পূর্ব লন্ডনে সংহতির গ্রন্থমেলা

উদ্বোধনী অনুষ্ঠান
উদ্বোধনী অনুষ্ঠান

বিলেতপ্রবাসী বাংলাদেশি লেখকদের বই নিয়ে এই প্রথম লন্ডনে অনুষ্ঠিত হলো সংহতি গ্রন্থমেলা। ৮ মে রোববার পূর্ব লন্ডনের ব্রার্ডি আর্ট সেন্টারে এই গ্রন্থমেলা পরিণত হয়েছিল বিলেতের লেখকদের মিলনমেলায়। বইয়ের টানে লন্ডনের বাইরের শহরগুলো থেকেও অনেক লেখক, পাঠক নির্ধারিত সময়ের আগেই হলে উপস্থিত হয়েছেন। যা অন্যান্য মেলায় সচরাচর চোখে পড়ে না। গ্রন্থমেলার আয়োজক সংগঠন সংহতি সাহিত্য পরিষদ।

সাংস্কৃতিক পরিবেশনা
সাংস্কৃতিক পরিবেশনা

বেলা ৩টা থেকে রাত নয়টা পর্যন্ত চলা গ্রন্থমেলায় ছিল বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠানমালা। আলোচনা, প্রকাশিত বইয়ের মোড়ক উন্মোচন ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। তিন পর্বের অনুষ্ঠান সঞ্চালনায় ছিলেন কবি ইকবাল হোসেন, ছড়াকার রেজুয়ান মারুফ ও কবি আনোয়ারুল ইসলাম।

সাংস্কৃতিক পরিবেশনা
সাংস্কৃতিক পরিবেশনা

মেলায় অতিথি হিসেবে আলোচনায় অংশ নেন বিশিষ্ট সাংবাদিক-কলামিস্ট আবদুল গাফফার চৌধুরী, কবি-গবেষক কাদের মাহমুদ, কবি-কথাসাহিত্যিক সালেহা চৌধুরী, কবি-কথাসাহিত্যিক মাসুদ আহমদ, সাংবাদিক-গবেষক ইসহাক কাজল, চ্যানেল আই ইউরোপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সাংবাদিক রেজা আহমদ ফয়সল চৌধুরী। সভাপতিত্ব করেন সংহতি সাহিত্য পরিষদের সভাপতি কবি ফারুক আহমেদ।
এর আগে সংহতির কর্মকর্তারা অতিথিদের নিয়ে বেলুন ফেস্টুন উড়িয়ে মেলার শুভ উদ্বোধন করেন।
মেলায় বিলেতের ১২০ জন লেখকের বই স্থান পায়। এ ছাড়া অতিথিদের নিয়ে ২০১৬ সালে প্রকাশিত বিলেতপ্রবাসী ২১ জন লেখকের বইয়ের মোড়ক উন্মোচনের আয়োজন করে সংহতি।

বইয়ের স্টল
বইয়ের স্টল

আলোচনা পর্বে প্রধান অতিথি আবদুল গাফফার চৌধুরী বলেন, বিলেতে বিশেষ করে লন্ডন, বার্মিংহাম ও ম্যানচেস্টার থেকে অনেকগুলো বাংলা পত্রিকা প্রকাশিত হয়। নিয়মিত সাহিত্যচর্চা ও উৎসব হচ্ছে বিভিন্ন শহরগুলোতে। সংহতি গ্রন্থমেলা বিলেতে লেখক-পাঠকদের মাঝে সংহতি অটুট রাখতে অগ্রণী ভূমিকা রাখবে। বিলেতবাসী অনেকে ভালো লেখেন। আমার মনে হয়, তারা যদি বাংলাদেশে বসে সাহিত্যচর্চা করতেন তাহলে পাঠক তাদের সম্পর্কে অনেক বেশি জানতে পারত, লেখক হিসেবেও তাদের স্থান অন্যভাবে মূল্যায়িত হতো।
বিশেষ অতিথি লেখক-গবেষক মাসুদ আহমদ বলেন, আমার একটি সংজ্ঞায় ভীষণ আপত্তি আছে, প্রবাসী বলতে পারেন, কিন্তু সাহিত্যিকদের কোনো সংজ্ঞা নেই। তিনি যে কোনো জায়গার হতে পারেন। তিনি গাছের নিচে বসে, পার্কে, ঘরে বসেও লিখে থাকতে পারেন। সাহিত্যের জন্য বিশেষ কোনো সংজ্ঞার প্রয়োজন নেই। তিনি সংহতির উদ্দেশ্যে বলেন, এই সুপেয়, সুদর্শন দালানটি আমাদের মিলিত হওয়ার। সংহতির যাত্রায় আমরা সব সময় আছি। এই বৃদ্ধ বয়সে তোমাদের কোনো কাজে আসতে পারি, সেটিও আমরা চেষ্টা করব।

বইয়ের স্টল
বইয়ের স্টল

কবি লেখক কাদের মাহমুদ বলেন, বিলাতে অনেক লাইব্রেরি আছে। কিন্তু সেখানে বাংলা বই ও তার পাঠক কোথায়? এই দেশে অনেক ভাষাভাষী লেখকদের বই পাবেন লাইব্রেরিগুলোতে কিন্তু আমাদের বাংলা বইয়ের আকাল আছে। তার মানে হচ্ছে বাংলা বইয়ের পাঠকের আকাল। এখানে অনেকেই আছেন, পরিচয় দেন শিক্ষিত বাঙালি। কিন্তু তাদেরও বই পড়তে দেখি না। পত্রিকা পড়েন না, বাংলা পত্রিকা তো পড়েনই না। তারা কি করেন তারাই জানেন! বিলেতে বাংলা বইয়ের সবচেয়ে বড় আমদানিকারক রূপসী বাংলা এখন বিলুপ্তির পথে। সংহতি গ্রন্থমেলাতে ১২০ জন লেখকের বই এসেছে, এটা আমাদের জন্য অনেক বড় বিষয়। সংহতিকে ধন্যবাদ।
কথাসাহিত্যিক সালেহা চৌধুরী বিশেষ অতিথির বক্তব্যে বই কেনার প্রতি আমাদের অনীহার কথা উল্লেখ করে নিয়মিত সাহিত্য-সংস্কৃতিচর্চা ও এর প্রচারের প্রতি গুরুত্ব দিয়ে বলেন, গ্রন্থমেলাটি ধারাবাহিকভাবেই চালিয়ে যেতে হবে। আমাদের বিশ্বাস সংহতি গ্রন্থমেলা ধারাবাহিকভাবে চালিয়ে যাওয়ার সকল যোগ্যতা সংহতি রাখে। বই পড়া ও কেনায় আমরা লেখকেরা আরও উদ্যমী হওয়ার জোরালো দরকার আছে।
বিশিষ্ট সাংবাদিক, গবেষক ইসহাক কাজল বলেন, সংহতির কাছে আমার একটি অনুরোধ থাকবে-ব্রিকলেনে অনেকগুলো বইয়ের দোকান ছিল। একমাত্র দাঁড়িয়ে থাকা সংগীতা কত দিন বেঁচে থাকবে জানি না। কাজেই সংহতির পক্ষ থেকে একটি বুকসপ খোলা যায় কিনা ভেবে দেখবেন। যদি সম্ভব হয়-আমি সামান্য লেখক হিসেবে সর্বাত্মক সহযোগিতায় থাকব।

আলোচনা অনুষ্ঠানে অতিথিদের একাংশ
আলোচনা অনুষ্ঠানে অতিথিদের একাংশ

চ্যানেল আই ইউরোপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সাংবাদিক রেজা আহমদ ফয়সল চৌধুরী বলেন, বিলেতে এত লেখক সমাবেশ আমাদের উজ্জ্বলতর ভবিষ্যতের স্পষ্ট ইঙ্গিত বহন করে। যারা বিলেতের সাহিত্যচর্চা নিয়ে উন্নাসিকতায় ভোগেন, আলোকিত কর্মগুলো খালি চোখে দেখতে চান না বা পারেন না, তাদের এই ধরনের মেলায়, নবীন প্রবীণ লেখকদের মিলন উৎসবে আসা উচিত। তাহলে ধারণার বৃত্ত থেকে বেরিয়ে সরাসরি দেখে পড়ে সমালোচনাটা করতে পারবেন। অতীতের মতো চ্যানেল আই ইউরোপ সাহিত্য ও সংস্কৃতিবান্ধব থাকার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে।
সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে আবৃত্তি করেন আবৃত্তি শিল্পী উর্মি মাযহার, দিলু নাসের, রেজুয়ান মারুফ, মুনিরা পারভিন, সালাউদ্দিন শাহীন, জিয়াউর সাকলেন। মৌলিক গানে দর্শকদের মুগ্ধ করেছেন শাহিনুর হীরক, শতরুপা চৌধুরী ও নতুন প্রজন্মের শিল্পী মহিমা।
২০১৬ সালের একুশে বইমেলায় বিলেতবাসী লেখকদের চল্লিশটির বেশি বই প্রকাশিত হয়েছে। সংহতি ২১ জন লেখকের বইয়ের মোড়ক উন্মোচনের আয়োজন করেছে গ্রন্থমেলাকে সামনে রেখেই। বিলেতের বিভিন্ন শহরে ছড়িয়ে থাকা শতাধিক লেখকদের গ্রন্থমেলায় সম্পৃক্ত করতে সংহতি সক্ষম হয়েছে। এবং নিকট ভবিষ্যতে ইউরোপের লেখকদেরও সম্পৃক্ত করা হবে। সংহতির পরিকল্পনার কথা বলেন সংগঠনের সাংগঠনিক সম্পাদক কবি সাংবাদিক আনোয়ারুল ইসলাম।
প্রায় সাতাশ বছরে পা দেওয়া সংগঠনের বাংলা ভাষা, সাহিত্য সংস্কৃতিবান্ধব কর্মকাণ্ড তুলে ধরেন সংগঠনের যুগ্ম সম্পাদক কবি তুহিন চৌধুরী।
প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে বিষয়ভিত্তিক বইসহ অন্যান্য প্রকাশনা ও মৌলিক কর্মকাণ্ড এর সংক্ষিপ্ত চিত্র তুলে ধরেন সাহিত্য সম্পাদক কবি শামীম শাহান। স্বাগত বক্তব্য রাখেন কবি এ কে এম আবদুল্লাহ।
উল্লেখ্য সংহতি ১৯৮৯ সাল থেকে বিলেতে বাংলা ভাষা, সাহিত্য সংস্কৃতি এবং বহু ভাষাভাষী লেখক ও সংগঠকদের সঙ্গে কাজ করছে। দেশের বাইরে ধারাবাহিক বড় কবিতা উৎসবের সঙ্গে সংহতির বিলেতের সাহিত্যপাড়ায় এইবার যোগ করল আরেকটি সৃজনশীল পালক সংহতি গ্রন্থমেলা। আগামী বছর থেকে ইউরোপে বসবাসকারী বাংলাভাষী লেখকদেরও এই মেলায় সম্পৃক্ত করা হবে বলে সংহতি সাহিত্য পরিষদের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে।