পিতা-মাতা ভাঙা ছাতার মতো হলেও তার ছায়াতলে শান্তি থাকে
আজ যে সন্তানের পিতা-মাতা উভয়ে জীবিত আছেন, সে সন্তান পরিপূর্ণ ছাতার ছায়াতলে শান্তিতে আছে। যেকোনো বাধাবিপত্তি সেই সন্তানের কাছে তুচ্ছ মনে হয়। যাদের পিতা-মাতা কেউ জীবিত নেই, তাদের মাথার ওপর তীব্র খরা বিরাজ করে সব সময়। পিতা-মাতারা যদি পুরোনো ছাতার মতো হন, তবু সেটার নিচে ছায়া থাকে। স্নিগ্ধ শীতল ছায়া। যে ছায়ার ঋণ সন্তান সারা জীবনে তিল পরিমাণ পরিশোধ করতে পারে না।
যার পিতা-মাতার একজন পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছেন, তার ছাতা অর্ধেক। সে অর্ধেক ছাতার ছায়াতলে সম্পূর্ণ ছাতার সুখ খুঁজে নেয়। যত ঝঞ্ঝা আসুক, সন্তান সেই অর্ধেক ছাতার নিচেয় আশ্রয় নিয়ে প্রশান্তি পায়। দুর্দিনে নিরাপদ অনুভব করে।
যে সন্তানের পিতা-মাতা কেউ জীবিত নেই, সেই সন্তান যত বড় ধনী এবং সুখী হোক, নীরবে পিতা-মাতার জন্য চোখ দুটি মহাসাগর হয়ে যায়। হোক সে পিতা-মাতা বৃদ্ধ অথবা অচল।
আমি আজ অর্ধেক ছাতার ছায়াতলে বেঁচে আছি। ছোটবেলায় বাবাকে হারিয়েছি। তারপর কত ঘাত-প্রতিঘাতে অর্ধেক ছাতার ছায়াতলে বেঁচে আছি আজও। যত দিন পার করেছি, তত চিনেছি মানুষ। জেনেছি মানুষের আচরণ। সময় যখন মুখ ফিরিয়ে নেয়, তখন শত চেষ্টা করেও কোনো কোনো জনকে তৃপ্ত করা যায় না। আমার ছাতাটা এখন প্রায় পুরোনো। এই অর্ধেক পুরোনো ছাতা যেদিন পৃথিবী থেকে বিদায় নেবে, সেদিন আমার মতো নিঃসঙ্গ আর কেউ হবে না। ইদানীং নিঃসঙ্গ হয়ে যাওয়ার ভয় বুকের মধ্যে হাতুড়ি পেটাচ্ছে বারবার।
বাবার মৃত্যুর পর মা আমাকে অনেক কষ্ট করে লালন-পালন করেছে। তার কষ্ট আমি নিজের চোখে দেখেছি। সে কী করুণ কষ্ট ছিল। সংসারের বইঠা সে নিজের হাতের মুঠোয় দুঃসময়ে শক্তভাবে ধরে ছিল। অভাবের তাড়নায় অল্প দামে মা চালের খুদ কিনত আমাদের জন্য। তরকারি কেনার সামর্থ্য হতো কম। মাছ-মাংসের নাম শুনে তৃপ্ত হতাম। মা খুদ কড়াইতে ভেজে আমাদের ভাইবোনকে খেতে দিত। আমরা দুই ভাই-বোন মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে খুদভাজি খেয়ে খুব সুস্বাদ অনুভব করতাম। মনে হতো বেহেশতি খাবার।
আমাদের মাঝারি আকারের একটা পেয়ারাগাছ ছিল। খুব সুস্বাদু পেয়ারা হতো সেই গাছে। মাঝেমধ্যে যখন ঘরে চালের খুদ না থাকত, তখন মা আমাদের পেয়ারা খেতে দিত। গাছটায় বারো মাস পেয়ারা হতো। এটা হয়তো আল্লাহর কুদরত। একদিক দিয়ে তিনি মারলেও আরেক দিক দিয়ে বাঁচিয়ে রাখেন। পেয়ারাগাছটা ছিল আমাদের সংসারের একজন সদস্যের মতো। আমরা গাছটির খুব যত্ন নিতাম।
যাদের পিতা-মাতা জীবিত, তারা হয়তো অনুভব করতে পারে না পিতা-মাতা না থাকার যন্ত্রণা। পিতা-মাতা যতই পুরোনো ছাতার মতো হোক, সেটা দুঃসময়ে মনে প্রশান্তি দেয়। যেদিন পিতা-মাতার একজন অথবা দুজনে চিরবিদায় নেবেন পৃথিবী থেকে, সেদিন সন্তান বুঝতে পারে পিতা-মাতার শূন্যস্থানের অভাব।
আমার অর্ধেক ছাতা ছোটবেলায় হারিয়েছি। বাকি অর্ধেক ছাতার ছায়ায় এই পর্যন্ত টিকে আছি। সেই মা নামের ছাতাটিকে গত কয়েক দিন আগে স্ট্রোক নামের ঘাতক দানব আক্রমণ করেছিল। জ্ঞান হারিয়ে মা আমার পড়ে গিয়েছিল মেঝেতে। প্রতিবেশীর সহযোগিতায় চিকিৎসক অক্সিজেন দিয়ে এক ঘণ্টা পর তার জ্ঞান ফেরাতে সক্ষম হন। এই দূর পরবাসে থেকে তার জন্য হৃদয়ে খুব ব্যথা অনুভূত হয়। সেই অর্ধভাঙা পুরোনো ছাতার ছায়াতলে যাওয়ার প্রতীক্ষায় দিন যেন আর কাটে না।
পরিপূর্ণ যৌবনে এসে আজ মনে হলো, পিতা-মাতা যতই খারাপ অথবা নিকৃষ্ট হোক, তাঁদের মতো আপন আর কেউ নেই পৃথিবীতে। পিতা-মাতার মতো সন্তানকে আর কেউ ভালোবাসতে পারে না। সমস্ত পৃথিবীর মানুষ স্বার্থের জন্য দূরে চলে যাবে একদিন, পিতা-মাতা তবু সন্তানের পাশে থাকেন দুর্বোধ্য পথের বাধা পেরিয়ে আলো দেখাতে। ঈশ্বর পিতা-মাতার হৃদয়ে ছাড়া আর কারোর হৃদয়ে সন্তানের জন্য বিন্দু পরিমাণ যত্নে গড়া ভালোবাসা দেননি। যখন সন্তানের পাশে কেউ থাকে না, তখন পিতা-মাতা থাকেন পরম মমতায় শান্ত ছায়া হয়ে। পেটে ক্ষুধা থাকলেও শান্তি অনুভব হয় তখন। নিজেকে সেরা সুখী ও শ্রেষ্ঠ ধনী মনে হয়।
পিতা-মাতা হারানো পৃথিবীর সব দুর্ভাগা সন্তান ভালো থাকুক। ভালো থাকুক সব পিতা-মাতা।