পারস্যের ঈদ ও বাঙালির মিলনমেলা
তেহরানের বাংলাদেশ দূতাবাস হচ্ছে আমাদের প্রিয় স্বদেশের এক টুকরো মিলনকেন্দ্র। প্রবাসের বর্ণহীন ঈদে এটাই আমাদের একমাত্র সম্বল। ইরানে আগমনের পরে বাংলাদেশের রমজান ও ঈদ স্বাদ প্রায় ভুলেই গিয়েছি। পেঁয়াজি, আলুর চপ, বেগুনি, হালিম (ইরানের হালিম মিষ্টি) ও ছোলা বুট মাখানো মুড়ি ইত্যাদি হরেকরকম মুখরোচক খাবার ভীষণ মিস করি। কিন্তু অন্যদিকে ইরান দেশের শোলে জারদ (জাফরান মেশানো হলুদ রঙের অনেকটা ফিরনি স্বাদের), জুলবিয়া (জাফরান দেওয়া জিলাপি), বমিয়ে, অশ রেশতে (নুডলসের মতো ঝোলসহ), হালিম, সাঙ্গাক রুটি (বিশাল সাইজের উনুনে পাথরের ওপরে সেঁকা হয়), পনির, পুদিনা পাতা, লেটুস পাতা, খেজুরও কিন্তু বাংলাদেশে দারুণ মিস করব। এই চার বছরে এগুলোর সঙ্গে দারুণ সখ্যতা গড়ে ফেলেছি।
উল্লেখ্য, ইরানের রমজানে বাংলাদেশের অলিগলির মতো ইফতার সামগ্রী বিক্রয়ের দৃশ্য অতটা চোখে না পড়লেও বিভিন্ন অলিগলির মাথায় কিন্তু অহরহ বিভিন্ন রকম সুস্বাদু স্যুপ ও হালিম বিক্রয়ের দৃশ্য চোখে পড়বে। আমরা স্বল্পসংখ্যক বাংলাদেশি শিক্ষার্থী ইরানে বৈধভাবে বসবাসরত বাংলাদেশি ভাইদের বাসায় স্বদেশি ইফতারির স্বাদ নিতে অধীর অপেক্ষায় থাকি। ভাবিরাও কিন্তু উদারচিত্তে আমাদের চাহিদা পূরণ করে থাকেন।
বাংলাদেশের মতো এখানেও হয়েছে একসঙ্গে মিলে ইফতার পার্টি। বিশেষত বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগের উদ্যোগে এখানে ইফতার পার্টি চোখে পড়বে। এ ছাড়া ছাত্রাবাসগুলোতে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিনা মূল্যে ইফতার সরবরাহ করা হয়ে থাকে। এখানে ঈদুল ফিতরে দুই দিন বন্ধ থাকে। তেহরানের লোকজন গাড়ির ছাদে লোটাকম্বল নিয়ে সোজা উত্তরের কাস্পিয়ান সাগরের তীরে ছুটে চলেন। রাস্তাঘাট কিছুটা ফাঁকা থাকে। চৌরাস্তা বা বড় বড় সড়কের মাথায় স্বেচ্ছাসেবকেরা চেয়ার-টেবিল নিয়ে বসে জাকাত-ফিতরা তোলেন। বিভিন্ন মসজিদে ঈদের জামাত অনুষ্ঠিত হয়। রাহবার ইমাম খামেনির ইমামতিতে সবচেয়ে বড় ঈদের জামাত অনুষ্ঠিত হয় তেহরানের মুসাল্লায়। একেবারে পাঁচ ছয় কিলোমিটার দূর থেকেই পুলিশ, অ্যাম্বুলেন্স, স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর ভীষণ তৎপরতা চোখে পড়ে। বিশেষত তেহরানে আইএসের সন্ত্রাসী হামলার পর মেট্রো স্টেশনগুলোর প্রবেশ পথে নিরাপত্তা বাহিনীর তৎপরতা অত্যন্ত লক্ষণীয়। তবে রাস্তায় রাস্তায় কমবয়সী বাচ্চাদের আর্মির পোশাক পরিধান করে বিনা মূল্যে শরবত, চা ও মিষ্টান্ন দ্রব্য বিতরণ দারুণ আকর্ষণীয় মনে হয়। মনে হয় এই বয়স থেকেই দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ এক জাতি তৈরি হচ্ছে।
এবারই প্রথম ঈদের দিন এখানকার বিনোদন কেন্দ্রগুলো স্বশরীরে দেখতে হাজির হয়েছিলাম পুরোনো তেহরানে। মুজে বাস্তান (প্রাচীন জাদুঘর), মুজে অবগিনে (বাংলাদেশের আহসান মঞ্জিলের মতো), মুজে মেল্লিসহ (জাতীয় জাদুঘর) পুরাতন তেহরানের অসংখ্য অলিগলি চষে বেড়িয়েছি। তবে উপচে পড়া ভিড় দেখা যায় তেহরানের ঐতিহ্য মিলাদ টাওয়ার ও কুরেশ কমপ্লেক্সে।
তবে সন্ধ্যায় মনে হলো একটুকরো বাংলাদেশে প্রবেশ করলাম। ইউসুফাবাদে বাংলাদেশ দূতাবাসে প্রবেশ করতেই ইরানে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত এ কে এম মজিবুর রহমান ভূঁইয়া, দূতালয় প্রধান এ টি এম মোনেমুল হক, কমার্শিয়াল কাউন্সেলর মো. সবুর হোসেন কোলাকুলির মাধ্যমে ঈদ শুভেচ্ছা জানালেন। মনে হলো সারা দিনের পর এই প্রথম ঈদের পরিতৃপ্ত আনন্দ পেলাম। সবার প্রিয় তাসলিমা ভাবিকে সালাম করেই সেলামি আদায় করে নিলাম। এবারই প্রথম প্রবাসে কারও কাছ থেকে সেলামি পেলাম। লাভলি ভাবি পড়ে দেবেন বলে কেটে পড়লেন। সবার রংবেরঙের পোশাক যেন পুরো অনুষ্ঠানকে আরও বেশি ঝলমল করে তুলেছিল।
তবে বেশি আনন্দ পেয়েছি বাংলাদেশে ইরানের নিযুক্ত সাবেক ডেপুটি কালচারাল কাউন্সেলর খসরু আবাদি তার নিজস্ব বাগান থেকে একেবারে শাখাসহ আপেল নিয়ে এসেছেন। এ ছাড়া তার বাগানের পিচ ফল, চেরি ও আলু (যা থেকে পরবর্তীতে আলু বোখারা তৈরি হয়) সবার জন্য নিয়ে এসেছিলেন। আমরা সবাই দারুণ আনন্দ নিয়ে খেতে শুরু করলাম।
দূতাবাস কর্তৃক এই আনন্দ আয়োজনে তেহরানে বসবাসরত সাংবাদিক, ডাক্তার, শিক্ষার্থী, দূতাবাস কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ অনেকেই উপস্থিত ছিলেন। গরুর মাংস, মুরগি, সবজি ও ডালের এক চিরাচরিত বাংলাদেশি খাবারের পসরা ছিল এটি। সবশেষে ঈদের সেমাই ও ফিরনিতো ছিলই।
এতো ছিল মুদ্রার এক পিঠ, কিন্তু অন্য পিঠে রয়েছে ইরানে অবৈধভাবে বসবাসরত বাঙালি ভাইদের ঈদ উৎসব। ঈদের আগের দিন সকাল থেকেই পুলিশি তৎপরতার কারণে এবারের ঈদের নামাজ আদায় করা হয়নি তাদের। তবে এর পেছনেই লুকিয়ে থাকে কিছু বাঙালি দালালের অসাধু তৎপরতা। টাকার মাধ্যমে পুলিশ সাজিয়ে কারখানায় মহড়া দেওয়া ও প্রতি মাসে মাসোয়ারা আদায় করা এই দালালদের নিত্যনৈমিত্তিক কাজ।
ইরানে বসবাসরত বাঙালি দালালেরা ইরানে বিয়ে করার সুবাদে এখানে বৈধভাবে বসবাস করছে। কিন্তু সেটা অবৈধ শ্রমিকদের জন্য সুবিধার চাইতে, অসুবিধাই বেশি হয়েছে। প্রতিনিয়ত নানা উপায়ে এরা এই অবৈধ শ্রমিকদের হয়রানি করে যাচ্ছে। এরা এখানকার আদালতে শ্রমিক পাচার, নারী নির্যাতনসহ হরেক রকম মামলায় একে-অপরকে ফাঁসিয়ে দিচ্ছে। এখানকার বাঙালি দালালদের রয়েছে নিজস্ব বাহিনী। আদালতে এরা টাকার বিনিময়ে একে অপরের বিরুদ্ধে সাক্ষী দেয়।
বেশ কিছুদিন আগে এমনি এক লোমহর্ষক ঘটনা ঘটে যায় তেহরানে। এখানে বৈধভাবে বসবাসরত এক বাংলাদেশি ছাত্রকে অপহরণ ও প্রায় জবাই করার শেষ মুহূর্তে ইরানের পুলিশ উদ্ধার করে তাকে। অথচ ইরানের মালিক বা পুলিশ কিন্তু খুব বেশি কিছু বলে না। পুলিশ ধরলেও মালিকেরা নিজেই তাদের ছাড়িয়ে নিয়ে যায়। কিন্তু রেহাই নেই এই তথাকথিত দালাল আর মাফিয়া বাহিনীর হাত থেকে। কোনো কাজ না করেই এদের এখানে রয়েছে দামি গাড়ি আর বাড়ি! কারও কিছু বলার বা কোনো কিছু করার করার সাহস নেই। কেউবা প্রাণ ভয়ে বা কষ্টে শুধুমাত্র পরিবার-পরিজনের মুখের দিকে তাকিয়ে মুখ বুজে সহ্য করে যায় এই নির্মম-নির্যাতন আর দাম্ভিকতা। এটাই প্রবাসের ঈদের সবচেয়ে বড় তিক্ত অভিজ্ঞতা।
ছবি: সৈয়দ রাসতিন রেজা
*লেখক সহকারী অধ্যাপক, ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। বর্তমানে পিএইচডি গবেষক, তারবিয়্যাত মোদাররেস বিশ্ববিদ্যালয়, তেহরান, ইরান।