পারিশ্রমিক

12
12

সাল ২০০৩। মাধ্যমিকের প্রথম পর্ব (ইংরেজি মাধ্যমে আপনি চাইলে মাধ্যমিক কয়েক পর্বে ভেঙে দিতে পারেন। ও লেভেল এমনিও বছরে দুবার—জানুয়ারি আর মে-তে হয়ে থাকে) দেওয়ার পর বেশ কিছু দিনের অবসর। ভাইবোনের সবার ছোট হওয়ায় আদরের পাল্লাটা আমার দিকে সব সময় ভারী, আলহামদুলিল্লাহ।

আমার দিন কাটছিল ছবি এঁকে, গান গেয়ে, টুকটাক লিখে, আর এক বছরের ছোট্ট ভাইপোকে বুকে নিয়ে। যেহেতু সবার ছোট আমি, নিজের আদরে কমতি না থাকলেও আল্লাহর কাছে সব সময় চাওয়া ছিল, আমার থেকে ছোট এমন কেউ থাকুক জীবনে, যাকে আমি স্নেহের বর্মে ঘিরে রাখতে পারি। আমার ভাইপোটি এবং পরবর্তীকালে ওর বাকি দুই ভাইবোন পৃথিবীতে এসে আমার এই চাওয়াটা পূরণ করেছিল। আজও এরা তিনজনসহ আমার বড় বোনের দুজন—এই পাঁচজন মানে আমার কাছে এমন এক শক্তির উৎস, যা আমার চরম খারাপ অবস্থায়ও আমাকে টেনে তুলতে সক্ষম।

দোতলায় ছোট্ট একটি একক পরিবার আমাদের। মধ্যবয়সী বাবা-মায়ের এক মিষ্টি ১০ বছর বয়সী পুত্র। আমাদের গাড়িটি গ্যারেজে থাকত অপর গাড়ির সামনে। প্রতিদিন সকালে এই দুষ্টু মিষ্টি ছেলেটি দরজার ঘণ্টা বাজাত:
‘আপু, ওই, আপনাদের গাড়িটা একটু সরাতে হবে।’

তবে আমার গলা তখন দুটো তুলতুলে হাতের দখলে, আর কাঁধে একটা ছোট্ট গোল মাথা। আমার কণ্ঠে তখন ‘আয় আয় চাঁদ মামা টিপ দিয়ে যা...’ আর নয়তো ‘Rock a bye baby, on the treetop...’ কোলেরটিকে আর একটু আগলে ধরে হালকা চেঁচাতাম: ‘ও ভাইয়া আ আ...গাড়ি ই ই ...’
এর কিছুদিন পর থেকে এই ছেলেটি আসার একটু আগে থেকেই লজেন্স হাতে তৈরি থাকতাম। ঘণ্টা বাজার আগেই সিঁড়িতে পায়ের শব্দ পেলে দরজা খুলে হাতে লজেন্স ধরিয়ে গাল টিপে দিতাম ওর:

‘যাও বাড়ি যাও, আমি গাড়ি সরানোর কথা বলছি।’ লাজুক হেসে চলে যেত ছেলেটি।

মাসখানেক পর একদিন শুনি আম্মু আর দোতলার আনটির কথোপকথন:
‘ঈশিতা কি পড়াতে পারবে? আমার ছেলে নিজেই বলছিল পড়তে চায়। ও পছন্দ করে ঈশিতার আদর।’
আমার কিছুটা আক্কেল গুড়ুম! এ ছেলের মুখে কথা সরে না, ও কি সহজ হতে পারবে আমার সঙ্গে? আবার খুশিও হয়েছিলাম, কচি মনে নিজের জন্য জায়গা করে নিতে পেরেছি ভেবে।

প্রথম দিন পড়াতে গিয়েই বুঝলাম, কিছুটা সহজ হয়ে গেলেই ব্যস! বোবা মুখে কথার ফুলঝুরি ছোটে! এ ছেলেটি ছাত্র হিসেবেও বেশ মেধাবী। সে তার বাড়ির কাজ প্রায় সব নিজেই শেষ করে রেখে দিত। আমার কাজ ছিল কেবল সেগুলো ঠিক করা আর ওর দুর্বল জায়গাগুলো বুঝে নিয়ে গল্পের ছলে সেগুলোর প্রতি ওর আগ্রহ তৈরি করা। আমরা অনেক গল্প করতাম। পড়তে পড়তেই এ ছেলেটি কখনো আমার পিঠে, কখনো আমার চুল দিয়ে খেলা শুরু, কখনো পাশের চেয়ার থেকে কোলে মাথা ফেলে দিত। কোনো দিন বাধা দিইনি ওকে। এক মাসের মধ্যেই আক্ষরিক অর্থে ছোট ভাই হয়ে উঠেছিল সে। দ্বিতীয় শ্রেণির ছেলেটিকে পড়াতে গিয়ে নিজের অজানা বিষয়গুলো জানা হয়ে যাচ্ছিল।

প্রথম মাসের শেষে একদিন নাশতার ট্রে হাতে ছেলের ঘরে ঢুকলেন আনটি। ছেলের চোখ বাঁচিয়ে চায়ের পিরিচের নিচে একটা সোনার দোকানের খাম চাপা দিলেন। ফিস ফিস করেই বললেন, ‘ওই ওটা তোমার জন্য, ফারজামের তরফ থেকে।’

বাড়ি ফিরে দেখি, খামে চারটা নতুন নোট, দুটো ৫০০ টাকার, আর বাকি দুটো ১০০। সে সময়ের ১২০০ টাকা মানে আজ প্রায় ৫ হাজার টাকার মতো। বছর তিনেক পড়িয়ে ছিলাম ওকে, টাকার অঙ্কও বেড়ে ছিল। সে বয়সে প্রথম পারিশ্রমিকের আনন্দ, লিখে বোঝানো যাবে না।

আম্মু বললেন, চলো, সোনার দোকানের খামে তোমার প্রথম রোজগার, তুমি এখানেই চলো। দোকান থেকে একটা ছোট্ট সোনার লকেট কিনেছিলাম ৬০০ টাকা দিয়ে, আল্লাহর নাম লেখা। বাকি ৬০০-র কিছু টাকা দিয়ে কিছু আপেল, কারণ ভাইপোটি ওর কচি কচি নতুন দাঁতে আপেলের টুকরো খেতে ভালোবাসত। কিছু টাকা দিয়ে দুটো মুরগি, আর বাকিটুকু ব্যাংকে। সেদিন রাতে বাড়ির সবার জন্য মুরগি-পোলাও রেঁধেছিলেন আম্মু।

আজ এত বছর ধরে ওই একই দোকান আমার সব সোনার গয়নার শখ মেটায়। সোনা, রুপা, পিতল, মাটি, পুঁতি... সব ধরনের গয়না ভালোবাসি আমি, তবে তা হতে হবে খুবই হালকা, সুন্দর নকশা আর দামে সাশ্রয়ী।

আপনি ছবি আঁকতে পারেন? মেহেদি পরাতে? হয়তো চাকরির আশায় বসে থেকে নিজেই নিজেকে চড় মারছেন ‘আমি বেকার’ বলে। এমন ছোট ছোট শখ থেকে ছোট ছোট রোজগার শুরু করুন, আত্মবিশ্বাস বাড়বে। চারাগাছ থেকেই ধীরে ধীরে ডালপালা ছড়ায়। সেদিনের সেই ছোট্ট আমি হাতের কাছে পাওয়া প্রতিবেশী ফারজামকে নিয়ে শিক্ষা, শেখানোকে ভালোবাসতে শুরু করেছিলাম। শেখানোর সেই শখ থেকেই আজ আমার পেশা শিক্ষকতা। আর এর ভেতর পাওয়া সম্পর্কগুলো, মিষ্টি মুহূর্তগুলো এক কথায় অমূল্য।

তাই কোনো পরীক্ষা পাস করেই অযথা বেশি বেতনের আশায় বসে না থেকে, পরীক্ষার পরের অবসর সময়টা, ছোট ছোট অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করুন। ছোট্ট একটুখানি টাকাও কিন্তু আপনার নিজের রোজগার, যার আনন্দ সীমাহীন।

*প্রিয় আনিস ওবায়েদ, যাকে আমি ফারজাম বলেই ডাকতাম, বেঁচে থাকলে আজ তুমি ২৫-২৬ বছরের যুবক। নিজের মেধাকে পৃথিবীর কোথাও কাজে লাগিয়েছ আশা করি। জানি না এ লেখাটি তোমার চোখে পড়বে কি না। যেখানেই থাকো, সব সময় ভালো থেকো।