পিঠা উৎসব

শীত আসে। সেই সঙ্গে হাজির হয় পিঠা উৎসব। এ সময় টাটকা চালে তৈরি করা হয় বাহারি পিঠা পুলি। পিঠার সেই মৌ মৌ গন্ধ ছড়িয়ে পড়ে মূলত ঋতুর প্রথম ভাগ থেকে। এ গেল দেশ–প্রাণের কথা। শহরে কিংবা প্রবাসেও নরনারীরাও এই আয়োজন থেকে বিচ্ছিন্ন থাকতে চান না। তারা ছেলেমেয়ে বা প্রিয়জনদের সামনে আনেন মুখরোচক সব পিঠা। সংযুক্ত আরব আমিরাতেও পর্বটি সে কারণে আনুষ্ঠানিকতায় রূপ নেয়।
গোলায় ধান তোলার পর গ্রাম ভাসে আনন্দের বন্যায়। ধান কাটা ও গোলায় ভরার এ উৎসব নতুন এক খবর দেয় জনপদে। সে বার্তায় থাকে পিঠার আমন্ত্রণ। শীতের সকালে খেজুর রসের স্বাদই আলাদা। সে রসে ভেজানো চিতই পিঠার ঘ্রাণ টানে পাড়ার মানুষকে। এখানে রস নেই তবে দেশ থেকে আসা পাটালি গলিয়ে আসল স্বাদ পাওয়ার বিকল্প ব্যবস্থাও কারও আয়ত্তের বাইরে নয়।

অধ্যাপক নূরুন্নাহার হুদা ঠিকই বলেছেন, ধানে ভরে যায় বাড়ি। এ সময়ে প্রকৃতির আরেক দান খেজুরের রস। স্কুল ছুটি হয়ে যায়। মামা বাড়ি বেড়ায় ছোটরা। পিঠার ধুম পড়ে যায়। এটা শাশ্বত বাংলার ছবি। শহরে এই আনন্দ পাওয়া দুষ্কর। সেই নদী, সেই প্রকৃতি, কোথায় মিলবে! তিনি একটু দম নিয়ে বলেন, তারপরও এর প্রভাব থেকে মুক্ত থাকা যায় না। এটা রক্ত মাংসে জড়ানো যে!
বাঙালিরা চিরকালই অতিথি পরায়ণ। সামাজিক বন্ধনটিও শক্ত তাদের। কাউকে না বলে তারা খায় না। সবাই মিলে এক জায়গায় হবে। খাবে, আনন্দ করবে-সে আনন্দের ভাগ সবাই পাবে। এ জন্যই শীতে তাদের আয়োজন। আবুধাবিতে অবস্থানরত মিতা কুণ্ডু সেই বার্তাটিই দিলেন। বাঙালির ঐতিহ্যকে ধরে রাখার জন্য প্রতি বছরই পিঠা উৎসব হয়ে থাকে। তিনি বলেন, একই ধারাবাহিকতায় এই প্রবাসেও যথারীতি চালু এই পিঠা সংস্কৃতি।

কী সুন্দর করেই না নারীরা তাদের কাছের মানুষগুলোকে পিঠা পরিবেশন করেন। এটাই তাদের সৌন্দর্য! দেশের মতো বাংলার এ চেহারাটা এখানেও অমলিন। মাঠে কিংবা ঘরে তারা এই অনুষ্ঠানে শামিল হন। ফেসবুকেও কেউবা তুলে ধরেন কারও পিঠা আয়োজনের দৃশ্যটি। আজমেরী বেগম এর মধ্যে একজন। পিঠা তৈরি এবং তা ছোটদের মুখে তুলে দেওয়ার মুহূর্তটি পর্যন্ত তিনি সামাজিক এই মাধ্যমটিতে পোস্ট করেছেন।
পিঠামেলায় স্মৃতিচারণ করা হয়। স্মৃতিময় দিনগুলো কাউকে কুড়ে কুড়ে খায়। দুষ্টু ছেলের দল খেত থেকে আলু চুরি করে নাড়ার আগুনে পুড়িয়ে খেয়েছে। সেই তাদের মধ্যেকার দুই–এক সদস্যও এখানে তার নাম ফাঁস করেন। শিম পুড়িয়ে খাওয়ার কী যে মজা! জসীমউদ্দীনের নিমন্ত্রণ কবিতাটি জীবন্ত হয়ে ওঠে সবার সামনে। রাস্তার খাদে পোলো নিয়ে কিলবিল করা ডান কানা মাছ ধরবার গল্পও সে বেলায় বাদ পড়ে না। আহা কী আনন্দ!
সুমনা রহমান। সামাজিক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের জনপ্রিয় উপস্থাপক। তিনি বলেন, পিঠা উৎসবের মধ্য দিয়ে আমরা আমাদের বাঙালিত্বকে খুঁজে পাই। নতুন প্রজন্মকে বাঙালি সংস্কৃতির সঙ্গে রাখছে এমন প্রচেষ্টা। সেই লক্ষ্য থেকে অনুষ্ঠান চলে নিরন্তর।

শীতের মধ্যেই জীবনানন্দ কড়া নাড়েন। হিমের রাতে শরীর ওম রাখার জন্য দেশোয়ালিরা সারা রাত মাঠে—এমন খবর পান গ্রামের মানুষ। কিংবা বসে যান বরিশালের সেই সন্তান, ধান সিঁড়ি নদীর কিনারে আমি শুয়ে থাকব ধারে পৌষের রাতে। তাহলে পল্লিবাসীরা এ ক্ষেত্রে কী করতে পারেন! সেই কথাগুলোই আলোচনায় আসে। বাংলা মায়ের অবয়ব ভেসে ওঠে। ঘরের কাছ থেকে এক ফালি জমিনে কৃষক বধূ সযত্নে আগলে রাখেন সবজির বাগান। ফুলকপি, গাজর, শিম, পালং, ধনেপাতা—কী নেই সেখানে!
আবুধাবি, দুবাই কিংবা শারজাহ-কোথাও বাংলার চিরায়ত রাখালের দর্শন মেলা ভার নয়। কেউ একজন অকপটে বলেন, তিনি খেতের আইলে বসে খেজুরের গুড় দিয়ে মুড়ি মেখে অমৃতের স্বাদ পেয়েছেন। কথা চলে। বাড়ি থেকে নেমে যাওয়া মেঠো পথ সামনের দিগন্তের সঙ্গে মিশে কেমন একাকার হয়ে যায়। ওখানে আকাশ দেখেছে মাটির পৃথিবীতে। শীতে সেই রহস্যময়তা বাড়িয়ে দেয়। কবি মনের প্রবাসী এক এইভাবে সেই কাতারে ফেলেন নিজেকে। গল্প এগিয়ে যায় চমৎকার বাঁধুনিতে।
এক নারী বলেন, শীতের সকালে পিঠা ভোজনের কাহিনি। পলি রানি পোদ্দার দুবাইয়ের বাসিন্দা। ঘরকন্না করেন। তিনিও তৈরি করেন পিঠা, এই এখানে। ছোটবেলায় গোল হয়ে বসে পিঠে রোদ ঠেকিয়ে তারা যেতেন পৌষের পিঠা। বাড়ির বৌদিরা এনে দিত সে সব এক এক ঘর থেকে। তারা হয়ে যেতেন যৌথ পরিবারের সদস্য। জায়ে জায়ে সম্পর্কের নবায়ন হতো। সেই উষ্ণতায় পরিবেশ হয়ে উঠত মধুময়। তরুণী এই মা বলেন, গ্রামে এখনো এই চিত্রটির দেখা মেলে। এই দুবাই থেকে গিয়েও তিনি সেই রোদ, সেই সকাল, সেই পিঠার মুহূর্ত উপভোগ করেছেন।

নাশেতা নাহরির তানিয়া পিঠা তৈরির শৈল্পিক দিকটির ওপর গুরুত্ব দেন। তিনি বলেন, পিঠা তো প্রয়োজন পড়ে একটি উন্নত মনের। অন্তরে ভালোবাসা, আবেগ বা সুকুমার বৃত্তি না থাকলে কী নকশা করা এমন পিঠা হতে পারে। গুড়, চালের গুঁড়ি, নারকেল-তিন সহজলভ্য উপাদানে মনের মাধুরী মিশিয়ে গ্রাম বধূরা পিঠা বানান। এর পর দুধ রসে ছেড়ে একে করা হয় অমৃত। উন্নত মূল্যবোধ ও সংস্কৃতির জন্যই এমনটি সম্ভব। তানিয়া বলেন, এই আবুধাবিতে দেখি অনেক রমণীর এ রকম রুচি ও গুণের পরিচয় দেন। তাদের প্রতি তার আছে অনেক বিস্ময়, বলেন তিনি।
এত কিছুর ওপর আলোকপাত! সময় কী বসে থাকবে? কারও জন্য নয়। তাই তো তরুণী মায়েরা যার যার আয়োজন উপস্থাপন করেন টেবিলে।
চিতই পিঠা বুঝি উঠেই যেতে চায়। কিন্তু দু-একজন আছেন যারা এটা হতে দিতে চান না। প্রচলিত পিঠার মধ্যে পাটিসাপটা, পুলি বাদ পরে না। পাতা পিঠা, ঝাল পিঠা, নারকেল পিঠা, ভাঁপা পিঠা বানিয়েছেন কেউ কেউ। কেউ আবার নকশা পিঠা, ঝিনুক পিঠা, জামদানি পিঠা তৈরি করেছেন। সূর্যমুখী, গোলাপি-এত পিঠার নাম। দুধপুলি, রসপুলি, দুধরাজ আনা হয়েছে। সন্দেশ, আন্দশা, মালপোয়া, পাজোয়া-কী সুন্দর সুন্দর নাম! পিঠা মুখে তোলেন সবাই। বেগম সুফিয়া কামালকে মনে পড়ে। পৌষ মাসের পিঠা খেতে বসে, খুশিতে বিষম খেয়ে/আরো উল্লাস বাড়িয়াছে মনে, মায়ের বকুনি পেয়ে।
বড়দের কথাই বলা হলো। নতুনরা, নতুন প্রজন্ম! না, অমৃতের স্বাদ তাদের জিহ্বায়। অজস্র তৃপ্তি তাদের। আকাশছোঁয়া আনন্দ। এই উল্লাস বহাল থাকুক। পৌষ পার্বণ জ্বলজ্বল করুক সবার অন্তরে।