পরম্পরা
খুব সকালে পানির আওয়াজে মিলির ঘুম ভেঙে গেল। কে শাওয়ার নিচ্ছে? লকডাউন সময়ে তো কারও অফিস, স্কুল, কলেজ খোলা নেই। প্রায় দুই মাস হল সবাই বাসায় বন্দী একরকম। রাত দশটার মধ্যে ঘুমানো আর সকাল সাড়ে ছয়টায় ওঠার অভ্যাস পাল্টাতে এক সপ্তাহও লাগেনি কারও। রাত জেগে নিজের ঘরে ল্যাপটপে মুভি দেখা। নয়তো দেশে কথা বলা। বার-তারিখও মনে রাখে না কেউ। বাথরুম থেকে তোয়ালে মাথায় আসিফ বেরিয়ে এল। হাতি দিয়েও যে আসিফকে টেনে তোলা সম্ভব না, এই ভোরেই তার শাওয়ার শেষ? ব্যাপার কি? ১০ মিনিটের মধ্যে পরিপাটি হয়ে তার বাদামি হুডিটি গায়ে চড়িয়ে আসিফ হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে যাচ্ছিল।
‘কোথায় যাচ্ছ আসিফ?’
‘মা, তুমি জেগে আছ বুঝিনি। গাড়িতে নৌশীন ওয়েট করছে, একটু দেখা করে আসি।’
অল্প কিছুদিন হল ছেলেটা রিলেশনশিপে জড়িয়েছে, মেয়েটা ওর সঙ্গেই পড়ে। করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে গ্র্যাজুয়েশন করতে এ বছর পুরোটাই লেগে যাবে। ওদের দেখা–সাক্ষাৎও বন্ধ এই সময়ে। মেয়েটা তাই সাত সকালে হাজির। মিলি আলতোভাবে তার কম্বলটা গায়ে টেনে আবারও শুয়ে পড়ল। তার মন ফিরে যায় সেই নব্বইয়ে। এ রকম একটা সময় তার জীবনেও ছিল। এই উচাটন, এই ব্যাকুলতা, এই দীর্ঘ অদেখার ব্যথা তাকেও শতবার নাড়া দিয়ে গিয়েছিল।
স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের সময় তাদের ভালো লাগা জমে উঠেছিল। ভার্সিটি সহসাই অনির্দিষ্ট কালের জন্য বন্ধ হয়ে গেল। ডাঙায় তোলা মাছের মতো ছটফট করত মিলি। অথচ তখনো ‘ভালোবাসি’ কথাটাই বলা হয়নি। ৬ ডিসেম্বর ভার্সিটি খুললে মাকে সাত পাঁচ বুঝিয়ে মিলি আচমকাই বেরিয়ে পড়েছিল। শীতের সকালে ঢালাও রং খেলা হচ্ছিল। ভিড় বাঁচিয়ে তারা বসেছিল আই-ই-আর ক্যানটিনে। ছেলেটা নিজের দুহাতে তুলে নিয়েছিল মিলির দুহাত।
‘আপনি কি আমাকে ভালোবাসেন?’
মিলি মুহূর্তেই জমে পাথর। আবেগে সে কথা খুঁজে পায়নি। ওর থমকে যাওয়া ফ্যাকাশে মুখ দেখে ছেলেটা বলেছিল—
‘প্লিজ এই চেহারা নিয়ে বাড়ি ফিরবেন না। তাহলে আপনাকে দেখে সবাই ভয় পাবেন। পরে ভেবেচিন্তে উত্তর দিয়েন।’
সেই উচাটন মনটিই যেন আজ নিজের সন্তানের মাঝে দেখতে পেল মিলি। ভীষণ চেনা এক অনুভূতি। অস্থির এক প্রতীক্ষা।