পাহাড়, সমুদ্র আর অরণ্যের ঐকতান

নাজ দ্বীপছবি: লেখক
ভ্রমণের জন্য বিনিয়োগ হচ্ছে নিজের জন্য বিনিয়োগ
ম্যাথু কার্স্টেন

কবির মতো আমার মনেও সর্বক্ষণ বেজে ওঠে একই সুর, একই ধ্বনি, ‘বিশ্বজোড়া পাঠশালা মোর সবার আমি ছাত্র, নানানভাবে নতুন জিনিস শিখছি দিবারাত্র’। তাই এই বিদেশ-বিভুঁইয়েও মন আমার সারাক্ষণ ছুটে চলে বনে-বাদাড়ে, পাহাড়ে-পর্বতে, তেপান্তরের মাঠ পেরিয়ে, কখনোবা সিন্ধুর তীরে।

এবার তাই গ্রীষ্মের ছুটিতে বন্ধুদের সঙ্গে ঠিক করলাম বেরিয়ে পড়ব ভ্রমণে। যেখানে পাহাড়ের সঙ্গে সমুদ্র মিশে একাকার হয়ে গেছে। বাংলাদেশ, আফগানিস্তান, সিরিয়ান ও ইন্ডিয়ান কজন বন্ধু মিলে ঠিক করলাম ইরানের দক্ষিণাঞ্চলীয় হরমুজগান প্রদেশ ও সমগ্র পারস্য উপসাগরের দ্বীপগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বড় দ্বীপ ক্বেশম দ্বীপ ভ্রমণে যাব।

হরমুজ প্রণালির উৎসমুখে দ্বীপটির অবস্থান। ক্বেশম দ্বীপের আয়তন প্রায় ১ হাজার ৫০০ বর্গকিলোমিটার, যা সিঙ্গাপুর ও বাহরাইন দেশের তুলনায় বড়। দ্বীপটিতে প্রায় এক লাখ আঠারো হাজার মানুষের বসবাস। তারা ফারসি ভাষার পাশাপাশি তাদের আঞ্চলিক ভাষাতেও কথা বলে।

আমি অনলাইনে ট্রেনে যাওয়া-আসার টিকিট এবং ক্বেশমে এ তিন রাত থাকার জন্য একটি রিসোর্ট বুকিং দিলাম।

আগের দিন বন্ধুরা সবাই একসঙ্গে বসে, কয়েক দফা আলোচনা করে সবকিছু গুছিয়ে নিলাম। পরদিন সকালে উঠে চলে এলাম তেহরান রেলওয়ে স্টেশনে। দুপুর সাড়ে ১২টায় আমাদের ট্রেন ছাড়ার কথা। ঠিক ১২টা ৩০ মিনিটেই ট্রেনটি প্ল্যাটফর্ম ছাড়ল। যাত্রাপথ ছিল তেহরান রেলওয়ে স্টেশন থেকে বন্দর আব্বাস রেলওয়ে স্টেশন পর্যন্ত প্রায় ১ হাজার ৩০০ কিলোমিটার। ট্রেনে এত সময় আগে কখনো কাটাইনি। প্রায় ২০ ঘণ্টা! কিন্তু সবাই মিলে আড্ডা, খাওয়াদাওয়া আর ঘুমের মধ্য দিয়ে সময়টা কী করে যে কেটে গেল, বুঝতেই পারলাম না।

বন্দর আব্বাস
ছবি: উইকিপিডিয়া

সকাল সাড়ে আটটায় আমরা বন্দর আব্বাস রেলওয়ে স্টেশনে পৌঁছালাম। বন্দর আব্বাস পারস্য উপসাগরের তীরে অবস্থিত একটি সমুদ্রবন্দর। এটি ইরানের হরমুজগন প্রদেশের বৃহত্তম একটি শহর। ইরানি নৌবাহিনীর প্রধান ঘাঁটিটি এখানেই অবস্থিত।
বন্দর আব্বাস রেলওয়ে স্টেশন থেকে আমরা ট্যাক্সিতে করে রওনা হলাম শহীদ হাক্কানি বন্দরে। সেখান থেকে ওয়াটার বাসে করে ৫০ মিনিট যাত্রা শেষে পৌঁছে গেলাম আমাদের কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য ক্বেশম দ্বীপে। সমুদ্র আর নির্মল বাতাসের সঙ্গে যার রোজকার মিতালি।

ট্যাক্সি থেকে বের হতেই প্রচণ্ড গরম অনুভব করছিলাম। রিসোর্টে পৌঁছে ফ্রেশ হয়ে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিলাম। তারপর বেরিয়ে পড়লাম নতুনকে চিনতে, প্রকৃতিকে জানতে।
আমরা রওনা হলাম স্টার ভ্যালি দেখতে। স্টার ভ্যালি নাম হলেও এটি কিন্তু কোনো পাহাড় নয়। জায়গাটি তার অদ্ভুত এবং প্রশস্ত চেহারার কারণে স্টার ভ্যালি হিসেবে পরিচিত। এখানকার আদিবাসীরা বিশ্বাস করেন, এই আকারগুলো আকাশ থেকে নক্ষত্র পতনের কারণে তৈরি হয়েছে। তবে বাস্তবে ঘূর্ণিঝড় ও অতিবৃষ্টির কারণেই মূলত জায়গাটির সৃষ্টি হয়েছে।

স্টার ভ্যালি
ছবি: লেখক

আমরা জায়গাটির অপরূপ সৌন্দর্য দেখে মুগ্ধ হয়ে গেলাম। অসম্ভব সুন্দর একটি জায়গা। সবাই মিলে বেশ কিছু ছবি তুললাম ও জায়গাটি ঘুরে দেখলাম। সন্ধ্যা নামার আগেই আমরা সেখান থেকে চলে এলাম পারস্য উপসাগরের কোল ঘেঁষে নির্মিত জাইতুন পার্কে।

জাইতুন পার্ক
ছবি: লেখক

প্রচণ্ড গরমের মধ্যে পানি দেখে আমাদের আর তর সইছিল না। তড়িঘড়ি করে নেমে পড়রলাম সমুদ্রে। আহ! সেকি প্রশান্তি। দেখলাম গুঁড়া থেকে বুড়া—সবাই সমুদ্রের পানিতে গোসল করছে। আমরা এক থেকে দেড় ঘণ্টা গোসল করার পর ফিরে গেলাম রিসোর্টে। সবাই একসঙ্গে ডিনার করে ঘুমিয়ে পড়লাম।

প্রচণ্ড গরমের কারণে পরদিন সকালে আর কোথাও যাওয়া হলো না আমাদের। বলাবাহুল্য যে ক্বেশমে তখন তাপমাত্রা ৩৮ থেকে ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছিল।
তাপমাত্রা কিছুটা কমে এলে আমরা বিকেলে ভ্রমণে বেরিয়ে পরলাম। ক্বেশম দ্বীপের কাছে অন্যতম আরেকটি সুন্দর দ্বীপ, যার নাম নাজ দ্বীপ। দ্বীপপুঞ্জটি তিনটি পাথরের শিলা নিয়ে সমুদ্রের মাঝখানে অবস্থান করছে। সমুদ্রের পানির স্তর নিচে নেমে গেলে, এই পাথরের তীর থেকে একটি পথ বের হয় এবং তখন আপনি হেঁটে নাজ দ্বীপে চলে যেতে পারবেন। তবে প্রায়ই জোয়ারের পানিতে পথটা ডুবে যায়।

নাজ দ্বীপ
ছবি: লেখক

নাজ দ্বীপের সৌন্দর্য আমাকে এখনো টানে। প্রকৃতি এখানে দুই হাত ভরে ছড়িয়ে দিয়েছে উপাচার, মানুষের জন্য। দেখলাম স্থানীয় আদিবাসীদের সমুদ্রসৈকতের আশপাশে জড়ো হতে। হস্তশিল্প, গ্রীষ্মকালীন ফল বিক্রয় এবং হাতে মেহেদির নকশা আঁকা নাজ দ্বীপের স্থানীয় বাসিন্দাদের জীবিকা উপার্জনের অন্যতম উৎস।

অতঃপর নাজ দ্বীপ ভ্রমণ শেষে আমরা রওনা হলাম জাইতুন পার্কের উদ্দেশে। পার্কে পৌঁছে সিরিয়ান পানীয় মাত্তেহর স্বাদ আস্বাদন করতে করতে উপভোগ করলাম সমুদ্রের অবিরাম ঊর্মিমালা। রাতে রিসোর্টে ফিরে খাওয়াদাওয়া করে ঘুমিয়ে গেলাম।
পরদিন সকালে উঠে নাশতা করে আমার রওনা হলাম ক্বেশম দ্বীপের একমাত্র ম্যানগ্রোভ ফরেস্টে। ম্যানগ্রোভ বনটি কেবল ক্বেশম দ্বীপ নয়, ইরানেরও অন্যতম বিশেষ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য। এটি ইরানের অন্যতম জনপ্রিয় একটি দর্শনীয় স্থান। বনটি ফ্লামিংগো, পেলিক্যান এবং কয়েক প্রজাতির বকের অভায়রণ্য। বনে পৌঁছে একটি স্পিডবোট ভাড়া করে রওনা হলাম বনটির সৌন্দর্য আবলোকন করতে। সবাই মিলে বেশ কিছু ছবিও তুলে ফেললাম।

বন পরিদর্শন শেষে আমরা দুপুরের খাবার খাওয়ার জন্য চলে এলাম একটি স্থানীয় রেস্টুরেন্টে। সেখানে ছিল হরেক রকমের সামুদ্রিক মাছের তৈরি খাবার। যার যার পছন্দমতো আমরা অর্ডার করলাম। সত্যিই সামুদ্রিক মাছগুলো খেতে ছিল খুবই সুস্বাদু। আমাদের ওখান থেকে রিসোর্টে ফিরতে ফিরতে রাত হয়ে গিয়েছিল। পরদিন ছিল তেহরানে ফিরে যাওয়ার পালা।

ক্বেশম দ্বীপের একমাত্র ম্যানগ্রোভ ফরেস্টে
ছবি: লেখক

ক্বেশম থেকে সকাল আটটায় রওনা হলাম বন্দর আব্বাসের দিকে এবং আবার দীর্ঘ ২০ ঘণ্টা ট্রেনে কাটিয়ে পৌঁছালাম তেহরানে।এইভাবেই আরও একবার শেষ করলাম অজানাকে জানা, অদেখাকে দেখা। উপভোগ করলাম প্রকৃতির নয়নাভিরাম দৃশ্য ও সৃষ্টিকর্তার সৃষ্টির অসীম সৌন্দর্য।

ক্বেশম ভ্রমণ আমাকে আবার একবার মনে করিয়ে দেয় ম্যাথু কার্স্টেনের সেই বিখ্যাত উক্তি, ‘ভ্রমণের জন্য বিনিয়োগ হচ্ছে নিজের জন্য বিনিয়োগ।’

ক্বেশম ভ্রমণ জীবনের অসাধারণ অনুভূতিগুলোর সাক্ষী হয়ে আজীবন রয়ে যাবে আমার মনের মণিকোঠায়।

লেখক: শিক্ষার্থী, কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিং, খাজা নাসিরউদ্দিন তুসি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।