পান্তাতেই বিশ্ব রসনা জয় বাঙালি মেয়ে কিশোয়ারের

মাস্টারশেফ অস্ট্রেলিয়া মোটামুটি পৃথিবী বিখ্যাত একটি রান্নার শো। পৃথিবীর কথা বাদ, অস্ট্রেলিয়াতে এই শোর রেটিং হলো ১ নম্বর। প্রতি এপিসোডের মিনিমাম ভিউ চার মিলিয়নের ওপরে। এই দেশের মানুষের রাগবি খেলা খুব পছন্দের জিনিস, কিন্তু সেই রাগবি খেলার জনপ্রিয়তাকেও ছাড়িয়ে গেছে এই মাস্টারশেফ অস্ট্রেলিয়া।

আমি কখনো খুব বেশি এ শো ফলো করতাম না। প্রতিযোগীরা দৌড়াদৌড়ি করে রান্না করছেন, সেটা বিচারকেরা খেয়ে বিচার করছেন, এগুলো আমার ভালো লাগে না। আমরা হাত দিয়ে ভাত মাখিয়ে খাওয়া মানুষ। খাবারদাবারের বিষয়ে আমরা একটু আরাম চাই। এসব মাস্টারশেফটেফ দেখলে অস্থির অস্থির লাগে। তার ওপর যেসব খাবার রান্না হয়, তার বেশির ভাগই চিনি না। খেতে কেমন আল্লাহই জানে। তাই ইমোশনালি আমি কখনোই কানেক্ট হতে পারিনি এসব শোর সঙ্গে।

কিন্তু এই বছর ব্যতিক্রম। শুধু আমার জন্য ব্যতিক্রম না, হাজার হাজার বাঙালির জন্যই ব্যতিক্রম। এই বছর খুব কম অস্ট্রেলিয়ান বাংলাদেশি আছেন যে এই শোর খবর রাখেননি। কারণ, এ বছর কিশোয়ার নামের এক বাংলাদেশি মেয়ে মাস্টারশেফ অস্ট্রেলিয়ায় ফাইনালে চলে এসেছেন। আর আমার জন্য কিশোয়ার শুধু বাংলাদেশি নন, তিনি তো আমাদের বিক্রমপুরের মেয়ে।

কিশোয়ার এই শোতে শুধু ভালো রান্না করে বিচারকদের খুশি করেননি, তিনি যে খাবারগুলো রেঁধেছেন, সেগুলো আমাদের প্রাণের খাবার। সেই খাবারগুলো টিভিতে দেখেই মনে হয়েছে, আরে এইটা তো আমাদের খানাখাদ্য, একমাত্র আমরাই জানি এইটার অথেন্টিক স্বাদ।

খিচুড়ি, জাউ ভাত, চিংড়ি পটোলের তরকারি, নান নেহারি, ভর্তা, ডাল–ভাত—কী ছিল না এই শোতে?
ফাইনাল রাউন্ডে এসে পান্তা, আলুভর্তা, শুকনা মরিচ আর মাছভাজা যখন তিনি বিচারকদের সামনে রেখেছিলেন, তাঁরা তখন বলেছিলেন, তাঁরা তাঁদের ইহজিন্দেগিতে এমন খাবার দেখেননি। দেখবেন কোথা থেকে? এই খাবার রান্না করার সাহস কজনের আছে? এই মেয়ে তো শুধু রান্না করেন না, তাঁর কলিজাও তো দেখি বিশাল বড়! কিশোয়ার একজন সাহসী মেয়ে। তিনি আমাদের অন্তরের প্রিয় খাবারটাই কনফিডেন্ট আর সাহসের সঙ্গে পরিবেশন করেছেন।

কিশোয়ার

এই অনুষ্ঠানের পেছনে থাকা ত্রু-টিম, মিডিয়া এবং ফুড ক্রিটিকরা কিশোয়ারকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘তুমি কি বাংলাদেশি খাবার ছাড়া আর কিছু রাঁধতে পারো না?’ কিশোয়ার স্মিত হেসে জবাব দিয়েছিলেন, ‘আমি আরও অন্য কুইজিনের খাবারও রাঁধতে পারি, কিন্তু আমি ছাড়া আর কেউ এইখানে বাংলাদেশি খাবার রাঁধতে পারেন না। অতএব আমি যদি তোমাদের খাসির রেজালা না খাওয়াই, তাহলে আর কেউ তোমাদের এখানে সেটা খাওয়াতে পারবে না।’

বাঙালিরা ভোজনবিলাসী। আমরা মানুষকে খাওয়াতে খুব পছন্দ করি। এ জিনিস আমাদের রক্তে মিশে আছে। অস্ট্রেলিয়ায় ১৩ বছর ধরে আছি। কতশত রকমের জাতীয়তার মানুষের সঙ্গে পরিচয় হয়েছে। কিন্তু বিশ্বাস করেন, কোনো একটা জাতি আমি খুঁজে পাইনি, যারা আমাদের মতো খানাখাদ্য বিষয়ে উদার, আমাদের মতো মনপ্রাণ উজাড় করে অতিথি আপ্যায়ন করে।

আমরা যাঁরা প্রবাসী, আমাদের মনে সব সময় একটা ছোট্ট দুঃখ আছে। তা হলো আমরা আমাদের এত মজার মজার খাবার, এত টেক্সচার্ড খাবার অন্য দেশিদের আরাম করে খাওয়াতে পারি না। আমাদের রেস্তোরাঁগুলো, আমাদের খাবারগুলো ইন্ডিয়ান হিসেবে ট্যাগ খায়। কিন্তু কিশোয়ার আজকে সেই ট্যাগ উঠিয়ে আমাদের প্রাপ্য সম্মান আর ভালোবাসাটুকু ফিরিয়ে এনেছেন।

আমার এক সহকর্মী আছে। সে কথা বললেই আমার ইচ্ছা করে স্কচটেপ দিয়ে তার মুখ আটকিয়ে দিই। সে সারাক্ষণ কটকট করে কথা বলে, প্রচণ্ড রুড আর বেয়াদব শ্রেণির। সে আমাকে আজ খোঁচা দিয়ে বলল শাহিদা, ‘তোমাদের কিশোয়ার হলো “কান্না আর কারি কুইন।” কিছু হলেই দেখি সে কাঁদে। কাঁদতে কাঁদতে ফাইনালে চলে গেল নাকি?’ আমার তখন ইচ্ছা করছিল, অফিসের ফ্রিজের ভেতর রাখা ওর লাঞ্চের জন্য যে স্যান্ডউইচ আছে, সেই স্যান্ডউইচের ভেতরে গোপনে বোম্বাই মরিচ কুচি কুচি করে কেটে ঢুকিয়ে রাখি। দুপুরবেলা স্যান্ডউইচ খাবে আর লাফাবে। আর রাতেরবেলা সে বাথরুমে যাবে আর লাফাবে।

যদিও আমি এগুলোর কিছুই করলাম না, শুধু বললাম, ‘শোনো, কিশোয়ার শুধু বাংলদেশ না, বাংলাদেশের খাবার না, বাঙালি নারীকেও রিপ্রেজেন্ট করছেন। আমরা কিছু হলেই কেঁদে বুক ভাসিয়ে দিই। আমাদের ভালো বললেও আমরা কাঁদি, খারাপ বললেও কাঁদি এবং আমরা যেকোনো রান্নাকেই তরকারি লেভেলে নিয়ে যাই। তোমরা যেই নুডলস সয়া সস আর কাঁচা সবজি দিয়ে খাও, আমরা ঠিক সেই নুডলস রান্না করার আগে মুরগি বা গরুর মাংস ছোট্ট টুকরো করে রেঁধে, তার মধ্যে নুডলস রান্না করে খাই। শুধু নুডলস না, পাস্তা স্প্যাগেটি সব আমরা এভাবেই খাই। পানি–লবণ দিয়ে সেদ্ধ করে খানাখাদ্য খাওয়ার অভ্যাস আমাদের ভেতরে নেই। রান্নায় আমরা সব সময় সবচেয়ে বেশি এফোর্ট দিই।’

অস্ট্রেলিয়ার সবচেয়ে বড় দুটি অনলাইন বেটিং সাইট-স্পোর্টস বেট এবং ট্যাব (এগুলোকে জুয়া/ গ্যাম্বলিং সাইটও বলা যায়—যেকোনো প্রতিযোগিতামূলক খেলায় এই দুটি সাইটে প্রতিদিন লাখ লাখ ডলার বেট ধরা হয়)! এই দুটি সাইটই কিশোয়ারের জিতে যাওয়া সম্ভাবনার কথা বলেছিল।

লেখক

পান আমার খুব পছন্দের, আমি যেখানে যাই খাবার শেষে একটা পান খুঁজি। কিন্তু একই সঙ্গে পান খুব রিস্কি একটা জিনিস। সবাই মুখে নিতে পারে না। এমনকি অনেক বাংলাদেশিও পান খেতে পারে না। সারা জীবন দেখেছি, এসব দেশে ইন্ডিয়ান/ বাংলাদেশি রেস্টুরেন্টে ডেসার্ট হিসেবে থাকে গুলাবজামুন নামের এক অতিরিক্ত দারুচিনি–এলাচি দেওয়া মিষ্টি। কিন্তু এই কিশোয়ার বিচারকদের পান খাইয়েছেন। পুরা পান মুখের ভেতর ঢুকিয়ে সব বিচারকে যখন রাতের খাবার শেষে পান চিবুচ্ছিলেন, আমার তখন মনে হয়েছে মাস্টারশেফকে জিতলেন ব্যাপার না, কিশোয়ার অলরেডি জিতে গেছেন।

অডিশন রাউন্ডে কিশোয়ারের মজাদার খাবার খেয়ে বিচারক তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলেন,
‘এত দিন তুমি কোথায় ছিলে কিশোয়ার?’
কিশোয়ার তাঁর চোখের পানি মুছতে মুছতে জবাব দিয়েছিলেন, ‘জাস্ট বাসায় ছিলাম...’
সেদিন কিশোয়ারের এ উত্তরের সঙ্গে বোধ হয় হাজারো মেয়ে কেঁদেছিলেন। আসলেই তো, কত কত কিশোয়ার স্রেফ বাসাতেই রয়ে যান। এ কিশোয়ার সেই বাসার ভেতরের রান্নার স্বাদ, আন্তর্জাতিক মানের একটি রান্নার অনুষ্ঠানে তুলে এনেছেন, যথেষ্ট সুনাম কুড়িয়েছেন, বাকি ৪৭ জন নানান দেশের প্রতিযোগীকে পেছনে ফেলে, বাংলাদেশি খবার নিয়ে ফাইনালে চলে এসেছেন। কিশোয়ারকে ভালোবাসার জন্য এর চেয়ে বেশি কিছু কি দরকার আছে?
কিশোয়ার অলরেডি জিতে গেছেন, কিশোয়ার অলরেডি আমাদের জিতিয়ে দিয়েছেন।
লেখক: শাহিদা আরাবী ছুটি, সাইকোলজিক্যাল ইনজুরি ম্যানেজমেন্ট কাউন্সিলর, অস্ট্রেলিয়ান ফেডারেল কোর্ট, ক্যানবেরা, অস্ট্রেলিয়া