‘রক্তের নিঃশব্দ সুর/সদা চলে নাড়িতন্তু বেয়ে।’ বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘প্রবাসী’ কবিতার এই পঙ্ক্তি যে কত সত্য, তা প্রবাসী মাত্রই জানেন। বিশ্বের যে প্রান্তেই যাক না কেন মানুষ, জন্মভিটা থেকে তার দূরত্ব যতই হোক না কেন, মাটি ও আলো-হাওয়ায় যত বদলই আসুক না কেন, ঠিকই তার হৃদয় জন্মুসূত্রটির সঙ্গে জড়িয়ে থাকে। এই জন্মসূত্রের সঙ্গে সব সময় বাস্তবিক যোগ রাখা হয়তো তার পক্ষে সম্ভব হয় না। জীবনের বিবিধ প্রয়োজনে তাকে নিজের আবেগকে পাথরচাপা দিতে হয়।
প্রবাসীমাত্রই নিজের ভূমির দিকে তাকিয়ে থাকা এক মানুষ। ঠিক চাতকের মতো। সুযোগ পেলেই সে ফিরতে চায় নিজ ভূমিতে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে থাকা বাংলাদেশিরা নিজের জীবন দিয়েই এই বাস্তবতার সঙ্গে পরিচিত। যেকোনো মূল্যে তাঁরা স্বদেশের সঙ্গে সম্পর্কটি রক্ষা করতে চান। নানা উপলক্ষ খুঁজে ফিরতে চান দেশে ক্ষণিকের জন্য হলেও। শুধু নিজেরাই নয়, নিজেদের পরের প্রজন্মকেও দেশ ও দেশের মানুষের সঙ্গে সংযুক্ত করতে চান তাঁরা। এ কারণে অনেককেই দেখা যায় দশকের পর দশক বিদেশ বিভুঁইয়ে কাটালেও, নিজেদের সন্তানের জন্ম প্রবাসে দিলেও তাদের মাধ্যমে দেশেই আত্মীয়তার সম্পর্কটি গড়তে চান। গ্রামে বা শহরে রেখে দিতে চান নিজের জন্মভিটার অস্তিত্ব। প্রবাসে অর্জিত অর্থ দেশে বিনিয়োগ করেন বা করতে চান। নানা সামাজিক কর্মকাণ্ড চালান দেশের দুস্থ ও অসহায় মানুষের জন্য। এই করোনাকালেও এমন বহু দৃষ্টান্ত আমরা দেখেছি। এ এক দারুণ আবেগের বিষয়।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশ পারস্পরিক সম্পর্ক রক্ষায় কূটনৈতিক ব্যবস্থা দাঁড় করিয়েছে। এ ক্ষেত্রে দূতাবাস ও কনস্যুলেটগুলো সংশ্লিষ্ট দেশের স্বার্থ রক্ষার কাজ করে। এই দূতাবাস ও কনস্যুলেটগুলোর অন্যতম কাজ হচ্ছে, ওই দেশে থাকা তাদের নিজ দেশের প্রবাসীদের স্বার্থ রক্ষাসহ প্রবাসীদের প্রয়োজনীয় বিভিন্ন সেবা দেওয়া। এ ক্ষেত্রে পাসপোর্ট ও ভিসা-সংক্রান্ত বিষয়াদি একেবারে প্রাথমিক ও নিয়মিত স্তরের সেবা হিসেবে বিবেচিত। কিন্তু এই সেবাটি নিয়েই বাংলাদেশি প্রবাসীদের অভিযোগ দীর্ঘদিনের, এই করোনাকালে যা বড় আকার ধারণ করেছে।
যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কসহ কয়েকটি অঙ্গরাজ্যে বসবাসরত বাংলাদেশি প্রবাসীরা দেশি পাসপোর্ট করা বা নবায়ন নিয়ে চরম ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। করোনাভাইরাসসহ অন্যান্য বাস্তবতায় প্রবাসীরা এমনিতেই স্বদেশে ভ্রমণ করতে বিপাকে পড়ছেন। এই সংকটকে আরও বাড়িয়ে তুলেছে পাসপোর্ট নবায়ন ও নতুন পাসপোর্ট করা নিয়ে কনস্যুলেটের সেবার ঘাটতি। অনেক প্রবাসী বাংলাদেশিকেই যাবতীয় নিয়ম মেনে আবেদন করার পরও পাসপোর্ট পেতে দীর্ঘ দিন ধরে অপেক্ষা করতে হচ্ছে। অনেকে আগে থেকে ফ্লাইটের টিকিট কেটে বসে আছেন, কিন্তু এই জটিলতার কারণে দেশে যেতে পারছেন না। ফলে এই পাসপোর্ট জটিলতার কারণে আর্থিকভাবেও ক্ষতিগ্রস্ত হতে হচ্ছে প্রবাসীদের।
এ ক্ষেত্রে নিউইয়র্কের কনস্যুলেট কার্যালয় থেকে দায় চাপানো হয়েছে বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ঘাড়ে। প্রবাসীদের পক্ষে যুক্তরাষ্ট্রে বসে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করাটা প্রায় অসম্ভব। এই যোগাযোগটি প্রবাসীদের হয়ে কনস্যুলেটই করবে। এই সেবার জন্য কনস্যুলেটের মাধ্যমে বাংলাদেশ সরকার প্রবাসীদের কাছ থেকে ফিও নিচ্ছে। কিন্তু সেবাটি দিচ্ছে না। এটি চলতে পারে না। এমন কালক্ষেপণ প্রবাসীদের অধিকার থেকে বঞ্চিত করছে। প্রবাসীদের আবেগ এবং দেশের অর্থনীতিতে তাদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার কথা বিবেচনা করে হলেও এই সংকট নিরসনে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি।