাথের নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তি সদ্য প্রকাশিত পোয়েট্রি সাময়িকীকে স্বীকৃতি এনে দিয়েছিল। মনরো তাঁর আত্মজীবনীতে এ কথা খুব গুরুত্বের সঙ্গে উল্লেখ করেছেন। কারণ পোয়েট্রিই হলো প্রথম আমেরিকান পত্রিকা যারা রবীন্দ্রনাথের কবিতা ছাপানোর জন্য গর্ব করতে পারে। তিনি বলছেন—১৯১৩ সালে সাহিত্যে রবীন্দ্রনাথের নোবেল পুরস্কার পাওয়া ছিল আমাদের জন্য বিস্ময়কর। প্রাচ্যের এই কবি যাকে আমরা গত শীতেই খুব ঘনিষ্ঠভাবে পেয়েছিলাম এবং যখন মিস মুডির অসংখ্য অতিথি তাঁর কথা এবং গান শুনেছিলেন। আমি যখন সংবাদটি দিয়েছিলাম তখন অ্যালিসের (পোয়েট্রির আরেকজন সহসম্পাদক) উত্তেজনা আমি খুব ভালো করে মনে করতে পারছি-এটা সত্যি বলে খুব ভালো লাগছিল যে, আমাদের ছোট্ট ম্যাগাজিনটি আনুষ্ঠানিকভাবে কমপক্ষে ইংরেজিতে এই এশিয়ান কবিকে ‘আবিষ্কার’ করেছিল যার নাম এখন বিশ্বজুড়ে।