পৃথিবীর পরে নীল আকাশের দেশে

মৃণাল সেন
মৃণাল সেন

বাঙালির ইতিহাসে, বাংলার সংস্কৃতির শেকড়ে আবদ্ধ থেকে, যে কয়জন নিজেকে জানান দিয়েছেন বিশ্বময় নিরহংকার ভাবে, যাদের কাজে আমাদের অহংকার জন্ম হয়; মৃণাল সেন তাঁদের মধ্যে একজন।

‘জীবনে যদি কখনো অস্বাভাবিক ঘটনা ঘটে, তবে আমরা তার মূল্যায়ন করি সিনেমার মতো বলে। কারণ, সিনেমার গল্পটা স্বাভাবিক জীবনের গল্প হবেই না, অধিকাংশ সময়ই আমাদের মাথায় তা ডিফল্ট হিসেবে সেট করা থাকে। সেই ডিফল্ট ভাবনার বাইরে গিয়ে আমরা তাই ভাবতেও চাই না। কারণ, আমরা চাই একটা নির্ঝঞ্ঝাট ও সমান্তরাল জীবন…’। কথাগুলো মৃণাল সেনের। যিনি আদর্শ বাঙালির জন্য, বর্তমানের নির্মাতাদের জন্য আর ভবিষ্যৎ নির্মাতাদের ঠিকানা।

সত্যজিৎ রায় ও ঋত্বিক ঘটকের সঙ্গে একই বন্ধনীতে উচ্চারিত হয় তাঁর নাম। এই তিনজন বাংলা চলচ্চিত্রকে সাবলীল করেছেন, বলীয়ান করেছেন। আমি অহংকারী হই জেনে, এই তিন প্রবাদপ্রতিম নির্মাতার আদিনিবাস, আমার বাংলাদেশ।

সত্যজিৎ রায় ও ঋত্বিক ঘটককে আমরা হারিয়েছি আগেই। অনেক হারানোর বেদনায় ভারাক্রান্ত দুই বাংলার ২০১৮। শুরুতেই আমরা হারিয়েছি, সুপ্রিয়া দেবীকে। তারপর একে একে সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়, অশোক মিত্র, নিরুপম সেন, নীরেন্দ্র নাথ চক্রবর্তী, দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়, রমাপদ চৌধুরী, আইয়ুব বাচ্ছু, জবা-কুসুম-রোকন-দুলনকে এতিম করে চলে গেলেন আমজাদ হোসেন এবং বছর শেষের ঠিক আগের দিন ৩০ ডিসেম্বর জীবনকে খারিজ করে অকালের সন্ধানে চলে গেলেন, রায়-ঘটক-সেন ত্রয়ীর শেষ স্তম্ভ, মৃণাল সেন।

৯৫ বছরের বার্ধক্যজনিত কারণের এই নিয়ম মেনে চলে যাওয়া হলেও এক কষ্ট থেকেই যায়। কারণ তাঁর চলে যাওয়ার মধ্য দিয়ে, বাংলা চলচ্চিত্রের, মধ্যবিত্তের প্রতিবাদী প্রতিনিধি হারাল বাঙালি।

মৃণাল সেনের ছবির চরিত্ররা উঠে এসেছেন একেবারে পাশের ঘর কিংবা পাড়া থেকে। মানুষের জীবনে আর্থসামাজিক সমস্যা যে কত গল্পের জন্ম দেয়, হাজির করে কত প্রশ্ন, তা আমরা এভাবে বুঝতাম না, যদি না মৃণাল সেন চোখ রাখতেন ক্যামেরার পেছনে।

১৯৫৫ সালে অর্থাৎ যে বছর ভারতীয় সিনেমার গতিপথ পাল্টে দিলেন সত্যজিৎ রায় পথের পাঁচালি দিয়ে, যে বছর তিনি বাঙালিকে রুপালী পর্দায় প্রথম বৃষ্টি দেখালেন, সে বছরই মৃণাল সেন তৈরি করেন প্রথম ছবি ‘রাত ভোর’। অভিনয় করেন উত্তম কুমার, সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায় ও ছবি বিশ্বাস। কিন্তু ছবি হিসেবে তা ব্যবসা সফল হতে পারেনি। বিভিন্ন ইন্টারভিউতে তিনি বলেছেন, রাত ভোরকে তিনি মনে রাখতে চান না।

মৃণাল সেন পরিচালিত প্রথম কোনো ছবিকে যদি তিনি মনে রাখতে চান, তা হলো নীল আকাশের নিচে। মৃণাল সেন পরিচালিত দ্বিতীয় ছবি। প্রযোজনা ও সংগীত পরিচালনা করেন আরেক বাঙালি কিংবদন্তি হেমন্ত মুখোপাধ্যায় ও গীতিকার গৌরিপ্রসন্ন মজুমদার। বাঙালি পেল চিরকালের গান ‘ও নদীরে একটি কথা শুধাই শুধু তোমারে, বলো কোথায় তোমার দেশ, তোমার নেই কি চলার শেষ’। কিন্তু বিতর্কিত রাজনৈতিক ছবির তকমা লেগে যাওয়াতে, ছবিটিকে নিষিদ্ধ করা হয় তখন। যদিও অবশেষে ছবিটি মুক্তি দেওয়া হয় ও প্রশংসিত হয়। কথিত আছে তৎকালীন ভারতের প্রধানমন্ত্রী জওহর লাল নেহরু রাষ্ট্রপতি ভবনে মৃণাল সেন ও হেমন্ত মুখোপাধ্যায়কে নিয়ে নীল আকাশের নিচে ছবির স্পেশাল স্ক্রিনিং করেন এবং রাষ্ট্রপতি ছবিটির ভূয়সী প্রশংসা করেন।

১৯৬০ সালে বাইশে শ্রাবণ নিয়ে ফিরে এলেন আত্মবিশ্বাসী মৃণাল সেন। শুরু হয় মৃণাল সেনের জয়যাত্রা। এই ছবিই প্রথম তাঁকে আন্তর্জাতিক খ্যাতি এনে দেয়।

আবদুর গোপাল কৃষ্ণনের মতে ১৯৬০ সাল থেকেই সত্যজিৎ রায়, ঋত্বিক ঘটক ও মৃণাল সেনের হাত ধরে ভারতে সমান্তরাল সিনেমা এক আন্দোলনের বীজ বপন করে। এই তিনজনের কাজের ধারায় তিন ধরনের দৃষ্টিকোণ লক্ষ্য করা যায়। তার মধ্যে মৃণাল সেন যেন মেকিংয়ের দিক দিয়ে বেশ কিছুটা আলাদা।

১৯৬৯ সালে নির্মিত হয় ভুবন সোম। এক আমলা ও একটি সরল গ্রাম্য মেয়ের এই গল্প দর্শকের মন ছুঁয়ে যায় যেমন, তেমনই মৃণাল সেন পান তার প্রথম রাষ্ট্রীয় পুরস্কার। আজকের জীবন্ত কিংবদন্তি বিগ বি অমিতাভ বচ্চন, ভয়েস ওভার আর্টিস্ট হিসেবে কাজ করেছেন ভুবন সোম ছবিতে। পারিশ্রমিক পান তিন শ রুপি।

তবে কলকাতা তথা ভারতবর্ষের ঝোড়ো সময়ের ইতিকথা ধরা পড়েছে তাঁর কলকাতা ’৭১, পদাতিক ও কোরাসে। উত্তাল রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট ও নিম্নবিত্ত, মধ্যবিত্ত মানুষের নানা টানাপোড়েন, সংকট ও মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর লড়াই মৃণালের সেনের সিনেমাকে সমৃদ্ধ করেছে।

আজকের যিনি ফাটা কেষ্ট, এক সময়কার ফিল্ম ইনস্টিটিউটের রোগা কিন্তু আগুন চোখা, গৌরাঙ্গ চক্রবর্তী মানে দাদা মিঠুন চক্রবর্তী ও মৃণাল সেনের আবিষ্কার। প্রবাদপ্রতিম দুই শিল্পী অমলা শংকর ও উদয় শংকরের কন্যা মমতা শংকর আর মিঠুন চক্রবর্তীকে পরিচিত করান মৃগয়াতে। যে ছবিতে মিঠুন চক্রবর্তী রাষ্ট্রপতি পুরস্কার পেয়েছেন। মৃণাল সেনের হাত ধরেই অভিনেতার ইন্টারভিউতে উত্তীর্ণ হন রঞ্জিত মল্লিক।

তাঁর ছবির চরিত্ররা তুলে ধরে আপনার আমার চেনা মুখ, অচেনা আপসকেই। একদিন প্রতিদিন, আকালের সন্ধানে, খারিজ বা খণ্ডহর সেই সময়ের প্রেক্ষাপটে উন্মুক্ত করে দেয় মানুষের বিপন্নতাকে।

মহান চিত্র পরিচালক হিসেবে বৈশ্বিক পরিচয়ের বাইরে তাঁর আরও একটি পরিচয়, তিনি ১৯৯৭ থেকে ২০০৩ সাল পর্যন্ত রাজ্যসভায় সাংসদ ছিলেন। সেই সময় লোকাল এরিয়া ডেভেলপমেন্ট ফান্ড থেকে সাহায্য দিয়ে, আক্ষরিক অর্থে আলো জ্বালিয়েছিলেন পশ্চিমবঙ্গের দুটি ছোট গ্রামে। সরকার ডাংগা আর বল্লভপুর ডাংগা—৩৫০টি পরিবারের ঘরে-ঘরে আলো পৌঁছিয়ে দিতে সাহায্য করেন।

লেখক
লেখক

মৃণাল সেনের মৃত্যুর পর, ওই গ্রাম দুটিতে মৃত্যু সংবাদ পৌঁছালে, ওই গ্রামের এক বাসিন্দার ভাষ্য, মৃণাল সেন কত বড় পরিচালক তা আমি জানি না, তাঁর কোনো ছবিও আমি দেখিনি, তবে মৃণাল সেন তিনিই যিনি আমাদের মাঝে আলো এনে দিয়েছেন, তাঁর আত্মার শান্তি কামনা করি।

তাঁর শেষ ইচ্ছা ছিল, মৃত্যুর পর যেন তাঁর মৃতদেহ ফেলে রাখা না হয়। সরকারিভাবে ভাবে মালা পরানো না হয়। খুব সাধারণ মধ্যবিত্তের মতোই বিদায় নিলেন এই অসাধারণ মানুষটি। তাঁর শেষ ছবি ছিল আমার ভুবন। অভিনয় করেন নন্দিতা দাস; যিনি বর্তমান সময়ের একজন বিখ্যাত চিত্রনির্মাতা।

আমার ভুবন থেকে মৃণাল সেন এখন অন্য ভুবনে। তবে একটা দুঃখ তিনি নিয়ে গেলেন, তাঁর পরিচালিত অনেক ছবির অরিজিনাল ক্যামেরা প্রিন্ট কোথাও পাওয়া যাচ্ছে না। এর মধ্যে আমার ভুবন ও পুনশ্চ উল্লেখযোগ্য। কারণ সংরক্ষণের অভাব, কথাগুলো বলেছিলেন নন্দিতা দাস। একই কথা বলেছেন শিবেন্দ্র দুংগারপুর। একজন ফিল্ম সংরক্ষণবিদ হিসেবে তিনি বলেন, মৃণাল সেনের প্রতি সত্যিকার শ্রদ্ধা জানানোর উপায় হলো, তাঁর ফিল্মগুলো সংরক্ষণ করা, অনাদরে হারিয়ে যেতে না দেওয়া, তবেই আমরা তাঁকে খুঁজে পাব তাঁর কাজে, তাঁর সিনেমায় দিনে দিনে প্রতিদিনে।

পৃথিবীর পরে ওই নীল আকাশে ভালো থাকুন মৃণাল সেন।

তথ্যসূত্র: হঠাৎ যদি উঠল কথা এবং মৃণাল সেন বায়োগ্রাফি।
...

হিমাদ্রী রয় সঞ্জীব: সাংস্কৃতিক কর্মী, টরন্টো, কানাডা।