পরাক্রমশালী ইংল্যান্ডের জননী
১৫৫৯ সালের ১৫ জানুয়ারি, অষ্টম হেনরি ও অ্যান বোলিনের ২৫ বছর বয়সী কন্যা এলিজাবেথ টিউডর লন্ডনের ওয়েস্টমিনস্টার অ্যাবেতে রানি প্রথম এলিজাবেথ হিসেবে মুকুট লাভ করেন। এর আগে মুকুটটি তাঁর সৎ বোন ইংল্যান্ডের রানি প্রথম মেরির ছিল। মেরির মৃত্যুর দুমাস পরে এলিজাবেথের অভিষেক হয়।
দুজনেই অষ্টম হেনরির মেয়ে হলেও মেরির পাঁচ বছর রাজত্বকালে তাঁর সঙ্গে এলিজাবেথের সম্পর্ক ছিল সাপে-নেউলে। মেরি ছিলেন ধর্মের দিক থেকে ক্যাথলিক অনুসারী। অন্যদিকে এলিজাবেথ ছিলেন প্রোটেস্ট্যান্ট ধর্মাবলম্বী। তাই ক্যাথলিক হিসেবে বেড়ে ওঠা মেরি নিজের রাজত্বকালে সব ক্যাথলিকপন্থী আইন প্রণয়ন করেন এবং ইংল্যান্ডে পোপের আধিপত্য পুনরুদ্ধার করার আয়োজন করেন। এতে প্রোটেস্ট্যান্টদের মধ্যে বিদ্রোহ শুরু হয়।
রানি মেরি ভবিষ্যতে নানা জটিলতা আসতে পারে সন্দেহ করে প্রোটেস্ট্যান্ট এলিজাবেথকে টাওয়ার অফ লন্ডনের একটি কারাগারে বন্দী করেন। মেরির মৃত্যুর পর এলিজাবেথ তাঁর বিরুদ্ধে আরও বেশ কয়েকটি ক্যাথলিক ষড়যন্ত্র থেকে বেঁচে যান। তাঁর ইংল্যান্ডের সিংহাসনে আরোহণকে বেশির ভাগ লর্ড অনুমোদন দিয়ে স্বাগত জানিয়েছিলেন। এই লর্ডরা মূলত প্রোটেস্ট্যান্ট ছিলেন এবং একজন প্রোটেস্ট্যান্ট রানির অধীনে বৃহত্তর ধর্মীয় সহিষ্ণুতা আশা করেছিলেন। পররাষ্ট্রমন্ত্রী স্যার উইলিয়াম সেসিলের প্রাথমিক নির্দেশিকা অনুযায়ী, মেরির ক্যাথলিকপন্থী আইন বাতিল, ইংল্যান্ডে একটি স্থায়ী প্রোটেস্ট্যান্ট চার্চ প্রতিষ্ঠা এবং স্কটল্যান্ডের ক্যালভিনিস্ট সংস্কারকদের উৎসাহিত করার ব্যবস্থা হয়।
পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে এলিজাবেথ প্রোটেস্ট্যান্ট মিত্রদের শক্তিশালী করার চেষ্টা করেন এবং তাঁর শত্রুদের জন্য ‘ডিভাইড অ্যান্ড রুল’ নীতি অনুশীলন করে তাদের বিভক্ত করে রাখার ব্যবস্থা করেন। এতে এলিজাবেথের বিরোধিতা করেন স্বয়ং পোপ। তিনি এলিজাবেথের বৈধতা মেনে নিতে অস্বীকার করেন। সে সময়, ক্ষমতার অতি উচ্চে থাকা ক্যাথলিক জাতির দেশ ছিল স্পেন। তারাও এলিজাবেথের বৈধতা অস্বীকার করে।
এতে ১৫৮৮ সালে ইংরেজ-স্প্যানিশ প্রতিদ্বন্দ্বিতা চরমে ওঠে এবং স্প্যানিশরা হঠাৎ ইংল্যান্ড আক্রমণ করে বসে। সে সময় তাদের ছিল বিশ্বের বৃহত্তম নৌ বহর ‘স্প্যানিশ আর্মাডা’। কিন্তু প্রচণ্ড ঝড়ঝঞ্ঝা ও ইংরেজ নৌবাহিনীর অটল অবস্থান- এই দুই শক্তি একত্র হয়ে স্প্যানিশ আর্মাডাকে ধ্বংস করে ফেলে। এভাবেই স্প্যানিশদের আগ্রাসন লিপ্সা ব্যর্থ হয়।
সমুদ্রে ইংরেজ আধিপত্য বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে এলিজাবেথ আবিষ্কার যাত্রার বিষয়কে উৎসাহিত করেন। উদাহরণস্বরূপ, স্যার ফ্রান্সিস ড্রেকের বিশ্ব পরিভ্রমণ ও উত্তর আমেরিকার উপকূলে স্যার ওয়াল্টার র্যালের অভিযান। বিয়ে করলে নিজের কর্তৃত্ব বিপন্ন হতে পারে বিবেচনা করে এবং নিজের রাজত্ব দীর্ঘদিন টিকিয়ে রাখার অভিপ্রায়ে, এলিজাবেথ বিয়েতে অনিচ্ছা প্রকাশ করেন। সে জন্য আজও তিনি ইংল্যান্ডের ‘কুমারী রানি’ নামে পরিচিত। ফুল যেমন দিনে দিনে পাপড়ি মেলে, ইংরেজদের রেনেসাঁর যুগে তেমন সবকিছু ফুলের মতো বৃদ্ধি ও শোভা পেতে থাকে। সেভাবে উইলিয়াম শেক্সপিয়ারের মতো বিশাল প্রতিভার লেখকদের নাম এর সঙ্গে যুক্ত হয়ে আছে।
১৬০৩ সালে যখন তাঁর মৃত্যু হয়, তখন ইংল্যান্ড সব দিক থেকে একটি প্রধান বিশ্বশক্তি হয়ে ওঠে। এ কারণে রানি প্রথম এলিজাবেথ ইংল্যান্ডের অন্যতম সেরা শাসক (রানি/রাজা) হিসেবে ইতিহাসের পাতায় স্থান করে নেন।