পার্থিব

প্রতীকী ছবি। সংগৃহীত
প্রতীকী ছবি। সংগৃহীত

জন আর মেরি খুব সুখী দম্পতি। ওরা মিসিসিপিতে একটা কনডো কিনেছে বছর দুই হলো। চমৎকার করে সাজিয়েছে। ছুটির দিনগুলিতে শপিংয়ে গেলে ঘর সাজানোর কত কী কেনে। জন কাজ করে হসপিটালের ল্যাব সেকশনে। জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে গ্র্যাজুয়েশন করেই জবটা পেয়ে যায়। মাস্টার্স আর করা হয়নি।

মেরি পরে ওর মেজর পাল্টে হসপিটাল ম্যানেজমেন্ট পড়েছে। সে ম্যানেজমেন্টে কাজ করে। দুজনের দুটো গাড়ি। টয়োটা ক্যামরি। মেরি মানে মারিয়ার। আর বিএমডব্লিউ জনাথন, মানে জনের।
দুজনই খুব বন্ধুপ্রিয়। বন্ধুদের সঙ্গে প্রায়ই ক্লাব–বারে যায়। কখনো লং ড্রাইভে যায়। কখনো বাবা–মাকে দেখতে গ্রিনভিলিতে যায়। আবার আরাকানসাসেও যায়। জনের বোন জেনেলিয়া ডাক্তার। কিন্তু বিয়ে করেনি। সে তার বাবা মায়ের সঙ্গেই থাকে। জেনেলিয়া ভাই অন্ত প্রাণ। ভাই আর ভাইয়ের বউ এলে কাজ থেকে ছুটি নেয়। সমুদ্র তীরবর্তী কোনো দ্বীপে নইলে পাহাড়ে বেড়াতে যায়। জেন খেয়াল করে ওর ভাই আর ভাইয়ের বউ পাহাড়ের চেয়ে সমুদ্র বেশি ভালোবাসে। জেন পাহাড় ভালোবাসলেও ওদের নিয়ে সি বিচ, ফিশিং, আইস স্কেটিং, সামার ক্যাম্প এগুলোতেই যায় বেশি। পাহাড়ে উঠতে থাকলে মেরি ড্রাইভ করেই না। বরং চোখ বন্ধ করে ফেলে গিরিখাত দেখলে।
জন সব সময় বলে—আই অ্যাম নট কমফোর্টেবল টু রাইড অ্যান্ড ড্রাইভ অন আ মাউন্টেন।
প্রতিবার ওরা সামারে কোথাও যায়। এ বছর ওদের ম্যারেজ ডে উপলক্ষে জেন ঘোষণা দেয় ও সবাইকে ক্রুজে নিয়ে যাবে। ওরা কিউবা যাবে।
—আই মেড রিজার্ভেশন ফর সেভেন পিপল। ওকে?
—সো মি. অ্যান্ড মিসেস টনি, মি. অ্যান্ড মিসেস রিচার্ড, মি. অ্যান্ড মিসেস আব্রাহাম অ্যান্ড মিস আব্রাহাম।
—ইউ আর সো সুইট মাই সিসটার। ইটস অ্যামেজিং। ইফ ইউ আর ইনফ্রন্ট অব মি আই উইল হাগ ইউ টাইটলি।
—অল রাইট ব্রো। অল দ্য বেষ্ট।
জেনের পরিকল্পনা অনুযায়ী জুলাই মাসের পাঁচ তারিখে চমৎকার সকালে ওরা ফ্লোরিডা থেকে কিউবার উদ্দেশে যাত্রা করল। নীল জলরাশি আর নীল অবারিত আকাশ সঙ্গে সকল আপনজন। খুব আনন্দিত সবাই। রাতের ডিনারের পর প্রচুর ড্রিংক করে সবাই।
টনি বলে—আই ওয়ানা সি জন জুনিয়র সুন।
—মি টু। বলে ওঠে রুহি।
—মি টু বলে ওঠে রিচার্ডও, হাতের গ্লাসে টোকা মেরে।
জেন আর মেরি লজ্জা পেয়ে উঠে যায়। ওরা ড্যান্স করতে চলে যায় ড্যান্স ফ্লোরে। ড্যান্স ফ্লোরে মিউজিকের তালে তালে পা ফেলতে ফেলতে কোমর জড়িয়ে মেরির কানে ফিস ফিস করে জন।
—আই লাভ দ্য ওয়ে দে ওয়ান্ট আ বেবি।
—ইয়া। মি টু।
—ফ্রম টুডে উই ক্যান স্টার্ট ইট। লেটস গো টু ডু আওয়ার প্রজেক্ট।
—নট নাউ। বলে মারিয়া।
ডেকের খোলা হাওয়ায় ওরা দাঁড়িয়ে সমুদ্রের রাতের সৌন্দর্য দেখে। ছাব্বিশ তলা জাহাজের ষোলো তলায় উইন্ডো ভিউ রুম ওদের। ডোর লক খুলতেই ‘হ্যাপি অ্যানিভারসারি’ বলে চার পাঁচটা ভূত এগিয়ে এল। রুমের নীলচে সাদা আলো মোহনীয় এক আবহ তৈরি করেছে। বিছানায় তিনটা গিফট প্যাক পেল।

জেনেলিয়াকে ধন্যবাদ জানিয়ে ওরা সবাই ফিরে গেল যার যার কর্মস্থলে।
পাঁচ বছর হয়ে গেল। ওদের কোনো বেবি হওয়ার কোনো সম্ভাবনাও দেখা গেল না।

জন জেনেলিয়াকে কল দিয়ে বলল—হোয়াট ইউ থিংক জেন? ডু আই নিড টু কনসাল্ট উইথ দা জিওয়াইএন ডক অর ফার্টিলিটি?
—গো টু দ্য জিওয়াইএন ফার্স্ট। ডোন্ট ওরি। লেটার ইউ কুড গো টু দ্য ফার্টিলিটি।
—ওকে। লাভ ইউ।
—লাভ ইউ টু, বাই।

লেখিকা
লেখিকা

অ্যাপয়েন্টমেন্ট করে ওরা ডাক্তারের কাছে কয়েক দফা গেল। সবকিছুই ঠিক আছে কিন্তু কনসিভ করে না। বিয়ের বেশ কিছুদিন পার হয়েছে। সন্তানও চাইছে কয়েক বছর ধরেই। কিন্তু ইচ্ছাপূরণ কিছুতেই হচ্ছিল না। শেষমেশ চিকিৎসকের দ্বারস্থ হয়েছিল ওরা। আইভিএফ (ইন ভিটরো ফার্টিলাইজেশন) পদ্ধতিতে সন্তান ধারণের পরামর্শ দিয়েছিলেন চিকিৎসকেরা। ওরাও রাজি ছিল। কিন্তু তার আগে জন ও মারিয়ার যে রুটিন শারীরিক পরীক্ষা হলো, সেই পরীক্ষার রিপোর্ট দেখে হতভম্ব হয়ে গেলেন ডাক্তাররা। প্রায় হুবহু মিলে গেল স্বামী-স্ত্রীর ডিএনএ।
ডাক্তারেরা তাদের ক্লিনিকে ডাকলেন। জানতে চাইলেন ফ্যামিলি হিস্ট্রি। তারা কাজিন কিনা তাও যাচাই করলেন। তারা জানাল যে, তাদের আলাপ হয়েছিল কলেজে গিয়ে। তার আগে কেউ কাউকে চিনত না। দুজনে দুজনের মধ্যে অনেক মিল খুঁজে পেয়েছিল। সেই থেকেই প্রেম ও বিয়ে। দুজনের চেহারার মিল দেখে পরিচিতরা ও বন্ধু-বান্ধবেরা রসিকতাও করতেন। ডাক্তার তাদের আবারও ডিএনএ টেস্ট দিলেন। ডিএনএ রিপোর্ট দেখে ল্যাব অ্যাসিস্ট্যান্ট থ হয়ে গেলেন। কিন্তু কখনো দুঃস্বপ্নেও কেউ ভাবতে পারেননি, ওই দম্পতি যমজ ভাই-বোন।
মিসিসিপির যে ফার্টিলিটি ক্লিনিকে চিকিৎসার জন্য গিয়েছিলেন এই দম্পতি, সেই ক্লিনিকের ডাক্তার জানিয়েছেন, দুজনের ডিএনএর মধ্যে অদ্ভুত মিল দেখে ল্যাব অ্যাসিস্ট্যান্ট অবাক হয়ে গিয়েছিলেন। তিনিই বিষয়টি চিকিৎসকের নজরে আনেন। শিকড়ে পৌঁছে যে তথ্য উঠে এসেছে, তাতে চিকিৎসক নিজে তো বটেই, ওই দম্পতিও আশ্চর্য হয়ে গিয়েছেন।

দুই.

...হিমাচল প্রদেশের খাঁড়া পাহাড়ি পথ বেয়ে বাসটি ওপরে উঠে যাচ্ছে। বাসের যাত্রীরা সবাই ঘুমে আচ্ছন্ন। ৪৬ জন যাত্রী নিয়ে বাসটি উত্তরাখণ্ড থেকে সিমলার তিউনিতে যাচ্ছিল। পাহাড়ি রাস্তায় চোপাল এলাকায় পৌঁছালে বাসের চালক নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেন। একপর্যায়ে বাসটি পাহাড়ি রাস্তা থেকে গড়িয়ে ২৫০ মিটার নিচে টোনস নদীতে পড়ে যায়।
কাহিনির শুরু এখানে।
বাসের প্রায় সকল যাত্রী নিহত হলেও অলৌকিকভাবে বেঁচে যায় দুটি বাচ্চা। বাচ্চা দুটির বয়স আড়াই বা তিন বছর। তারা যমজ ভাইবোন। তাদের বাবা মার সঙ্গে বাসে সিমলা যাচ্ছিল।
টেলিভিশনের খবরে পরপর কয়েকদিন দেখানো হলো। সব পত্রিকায় ছবি দেওয়া হলো কিন্তু বাচ্চাদের কোনো অভিভাবক না পেয়ে অবশেষে তাদের সিমলার একটি চাইল্ড হোমে রাখা হলো।
আমেরিকান অর্থ সাহায্যে পরিচালিত এই চাইল্ড হোমটিতে বাচ্চা দুটো বড় হচ্ছিল। আমেরিকার আরাকানসাসের বার্মিংহাম থেকে দত্তক নিতে আগ্রহী হন এক দম্পতি। টনি আব্রাহাম ও রুহী আব্রাহামের একমাত্র মেয়ে জেনেলিয়া দশ বছর বয়সী। আরাকানসাসের বার্মিংহামে বাস করেন তারা। প্রচুর জমি আছে তাদের। চাষ করেন। তাদের ঘোড়াও আছে। আর সন্তান হওয়ার সম্ভাবনা না থাকায় মেয়ের ইচ্ছায় তারা ওই চাইল্ড হোমের ছেলে বাচ্চাটিকে নিয়ে আসেন। নাম রাখলেন জনাথন আব্রাহাম। ডাক নাম জন। তখন ওর বয়স তিন বছর। জন জেনেলিয়া আব্রাহামের একমাত্র ভাই।
মিসিসিপির গ্রিনভিলিতে বাস করেন আরেক নিঃসন্তান দম্পতি। রিচার্ড শিলার আর ন্যান্সি শিলার। বছর খানিক পরে মিসিসিপির এই নিঃসন্তান দম্পতি সিমলার চাইল্ড হোম থেকে মেয়েটিকে নিয়ে আসেন। তাদের নাম অনুযায়ী মারিয়া শিলার হয়ে যায় মেয়েটির নাম। ডাক নাম মেরি।
দশ বছরের বিবাহিত জীবনে কোনো সন্তান না থাকায় তাদের মধ্যে যে শূন্যতা সৃষ্টি হয় তা থেকে মুক্তি পেতে তারা সাইক্রিয়াটিস্টের শরণাপন্ন হন। সাইকিয়াটিস্ট তাদের কয়েকটি চাইল্ড হোমের ওয়েবসাইট দিয়ে দেন। বাচ্চা দত্তক নেওয়ার পরামর্শ দেন। সেদিন রাতে ল্যাপটপে ওয়েবসাইটগুলোতে বাচ্চাদের ছবিসহ তথ্য চেক করতে করতে ন্যান্সি চার বছর বয়সী মেয়েটিকে পছন্দ করে। রিচার্ডও এককথায় রাজি হয়ে যায়। তখন ইমেইল করে চাইল্ড হোমের ইমেইল অ্যাড্রেসে। ভীষণ উত্তেজিত থাকে দুজনেই।
পরদিনই রিপ্লাই পেয়ে ওরা যাবতীয় কাগজপত্রসহ অ্যাম্বাসিতে যোগাযোগ করল। ভারতে যাওয়ার টিকিট বুকিং করল। সিমলা এয়ারপোর্টে নেমে ট্যাক্সি নিয়ে হোটেলে গিয়ে ফ্রেশ হয়েই ছুটে গেল চাইল্ড হোমে। সিস্টার সাদা ফ্রক আর মেরুন সোয়েটার পরা মেয়েটিকে ওদের সামনে আনতেই ন্যান্সি আবেগে ছুটে গিয়ে কোলে তুলে নিল। ওর জন্য আনা পুতুল চকলেট ওর হাতে দিল।
ওরা ওকে মাই বেবি বলে ডাকছিল। অ্যাডাপ্টেশন রুলস অ্যান্ড রেগুলেশন মেনে নিয়ে সব কাগজপত্র সাইন করল। সব সাইন করা হয়ে গেলে ওরা মারিয়াকে নিয়ে ফিরল মিসিসিপির গ্রিনভিলিতে। মারিয়া জানল বিদেশ থেকে ওর বাবা–মা ফিরে এসেছে ওকে নিতে। মারিয়ার বয়স তখন চার।
জনাথন ওহাইওর সিনসিনাটি ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হলো জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে। ডরমে থাকবে। ডরমে যে রুম পেল সেখানে চারজন থাকবে। ইউএসের বিভিন্ন স্টেট থেকে এসেছে সবাই। ক্লাসে গিয়ে প্রথম পরিচয় হলো নার্গিসা আমিরোভা নামের এক আলবেনিয়ান মেয়ের সঙ্গে। ছিপছিপে গড়নের সদা হাস্যময়ী। ওদের বেশ বন্ধুত্ব হয়। নার্গিসা যে ডরমে থাকে সেটা পাশেই।
একদিন সকালে ঘুম ভেঙে দেখে বাইরে তুমুল বৃষ্টি। বৃষ্টির মধ্যে ছাতা নিয়ে ক্লাসে যাচ্ছিল জন। লাল রেইনকোট পড়ে একটা মেয়ে যাচ্ছিল। জনের ইচ্ছে হলো ছাতাটা উড়িয়ে দেয়। আর লাল রেইনকোট পরা মেয়েটিকে জাপটে ধরে—হাই গুডমর্নিং।
—হাই গুডমর্নিং।
—আ অ্যাম জনাথন আব্রাহাম। জন। ইউ ক্যান কল মি জন।
--নাইস টু মিট ইউ। আই অ্যাম মারিয়া। ইউ ক্যান কল মি মেরি।
হ্যান্ডশেক করতেই কেমন অদ্ভুত একটা অনুভূতি হলো। কেন যেন মনে হলো ওরা অনেক দিনের চেনা।
--আই অ্যাম ফ্রম আরাকানসাস। এন ইউ?
—আই অ্যাম ফ্রম মিসিসিপি।
টুকটাক কথা বলতে বলতে দেখল ওরা দুজনেই একই মেজর নিয়েছে। তবে ভিন্ন প্রফেসরের আন্ডারে। ক্লাসের শেষে ওরা দেখা করবে লাইব্রেরি হলে এই বলে দুজনে দুজনের ক্লাসে চলে গেল।
—সি ইউ সুন।
--বাই নাউ। সি ইউ সুন দেন।
দুজনেই ক্লাসের শেষে দেখা হবে, এ জন্য অধীর আগ্রহ নিয়ে ক্লাসে গেল।

দেখতে দেখতে বছর চলে গেল। ওদের ঘনিষ্ঠতা বাড়ল। জন এক বিকেলে বলল—ক্যান উই গো টু ডিনার টু নাইট?
—অফ কোর্স। হোয়াই নট।
—ওহ। ইউ আর গ্রেট!
সেই রাতে ডিনারের পর ওরা ভদকা আর পাইন অ্যাপল জুস মিশিয়ে ড্রিংক করল। তারপর হলভর্তি ছেলেমেয়ের মাঝেই ব্লু লংড্রেস পরা মেরিকে প্রপোজ করল জন।
—আই লাভ ইউ। ডু ইউ লাভ মি? হাঁটু গেড়ে বসল মারিয়ার সামনে এবং মারিয়ার দিকে চেয়ে রইল।
মারিয়াও বলল—আই লাভ ইউ টু।
হাতে হাত কোমর পেঁচিয়ে ধরে মারিয়াকে গাড়িতে ওঠাল। গাড়ি স্টার্ট করার আগেই দীর্ঘ চুমুতে নিমগ্ন হলো। পেছনের গাড়ির হর্ন শুনে তাড়াতাড়ি সোজা হয়ে বসল।
তারা দুজনেই জোরে হেসে উঠল...।

*লেখিকা যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কপ্রবাসী।